ইতিহাস ও ঐতিহ্য - History & Heritage

পঞ্চ (পাঁচ) গড়ের সমাহার পঞ্চগড় নামটির অপভ্রমংশ পঁচাগড় দীর্ঘকাল এই জনপদে প্রচলিত ছিল। পঞ্চগড় নামকরণ সমন্ধে কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে, এ অঞ্চলটি অতি প্রাচীনকালে পুন্ডুনগর রাজ্যের অর্ন্তগত পঞ্চনগরী’ নামে একটি অঞ্চল ছিল। কালক্রমে পঞ্চনগরী ‘পঞ্চগড়’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু এই অঞ্চলের নাম যে, পঞ্চগড়ই ছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। ভারতীয় উপমহাদেশে পঞ্চ শব্দটি বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে। যেমনঃ পঞ্চনদ, পঞ্চবটি, পঞ্চনগরী পঞ্চগৌড় ইত্যাদি। সুতরাং পঞ্চগৌড়ের একটি অংশ হিসেবে প্রাকৃত ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পঞ্চগড়ের নামকরনের সম্ভাবনা থেকে যায়। অর্থ্যাৎ পঞ্চগৌড় > পঞ্চগোড় > পঞ্চগড়। অবশ্য বহুল প্রচলিত বিষয় মতে এই অঞ্চলের পাঁচটি গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি। গড়গুলো হলোঃ (১) ভিতরগড়, (২) মিরগড়, (৩) রাজনগড়, (৪) হোসেনগড় এবং (৫) দেবনগড়। 

আবার কিছুটা ভিন্ন মতে পঞ্চ শব্দের অর্থ পাঁচ, আর গড় শব্দের অর্থ বন বা জঙ্গল। সেই সূত্র মতে পাঁচটি গড়ের সমষ্টি হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে পঞ্চগড়। এটা বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্যি যে, দেশ ভাগ হবার আগ পর্যন্তও এই অঞ্চলটি ছিল জনমানুষ বিরল একটি বড় বন-জঙ্গল পূর্ণ এলাকা। সে জঙ্গলে বন্য হাতী, অসংখ্যা প্রাজাতির পাখিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রানীর বাঘ পর্যন্ত ছিল। তবে মানুষের সংখ্যা বারার সাথে সাথে পরিবর্তনও এসেছে অনেক দ্রুত। এখণকার দিনে ওই ধরনের বন্যভুমি দেখতে পাওয়া একেবারেই বাহুল্য বলা যায়।

(১) ভিতরগড়ঃ পঞ্চগড় শহর থেকে দশ মাইল উত্তরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর ভিতরগড় -এর অবস্থান। প্রাচীনকালে উত্তরবঙ্গে যেসব রাজ্য এবং দূর্গনগরী ছিল বলে জানা যায় ভিতরগড় সেগুলোর অন্যতম এবং বাংলাদেশের মধ্যে আয়তনের দিক থেকে সর্ববৃহৎ। প্রায় ১২ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে এই বিশাল গড় ও নগরীর অবস্থান। ভিতরগড় দূর্গ নির্মাণের সঙ্গে জনশ্রুতি ও প্রাচীন ঐতিহাসিক সুত্র অনুযায়ী কামরূপের শুদ্রবংশীয় রাজা দেবেশ্বরের বংশজাত পৃথু রাজার নাম সম্পৃক্ত ৷ যতদূর সম্ভব সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় (ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে) পৃথু রাজার অভ্যুদয় ঘটে। তিনি কামরূপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড় এলাকার আগমন করেন; নির্মাণ করেন গড় এবং স্থাপন করেন রাজ্য। অপরসূত্র অনুযায়ী, নবম বা দশম শতাব্দীতে কম্বোজ বা তিব্বতীয়গণের আক্রমণ থেকে উত্তরবঙ্গ রক্ষার জন্য পালবংশীয় রাজাগণ ভিতরগড় দূর্গটি নির্মাণ করেন৷ এখানে যে বড় পুকুরটি রয়েছে সেটি মহারাজার দীঘি নামে পরিচিত ৷ মহারাজার দীঘি থেকে প্রায় ৪০০ গজ দূরের ইটের প্রাচীরঘেরা নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাজবাড়ী ছিল বলে ধারণা করা হয় । স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, পৃথু রাজা কিচক নামে অসাধু ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হলে নিজ পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষার্থে পরিবার পরিজনসহ দীঘির জলে আত্মহত্যা করেন ৷ তাঁর রক্ষীবাহিনীও তাকে অনুসরণ করে ৷ এর ফলে পৃথু রাজার রাজত্বের অবসান ঘটে। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শন সমূহের আলোকে অনুমান করা যায় যে, ষষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের উপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, কোচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল ।

(২) মিরগড়ঃ পঞ্চগড় শহর থেকে দুই কিমি পশ্চিমে করতোয়া নদীর তীরে মীরগড়ের অবস্থান ৷ এই গড়ের ইতিহাস ও এতিহ্যের সাথে মোঘল সুবেদার মীর জুমলা, তাঁর ভাই দানিয়েল, মীর খয়র উদ্দিন, মীর সরফরাজ খাঁ প্রমুখের নাম জড়িত ৷ ঐতিহাসিকদের মতে, এখান থেকে গৌড় রাজ্যের রাজধানী এবং উত্তর ভারত তথা দিল্লীর সাথে যোগাযোগ করা ছিল সহজতর ৷ এছাড়া নদীপথে কোচবিহার এবং কামরূপ কামতা রাজ্যে অভিযান পরিচালনা বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা সহ সামরিক গুরুত্বের কারণে মুসলিম আমলে মিরগড় দুর্গটি নিমার্ণ করা হতে পারে। সুলতান হোসেন শাহের সেনাপতি মীর সরফরাজ খাঁ এবং মীর খয়র উদ্দিনের এই দুর্গে অবস্থান এবং গড় সংলগ্ন এলাকায় তাঁদের সমাধিস্থল রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া এখানে একটি সুড়ঙ্গপথ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে লোকমুখে কিংবদন্তী জানা যায় । বর্তমানে (২০২৪) গড়টির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়না ৷ সম্ভবত করতোয়া নদীতেই গড়টির বিলুপ্তি ঘটেছে । সাম্প্রতিক সময়ে মীরগড় তাঁত শিল্পের কারণে সুপরিচিত লাভ করেছে।

(৩) রাজনগড়ঃ পঞ্চগড় শহর “গড়ের ডাঙ্গা” নামক বর্গাকৃতির প্রাচীন জনপদটিই মূলত রাজনগড় নামে পরিচিত ৷ রাজনগড়-এর আয়তন প্রায় এক বর্গমাইল ৷ গড়টি কোন রাজা বা মহারাজা ঠিক কোন সময়ে নিমার্ণ করেছিলেন, এতিহাসিক ভাবে তার প্রামান্য কোনো দলিল পাওয়া যায়না। তবে পাশ্বর্তী কোচবিহারের রাজাগণ সপ্তদশ শতকের দিকে পঞ্চগড় অঞ্চল শাসনকালে বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবেলায় এই গড়ুটি নিমার্ণ করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত মহারাজা নরনারায়ণ স্বয়ং এই গড়ে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন বলেই পরবর্তীকালে লোকমুখে স্থানটির নামকরণ হয়ে যায় রাজনগড় ৷ গড়টিতে ইমারতের কোনো ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত না হলেও ইট এবং মাটির তৈরী ভগ্নাবশেষ দেখা যায় । মোঘল সেনাদলের সাথে যুদ্ধে এই গড়ের পতন ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

(৪) হোসেনগড়ঃ পঞ্চগড় শহর থেকে আট মাইল উত্তর-পশ্চিমে এবং করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত জুড়ে হোসেনগড় এর অবস্থান । হোসেনগড়-এর আয়তন প্রায় দুই বর্গ কিমি ৷ সুলতান হোসেন শাহের নামকরণ থেকে এই গড়ের নাম হোসেনগড় হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। এর পাশেই একটি সুবিশাল দীঘি ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এই গড় ও দীঘির উত্তর পূর্ব কোণ থেকে বহির্গত যে সড়কটি পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে জলপাইগুড়ি এবং মধ্যযুগের কামতা রাজ্য অভিমুখে সম্প্রসারিত হয়েছে, হোসেন শাহ সেই সড়ক দিয়ে কামতা রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন ৷ অনুমান করা হয়, পরবর্তীকালে তিনি রাজধানী গৌড়ে অবস্থান করলেও এই দূর্গে তাঁর প্রতিনিধি বা সেন্যসামস্ত অবস্থান করেছিলেন। বর্তমানে (২০২৪) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হোসেনগড়-এর তেমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়না।

(৫) দেবনগড়ঃ পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা জনপদটিই মূলত দেবনগড় বা দেবনগর নামে পরিচিত ৷ ইতিহাসখ্যাত দেবী চৌধুরানী এই গড়ের অদূরে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন ৷ করতোয়া নদীতে যাতায়াত কালে তিনি দেবনগড়ে কিছুদিন অবস্থানও করেছিলেন ৷ জনশ্রুতি মতে, দেবী চৌধুরানী থেকেই দেবনগড় নামটি হয়েছে ৷ এছাড়া ভুটানের দেবরাজার শাসনও দেবনগড়ে প্রতিষ্ঠত হতে পারে ৷ সেইসূত্রেও দেবনগড় বা দেবনগর নামটি প্রচলিত হতে পারে৷ অন্য একটি সূত্রমতে, কামতা রাজ্যের পরগণা বোদা এলাকার দেবনগর নামক স্থানে দশম শতাব্দীতে খেনবংশীয় রাজা নীলধ্বজ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে দেবত্ব আরোপ করেও দেবনগর নামের উৎপত্তি যুক্তিযুক্ত। আসলে গড়ুটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা এটি ঠিক কোথায় অবস্থিত সেই বিষয়টি আজও রহস্যাবৃত ৷ দেবনগরকে গড় বা দূর্গ বলা হলেও বর্তমানে গড়ের কোন চিহ্ন কোথাও পরিদৃষ্ট হয়না ৷ গড় থাকুক বা না থাকুক, জনপদটি যে প্রাচীন এবং উল্লেখযোগ্য এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

পঞ্চগড় একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন ও মধ্য যুগে এই ভূখন্ডের পাশেই ছিল মগধ, মিথিলা, গৌর, নেপাল, ভূটান, সিকিম ও আসাম রাজ্যের সীমান্ত। আধুনিককালের মত অতীত কালেও জনপদটি ছিল সীমান্ত অঞ্চল। এই ভূখন্ডটি পর্যায়ক্রমে শাসিত হয়েছে প্রাগ- জ্যোতিষ, কামরূপ, কামতা, কুচবিহার ও গৌর রাজ্যের রাজা, বাদশা, সুবাদার এবং বৈকুন্ঠপুর অঙ্গ- রাজ্যের দেশীয় রাজা ও ভূ-স্বামীদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। খ্রীস্টীয় ২য়, ৩য় শতকের মধ্যে রাজা ‘শালিবাহন’ রাজা ‘পৃথু’ এবং রাজা ‘জল্লেশ’ পঞ্চগড়ের শালবাহান ও ভিতরগড় এলাকায় রাজ্য, নগর ও সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তুলেছিলেন। মৌর্য, গুপ্ত ও পাল (দেবপাল ধর্মপাল) রাজন্যবর্গও এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন।

মধ্যযুগের শুরুতেই প্রথম মুসলিম বঙ্গবিজীয় সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন খলজি তাঁর বহু বিতর্কিত তিববত অভিযানের এক পর্যায়ে পঞ্চগড় জনপদের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন বলে জানা যায়। সুলতান হোসেন শাহ এবং কামতার রাজা নীলধ্বজ তেঁতুলিয়া থানার দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে কোন কোন ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেন। সুলতান জালাল উদ্দিন ফাতেশাহ, সুলতান বারবক শাহ, শেরশাহ, খুররম খাঁ (শাহজাহান), মীরজুমলা, সুবাদার ইব্রাহীম খাঁ ফতে জঙ্গ এবং অন্ত মধ্যযুগে দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক, ফকির মজনুশাহ প্রভৃতি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পঞ্চগড় জনপদের নাম ও স্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। ষোড়শ শতকে কুচবিহার রাজ্য গঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় অঞ্চল মূলত কোচ রাজন্যবর্গের দ্বারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পঞ্চগড় থানাটি দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অর্ন্তভূক্ত হয়। ১৯৮০ সালে ১লা জানুয়ারী ঠাকুরগাঁও মহকুমার ৫টি থানা তেতুলিয়া, পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী, বোদা ও দেবীগঞ্জ নিয়ে পঞ্চগড় মহকুমা সৃষ্টি হয়। মহকুমার সদর দপ্তর পঞ্চগড় থানায় স্থাপিত হয়। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব সৈয়দ আব্দুর রশিদ (০১-০১-১৯৮০ থেকে ৩১-১২-১৯৮২)। ১৯৮৪ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী পঞ্চগড় মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। পঞ্চগড় জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনাব আ.স.ম. আব্দুল হালিম (০১-০২-১৯৮৪ থেকে ১৬-০৬-১৯৮৫)।


তথ্যসূত্রঃ ফয়জুল হাসান শাওন | ড. মো. হাবিবুর রহমান
Last updated: 25 April 2024

Leave a Reply

Today's Weather

Recent News

Facebook Page