ভূপ্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ - Nature & Resources

ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিবিড় শান্তিময় পরিবেশের পঞ্চগড় জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল।

ভৌগোলিক অবস্থানঃ হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শেষ প্রান্তে পঞ্চগড় জেলার অবস্থান। রাজনগড়, মিরগড়, ভিতরগড়, দেবেনগড় ও হোসেনগড় নামের পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড় জেলার তিন দিকেই ১৮৩ মাইল বেষ্টিত বাংলাদেশ-ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চল। এ জেলার উত্তরে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, উত্তরপূর্ব ও পূর্বে জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পূর্ণিয়া ও উত্তর দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিমি, এভারেস্ট শৃঙ্গ ৭৫ কিমি, ভুটান ৬৪ কিমি, চীন ২০০ কিমি, ভারতের দার্জিলিং ৫৮ কিমি, শিলিগুড়ি ৮ কিমি আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র ১১ কিমি। 

ভূমির গঠনঃ টারসিয়ারী যুগে পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের বহু অংশই ডুবে গিয়েছিলো সমুদ্রের প্লাবন আর জলোচ্ছাসে। বৃহৎ বঙ্গের অনেকটা জায়গাজুড়েই পাওয়া যায় টারসিয়ারী যুগের সমুদ্রজাত পাললিক শিলাস্তর। পঞ্চগড় জেলা সংলগ্ন জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলায় টারসিয়ারী যুগের পাথর পাওয়া গেছে। হিমালয় পর্বত পাদদেশীয় সমভূমির একটি অংশ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে, যা সমগ্র পঞ্চগড় এলাকায় বিস্তৃত। বৃহত্তর দিনাজপুর সহ প্রায় ৩,৮৭০ বর্গ কিমি-এর এই অঞ্চলটি হিমালয়ের পাদদেশীয় বালুকারাশি এবং নুড়ি দ্বারা আচ্ছাদিত। হিমালয় পাদদেশের টেরাই এলাকা থেকে মহানন্দা ও করতোয়া নদী এবং তাদের শাখা-প্রশাখা কর্তৃক আনীত ও পলিজ পাখা হিসেবে সঞ্চিত হয়েছে। পাদদেশীয় সঞ্চয়নসমূহ বিলম্বিত প্লাইসটোসিন (Late Pleistocene) অথবা প্রাথমিক হলোসিন (Early Holocene) সময়কালের মতো পুরানো, তবে মধুপুর কর্দম থেকে নবীনতর। এই ভূমিরূপের নিষ্কাশন প্রণালী বিনুনি প্রকৃতির এবং একাধিক অগভীর, প্রশস্ত, মসৃণ এবং অনিয়মিত আকৃতির শৈলশিরা বিশিষ্ট। এ সমস্ত শৈলশিরা অসংখ্য প্রশস্ত কিন্তু অগভীর নদীখাত দ্বারা বিভক্ত, যেগুলো ঘন ঘন শাখায়িত ও পুনর্যোজিত হয়েছে। পাদদেশীয় সমভূমি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সুষমভাবে ঢালু হয়ে গিয়েছে। ঢালের উত্তর প্রান্ত সমুদ্রসমতল থেকে গড়ে ৯৬ মিটার উঁচু এবং দক্ষিণ প্রান্ত ৩৩ মিটার। হিমালয় হতে প্রবাহমান পাহাড়ি নদী দ্বারা বাহিত বালি পাথর, চুনা পাথর, কাদা পাথর ইত্যাদি পাওয়া যায় পঞ্চগড় জেলার ভূ-ভাগে।

জনসংখ্যাঃ ২০১১ খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী জেলার মোট জনসংখ্যা ১,০৫০,০১৪ জন। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত এবং বর্তমানে পূর্ণিয়া, পশ্চিম দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা পরিবেষ্টিত পঞ্চগড়ের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের সামগ্রিক রূপের সঙ্গে অভিন্ন হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য। হিন্দু ও মুসলিম ছাড়াও পঞ্চগড় জনপদে রয়েছে রাজবংশী, কোচ, পলিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও এবং সুনরীদের জনবসতি। এই বিচিত্র জনধারার মিশ্র রূপায়ণে গড়ে উঠেছে পঞ্চগড়ের নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি। এই স্বর্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা ৬৯৪০ জন।

জীবন ও জীবিকাঃ পঞ্চগড় জেলার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষি ও পাথর উত্তোলনের উপর নির্ভরশীল। সুদূর অতীতে পঞ্চগড়ের কৃষি কাউন, ভুট্টা এবং পয়রা চাষ দিয়ে শুরু হলেও এখানকার কৃষি সংস্কৃতি কয়েক ধাপ পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে পঞ্চগড়ে ধান, গম, আখ, ভুট্টা, ডাল, চিনাবাদাম, তরমুজ, কমলালেবু, স্ট্রবেরিসহ উন্নত ফল ও ফসল উৎপন্ন হয়। স্থানীয় কর্মসংস্থানে গতি স্থানীয় কর্মসংস্থানে গতি প্রাকৃতিক সম্পদ, পাথর-বালি আহরণ। গড়ে ওঠেছে মিল ও ফ্যাক্টরি। সবুজ ঘেরা সমতল পঞ্চগড়ের উর্বর মাটিতে চা-চাষের মহোৎসব এখানকার মানুষের কৃষি কালচারে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। পঞ্চগড়ের চিনিকল, চা শিল্প, জুট মিল, ডিস্ট্রিলারিজ, খাম্বা, জেমকন প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানা হলেও অদ্যবধি কৃষিই এখানকার জীবন জীবিকার প্রধান উপকরণ।

জলবায়ু ও আবহাওয়াঃ সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৭৭.৪১ মিটার (২৫৩.৯৭ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত পঞ্চগড় একটি আর্দ্র উপক্রান্তীয়, শুষ্ক শীতকালীন জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। পঞ্চগড় জেলার বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৭.৫১ºC (৮১.৫২ºF) যা বাংলাদেশের গড় থেকে গড় তাপমাত্রার -০.২৩% কম। পঞ্চগড়ে সাধারণত বার্ষিক ১৪৮.৬ মিমি (৫.৮৫ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত হয় এবং বছরে ১৬১.৪৫ দিন (বছরের ৪৪.২৩% সময়) বৃষ্টির থাকে।

পঞ্চগড়ের নদনদীঃ মাত্র ১৪০৪.৬৩ বর্গ কিমি আয়তনের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় ৪৮ টি নদনদী, যার  অধিকাংশের উৎসমুখ প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এককালে এসব নদী ছিল প্রমত্তা। পাহাড় থেকে নেমে আসা খরস্রোতা নদীগুলোতে ১০০ বছর আগেও নিয়মিতভাবে চলাচল করত ছোট-বড় নৌকা। জেলার প্রধানতম নদী করতোয়া। এই নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছিল পঞ্চগড় শহর। ব্যাপারীরা বড় বড় নৌকায় করে তাঁদের সওদা নিয়ে ভিড়ত এই ঘাটে। নদীকে ঘিরেই প্রাণচাঞ্চল্য ছিল পঞ্চগড়, নদীকে নিয়েই ঘুরপাক খেত পঞ্চগড়ের অর্থনীতি আর মহানন্দা বিধৌত সমৃদ্ধ তেঁতুলিয়া। আরো পড়ুন

খনিজ সম্পদঃ পঞ্চগড়ের প্রধান খনিজ সম্পদ ভূগর্ভস্থ পাথর। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে প্রবাহমান ছোট বড় প্রায় ৪৮টি নদী। প্রতি বছর বন্যায় এই নদীগুলো বয়ে নিয়ে আসে বিপুল পরিমান ছোট ও মাঝারি আকৃতির পাথর, যা সারফেস ডিপোজিট হিসেবে জমা হয়ে মাটির নীচে পাওয়া যায়। পঞ্চগড়ে সামগ্রিকভাবে ৫০-৬০ বছর ধরে কয়েক হাজার পাথরশ্রমিক পাথর উত্তোলন করে আসছেন। শুরু থেকে স্থানীয় পাথর শ্রমিকরা নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করলেও সাম্প্রতিককালে সমতল ভূমি খুঁড়ে ব্যাপকহারে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। পঞ্চগড় থেকে প্রতিদিন ২০০-৩০০ ট্রাক পাথর রফতানি হয়।প্রতি বছর এখান থেকে হাজার হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করা হয়। সারা দেশের প্রয়োজনীয় সিংহভাগ পাথর পঞ্চগড় থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। এই পাথর দিয়ে নির্মিত হয় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট। আরো পড়ুন


তথ্যসূত্রঃ রহিম আব্দুর রহিম
Last updated: 20 April 2024

Leave a Reply

Today's Weather

Recent News

Facebook Page