মির্জাপুর শাহী মসজিদ – Mirzapur Shahi Mosque

মির্জাপুর শাহী মসজিদ – Mirzapur Shahi Mosque

গ্রামঃ মির্জাপুর, ইউনিয়নঃ মির্জাপুর, উপজেলাঃ আটোয়ারী , পঞ্চগড়।

মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলী মির্জাপুর শাহী মসজিদ পঞ্চগড় জেলার পর্যটন শিল্পের এক অনন্য স্থাপনা। পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মির্জাপুর গ্রামের নাম অনুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় প্রান্ত মোঘল আমলে নির্মিত স্থাপনাসমূহের মধ্যে একমাত্র মির্জাপুর শাহী মসজিদটিই এর উৎকৃষ্ট নির্মাণ কৌশল, সমৃদ্ধ গাঁথুনি, সুসজ্জিত দেয়াল, নান্দনিক প্লাস্টার, সুদৃশ্য নকশা, দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ নিয়ে মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে এখনো মজবুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

প্রায় ৩৫০ বছরের সুপ্রাচীন মির্জাপুর শাহী মসজিদ দেখার জন্য দেশি-বিদেশী পর্যটক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ভিড় করেন প্রতিনিয়ত। প্রাচীন স্থাপত্য ও পুরনো নিদর্শন দেখতে আগ্রহী দর্শনার্থীদের জন্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ একটি উপযুক্ত স্থান। মির্জাপুর মসজিদের মনোমুগ্ধকর নকশা ইবাদতে মশগুল ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটায়।

তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মির্জাপুর শাহী মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট এবং প্রস্থ ২৫ ফুট। আয়তাকার এক সারিতে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ সাধারণত মোঘল স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য। গম্বুজের শীর্ষবিন্দু ক্রমহ্রাসমান বেল্টযুক্ত। চারকোণে রয়েছে স্তরযুক্ত ও নকশাখচিত বেল্ট করা চারটি সুচিক্কন মিনার । এছাড়া সম্মুখবর্তী দেয়ালের মধ্য দরোজার দু’পার্শ্বে মধ্য গম্বুজের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নির্মিত হয়েছে আরো দুটি ক্ষুদ্র মিনার। এই মিনারের দেয়াল সংযুক্ত অংশ বর্গাকার ৷ অনুরূপ সমমাপের ক্ষুদ্রাকৃতির দুটি মিনার রয়েছে পশ্চিম দেয়ালেও। মসজিদের দেওয়ালে টেরাকোট ফুল এবং লতা পাতার বিভিন্ন খোদাই করা রক্তবর্ণ নকশা সহজেই আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। মসজিদের দেয়ালের স্বতন্ত্র নকশার একটির সঙ্গে অন্যটির মিল পাওয়া যায় না।

শিল্প সৌন্দর্যের অপূর্ব নিদর্শন এই মসজিদের সর্বত্র ইসলামী টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশায় পরিপূর্ণ। মসজিদে ব্যবহৃত ইটগুলো চিক্কন, রক্তবর্ণ ও অলংকৃত । কথিত আছে যে, সামনের দেয়ালের ইটগুলো নাকি ঘিয়ে ভেজে তৈরি করা হয় । দেয়ালের অলংকরণে ফুল ও পাতার পাশাপাশি পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর চিত্রও উৎকীর্ণ করা হয়েছিলো। সম্ভবত নির্মাণকারী কারিগরদের মধ্যে হিন্দু স্থপতিও অন্তর্ভুক্ত ছিলো । অথবা এমনও হতে পারে যে, প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যই খচিত হয়েছে জীবজন্তর চিত্র । অবশ্য বর্তমানে জীবজন্তর চিত্রসমূহ অপসৃত হয়েছে।

এই মসজিদের সামনের দেয়ালে রয়েছে সুশোভন লতাপাতা ও ইসলামী এতিহ্যপূর্ণ টেরাকোটা নকশা খচিত মাঝারি আকারের তিনটি দরজা। দরজার কিছুটা দূরবর্তী উভয় পার্শ্বে রয়েছে অন্তঃপ্রবৃষ্ট প্যানেল ৷ তিনটি দরজাতেই ছাদ ও দরজার উপরিভাগের মাঝামাঝি স্থানে বাইরের দিকে উভয় পার্শ্বে ঢালু তোরণ আকৃতির একটি অতিরিক্ত স্ফীত অংশ সংযুক্ত হওয়ায় অলংকরণ বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে নতুনত্ব। সামনের তিনটি দরজার অনুরূপ আরো তিনটি দরজার নকশা ও অন্তঃপ্রবিষ্ট প্যানেল স্থাপিত হয়েছে পশ্চিম দিকের দেয়ালেও। তবে এই দরজা সম্ভবত স্থাপত্য কৌশল হিসেবেই নির্মিত। উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালেও নকশাখচিত এবং অন্তঃপ্রবিষ্ট এক দরজার নকশাখচিত ৷ তবে এই দরজা দুটির উপরিভাগের স্ফীত অংশটি সমান্তরাল নয়। গ্রাম বাংলার এতিহ্য অনুযায়ী দোচালা আকৃতির। মসজিদের অভ্যন্তরে সুস্পষ্ট কোনো মেহরাব নেই এবং নামাজের জন্য রয়েছে ২টি কাতার বা দুই লাইনে বসার সুযোগ।

মির্জাপুর মসজিদের মূল ভবনের সামনে রয়েছে একটি আয়তাকার পাকা অঙ্গন। অঙ্গনের উপরিভাগ উন্মুক্ত। অঙ্গনের বাইরে রয়েছে একটি সুদৃশ্য পাকা তোরণ ৷ তোরণটির নির্মাণ কৌশল অপূর্ব। খোলা জায়গার এক পাশে সুসজ্জিত পাকা তোরণ এবং তোরণের উভয় পাশে রয়েছে আকর্ষণীয় নকশা ও খাজ করা স্তম্ভ। স্তম্ভের মধ্যে চ্যাপ্টা গম্বুজ তোরণকে অনিন্দ্য রূপ দিয়েছে। চত্বরের একপাশে রয়েছে প্রাচীন আমলের একটি অব্যবহৃত কূপ, অন্য পাশে কয়েকটি কবর। মসজিদের তোরণের সামনের দিকে ঘাট বাঁধানো একটি সুবিশার পুকুর এবং মসজিদটির পাশেই রয়েছে একটি নূরানি মাদ্রাসা। পুকুরের পানি ওযুর কাজে ব্যবহার করা হয়।

ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আটোয়ারী উপজেলা প্রশাসন দ্বারা পরিচালিত এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মির্জাপুর শাহী মসজিদের তত্ত্বাবধান ও রক্ষনাবেক্ষন করে আসছে।

মির্জাপুর শাহী মসজিদের কাছাকাছি রয়েছে আরো একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা যা আটোয়ারী ইমামবাড়া (মির্জাপুর ইমামবাড়া বা হোসেনী দালান) নামে পরিচিত। ইটের তৈরি ইমামবাড়ার ভেতরটি গোলাকার এবং এর ভিতরে একটি কক্ষ রয়েছে। ইমামবাড়া এর প্রবেশপথে একটি তোরণ এবং সম্মুখভাগে ৫টি বাঁধানো কবর রয়েছে। সমগ্র ইমামবাড়া নিচু প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। স্থানীয়রা জানান, ইমামবাড়ার ভেতরের কক্ষে মুসলমানদের ধর্মীয় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা হতো। তবে বর্তমানে (২০২৪) আটোয়ারী ইমামবাড়া জরাজীর্ণ ও অসংরক্ষিত হিসেবে পড়ে রয়েছে।

নির্মানকালঃ ইতিহাসবিদগণের অভিমতে, মোগল আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় মির্জাপুর শাহী মসজিদ। মির্জাপুর গ্রামের মির্জা বংশীয় উত্তরসূরীগণের মতে, মির্জাপুর গ্রামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পূর্বপুরুষ ফুল মোহাম্মদ এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ফুল মোহাম্মদ-এর মৃত্যু হলে তাঁর সহোদর দোস্ত মোহাম্মদ মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ করেন।

মসজিদের মধ্যবর্তী দরজার উপরিভাগে পারস্য ভাষায় তোগরাই পদ্ধতিতে উৎকীর্ণ করা অস্পষ্ট একটি ফলক রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ফলকের ভাষা ও লিপি থেকে ধারণা করেন,মোগল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে সম্ভবত ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানি বা ফারসি কারিগর দ্বারা এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। উল্লেখিত ফলকটিতে উৎকীর্ণ সনটি পারস্য বৎসর-এর এবং লক্ষণীয় বিষয় এই যে, সমসাময়িককালে বাংলাদেশের অন্যান্য মসজিদ বা ইমারতের সন/তারিখ হিজরী অথবা খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী উৎকীর্ণ থাকলেও মির্জাপুর মসজিদে পারস্য বছরের উল্লেখ থাকায় ধারণা করা যায়,যে সকল কারিগর ও স্থপতি এই মসজিদের নির্মাণ, মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা ছিলেন পারস্য অর্থাৎ ইরানের অধিবাসী। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ঢাকা হাইকোর্ট সংলগ্ন মসজিদের সঙ্গে মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণশৈলীর সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়।

প্রায় ২০০ বছর আগে প্রবল ভূমিকম্পে মির্জাপুর শাহী মসজিদ ভয়াবহরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হলে মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা জনাব মুলুকউদ্দিন বা মালেকউদ্দিন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি মসজিদের ইমামের সহায়তায় ইরান থেকে কারিগর এনে মসজিদের মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ সম্পন্ন করেন।

অবস্থানঃ মির্জাপুর শাহী মসজিদ পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর নামক গ্রামে অবস্থিত।

কিভাবে যাবেনঃ পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে সড়কপথে মির্জাপুর শাহী মসজিদের দূরত্ব ১৮ কিমি। পঞ্চগড় সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড হতে পঞ্চগড়-আটোয়ারী রুটে লোকাল বাসে আটোয়ারি উপজেলার মির্জাপুর বাজার স্টপেজ। আটোয়ারী থেকে বাসযোগে মির্জাপুর বাজার ৬ কিমি। মির্জাপুর বাজার থেকে পূর্ব দিকে রাস্তায় গ্রামের ভিতরের দিকে রিক্সা বা ভ্যানযোগে ১ কিমি গেলেই চোখে পড়বে রাস্তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মির্জাপুর শাহী মসজিদ তোরণ। Travel Tips | Accommodation | Tourist Spots

 


তথ্যসূত্রঃ ড. নাজমুল হক । পঞ্চগড় : ইতিহাস ও লোকঐতিহ্য
Last updated: 24 January 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn