পাথর উত্তোলন – Stone Quarry

পঞ্চগড়ের প্রধান খনিজ সম্পদ ভূগর্ভস্থ পাথর। প্রতি বছর এখান থেকে হাজার হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করা হয়। সারা দেশের প্রয়োজনীয় সিংহভাগ পাথর পঞ্চগড় থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। এই পাথর দিয়ে নির্মিত হয় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট।

সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে প্রবাহমান ছোট বড় প্রায় ৪৮টি নদী। প্রতি বছর বন্যায় এই নদীগুলো বয়ে নিয়ে আসে বিপুল পরিমান ছোট ও মাঝারি আকৃতির পাথর, যা সারফেস ডিপোজিট হিসেবে জমা হয়ে মাটির নীচে পাওয়া যায়। পঞ্চগড়ে সামগ্রিকভাবে ৫০-৬০ বছর ধরে কয়েক হাজার পাথরশ্রমিক পাথর উত্তোলন করে আসছেন। শুরু থেকে স্থানীয় পাথর শ্রমিকরা নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করলেও সাম্প্রতিককালে সমতল ভূমি খুঁড়ে ব্যাপকহারে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। পঞ্চগড় থেকে প্রতিদিন ২০০-৩০০ ট্রাক পাথর রফতানি হয়।

পাথর উত্তোলনের স্থলঃ সমগ্র পঞ্চগড় যেন পাথরের খনি। এখানে মাটির নিচে প্রাকৃতিকভাবে পাথরের সন্ধান মেলে। পঞ্চগড়ের উল্লেখযোগ্য নদীসমূহের তলদেশে কিংবা সমতল ভূমি খনন করলেই পাওয়া যায় পাথর। পঞ্চগড়ে নদী-নালা, খাল-বিল এবং সমতল ভূমি, আবাদি জমি যেখানেই খোঁড়াখুঁড়ি, সেখানেই পাথর। কোথাও কম, কোথাও বেশি।

পঞ্চগড়ে মূলত মহানন্দা, করতোয়া, তালমা, তিরনই, ডাহুকসহ বিভিন্ন নদীতে পাথর উত্তোলন করা হয়। এসব নদীর উৎস ভারত। মহানন্দা নদী আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলাবান্ধা থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দু’দেশের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত। এই নদীর এপারে তেঁতুলিয়া, ওপারে ভারতের হাতিয়া গছ ও শিলিগুড়ি। একটু দূরেই ভারতের রেলস্টেশন ও বাগডোগরা বিমানবন্দর। ফুলবাড়িতে রয়েছে সুইচ গেট। ভারতীয় কর্তৃপহ্ম কখনো সুইচ গেট বন্ধ রাখে আবার কখনো খুলে দেন। খুলে দিলেই পানির স্রোতে বিভিন্ন আকৃতির প্রচুর নুড়ি পাথর ভেসে আসে।

তেঁতুলিয়া উপজেলার হারা দীঘি, রওশপুর, ভজনপুর খনিয়াগছ, শালবাহান, বালাবাড়ি, কাটা পাড়া, ভোয়াল গছ, নয়া বাড়ি, খুনিয়া গছ, কীর্তন পাড়া, ভদ্রেশর, কারু গছ, কাটি গছ, শুরী গছসহ বিভিন্ন গ্রামে আবাদি জমিতে বিভিন্নভাবে পাথর উত্তোলন করা হয়।

বছর ঘুরে আবাদি জমি থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়। নদীতে যখন পানি কম থাকে, তখনই শুরু হয় উত্তোলনের মওসুম। বর্ষা মওসুমে পানি বেশি থাকায় পাথর উত্তোলনে সমস্যা হয়। শ্রমিকরা কনকনে শীতে, বৃষ্টিতে কিংবা গরমে পাথর উত্তোলন করে।

পাথর শ্রমিকঃ যারা সমতল ভূমি খনন করে পাথর উত্তোলন ও নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করেন তাঁরাই পাথর শ্রমিক। ‘পাথরেই তাঁদের জীবন, পাথরেই তাঁদের প্রাণ।’ তাঁরা কেউবা ২০ বছর ধরে আবার কেউ ১৫ বছর ধরে পাথর তুলে আসছেন। কেউবা সপ্তাহে ৭ দিন আবার কেউ ৪ দিন পাথর তোলার কাজ করেন। পুরুষ শ্রমিকেরা নদী বা মাটি খনন করে পাথর তোলেন। অপর দিকে, নারীশ্রমিকেরা পাথর বাছাই, ভাঙা, চালনা, ভেঙে সাইজ করার কাজ করে থাকেন।

জীবিকার তাগিদে প্রকৃতির সব প্রতিকূলতাকে সঙ্গী পাথর তোলার কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন শ্রমিকেরা। পাথরই তাদের অর্থের জোগানদাতা। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এ পেশায় জড়িত। বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া সদর পর্যন্ত গ্রামের প্রায় সব পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য পাথর সংগ্রহের কাজে জড়িত। এটা তাদের পারিবারিক পেশা বা ঐতিহ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। কেউ পাথর তুলছেন। আবার কেউ নদীরঘাট থেকে সে পাথর কিনে এনে মেশিনের কাছে দিচ্ছেন। কেউবা মেশিন চালিয়ে রোজগার করছেন, আবার কেউ ট্রাকে পাথর লোড-আনলোড করছেন। অনেকে আবার কারবারিদের কাছে পাথর সরবরাহ করছেন। এই করেই চলছে দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ তেতুঁলিয়ার মানুষের জীবন। রংপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলার অভাবী ও নদীভাঙা লোকজন তেঁতুলিয়ায় বাস করছেন। তাদের নিজের জায়গা জমি নাই। ’৮০-এর দশক থেকে এসব মানুষ মহানন্দা নদী ও বিভিন্ন জায়গায় মাটি খনন করে পাথর তুলে সংসার চালায়।

নদী থেকে পাথর সংগ্রহের পদ্ধতিঃ ভোর হতেই পাথর শ্রমিকরা টায়ারের টিউব, কোদাল, শিক, ও চট বা প্লাস্টিকের বস্তা নিয়ে দলে দলে নদীতে আসেন। প্রথমে লোহার শিক দিয়ে পানির নিচে খুঁচিয়ে দেখা হয় পাথর আছে কি না, থাকলে কোদাল তিয়ে পাথর তোলা হয়। টিউবের মাঝখানে রশি দিয়ে বেঁধে চট বা প্লাস্টিকের ছালা বিছিয়ে তাতে পাথর রাখেন। ভেতরে বাতাস থাকায় টিউব নদীর পানিতে ভাসতে থাকে। পাথরের পরিমাণ বাড়তে থাকলে সেগুলো তীরের শুকনা জায়গায় রাখেন, এভাবে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এসব যন্ত্রপাতি তাদের নিজেদের বা মহাজনের কাছ থেকে আনা। পাথর বিক্রি করে অনেকে আবার মহাজনকে যন্ত্রপাতির টাকা শোধ করে দেন। একজন শ্রমিক দুই সপ্তাহে কমবেশি এক ট্রলি পাথরে তুলতে পারেন। প্রতিটি ট্রলির ধারণ ক্ষমতা ১০০ সিএফটি (ঘনফুট) বা তার কিছু বেশি পাথর।

জমি থেকে পাথর সংগ্রহের পদ্ধতিঃ নদী থেকে পাথর উত্তোলনে কোনো মাটি কাটার প্রয়োজন পড়ে না। সমতল ভূমি থেকে পাথর উত্তোলনে শ্রমিকদের যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। প্রথমে টাকার বিনিময়ে মাটির নিচে থাকা পাথর কিনে নিতে হয়। তারপর, ৫-৭ ফুট মাটি খনন করে পাথর বের করতে হয়। এ গভীরতা কোথাও ৩০ ফুট আবার কোথাও ৭০ ফুটও হয়। কোথাও ১০-১২ ফুট পাথরের গভীরতা রয়েছে। এসব পাথর উত্তোলনে শ্যালোমেশিনে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। শ্রমিকেরা পাঁচ-সাতজন মিলে দল বেঁধে পাথর উত্তোলন করেন। প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা পাথর তুলে ৪০০-৫০০ টাকা আয় করেন।

পাথর বিক্রয়ঃ পাথরশ্রমিকেরা যে পাথর উত্তোলন করেন তা ফড়িয়া পাইকারের কাছে বিক্রি করেন। বিক্রয় মূল্য (২০২২ সাল) গড়ে প্রতি সিএফটি পাথর ২৩ থেকে ২৫ টাকা। তারপর সেসব পাথর মহিলা শ্রমিক দিয়ে বাছাই করেন। বড় বড় বোল্ডার পাথর মেশিনের সাহায্যে ভাঙা, সাইজ ও বাছাই করে নেন। বিভিন্ন সাইজের পাথর বড় মহাজনের কাছে বিভিন্ন দামে বিক্রি করেন। ছোট বড় পাথর ভাঙা বা সাইজ করার মতো কয়েক হাজার মেশিন রয়েছে। এগুলোতে নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর শ্রমিক কাজ করেন। পঞ্চগড়ে পাথর বিক্রির বাজার সবখানে। বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া হয়ে পঞ্চগড়। বিরাট জনপদের সাথে বাংলাবান্ধা, খয়খেটপাড়া, তিরনই, সিপাইপাড়া, রণচণ্ডি, বুড়াবুড়ি, ভজনপুর, শালবাহান, মাগুড়মারি, জগদল, গোয়ালঝাড়, দেবনগর, পঞ্চগড় প্রভৃতি বাজারে পাথর বিক্রি হয়ে থাকে।

পঞ্চগড়ের অর্থনীতি ও পরিবেশঃ ‘পঞ্চগড়ের পাথর’ পঞ্চগড়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সিঁড়ি হিসেবে হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পঞ্চগড়ের পাথর উত্তোলন এবং এর সরবরাহ বাণিজ্যিক আকার ধারণ করে যমুনা সেতু নির্মাণ পরবর্তী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চা বাগান, চা ফেক্টরি, জেমকন, জেমজুট ও অন্যান্য বেবসা প্রতিষ্টা হওয়ার কারণে। সাম্প্রতিককালে বাণিজ্যিকভাবে মহানন্দা, করতোয়া, ডাহুক, তালমা চাওয়াইসহ বিভিন্ন নদী থেকে বালু ব্যাপকহারে উত্তোলন করা হচ্ছে।

তবে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার পাথর বিক্রয় হলেও সরকার এ থেকে কোন রাজস্বও পাচ্ছে না। শুধুমাত্র নদীর পাথর মহাল ইজারা থেকে সরকার রাজস্ব আয় করছে। নদীর পাথরের ইজারা নিয়ে রাস্তায় বাঁশকল বসিয়ে পাথর বোঝাই সব ট্রাক থেকে ইজারা সত্ব আদায় করছে পাথর বালি ব্যবসায়ী যৌথ ফেডারেশন। ভূগর্ভস্থ এই পাথর উত্তোলনের জন্য নীতিমালা নেই। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ী অবাধে পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে। পরিবেশবিদেরা মনেপ্রাণে চান পাথর উত্তোলনে থাকুক রাষ্ট্রের নজরদারি। আদায় হোক রাজস্ব।

বোদা পাথরাজ ডিগ্রী কলেজের ভুগোল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও পরিবেশবিদ মো. আলতাফ হোসেন জানান, ১৮৬৭ সালে এ এলাকায় ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এ ভূমিকম্পের ফলে এ অঞ্চলে উষ্ণ উস্রবণ দেখা দিয়েছিল। ফলে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছিল। সেই সময় এই অঞ্চলের একটি বনভূমি যা ‘বেলুয়া বনভূমি’ নামে পরিচিত ছিল তা আজ স¤পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানেও এই অঞ্চলে মাটির ৮-১০ ফুট নিচে উক্ত বনভূমির ধবংশাবশেষ বা গাছের বিভিন্ন অংশ পাওয়া যায় যা স্থানীয় ভাষায় ‘পানিশাল’ নামে পরিচিত। তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে বর্তমানে যে হারে অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে করে আগামীতে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ১৮৬৭ সালের ভূমিকম্পের চেয়ে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

পঞ্চগড়ের সমতল ভূমি থেকে অবাধে তোলা হচ্ছে পাথর। পাথর তোলার কারণে ভূমিধস ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি। হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। আশঙ্কা করা হচ্ছে ভূমিধসের। …আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের শিল্প ও বাণিজ্য | পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ

 


তথ্যসূত্রঃ হায়দার আলী | এস. এ. মাহমুদ সেলিম
Last updated: 3 November 2023

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

পাথর উত্তোলন – Stone Quarry