বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর – Banglabandha Land Port

পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায় অবস্থিত বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর বাংলাদেশের একমাত্র চতুদের্শীয় স্থলবন্দর। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান এই ৪ টি দেশকে সড়কপথে সংযুক্ত করার কারণে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরকে বলা হয় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার। চীনের সাথে স্থল বাণিজ্য শুরু হলে বাংলাবান্ধা বন্দর ৫টি বন্ধু-প্রতিম দেশকে একই সূত্রে আবদ্ধ করতে পারবে। অবস্থান, পণ্য আমদানি-রপ্তানি, ইমিগ্রেশন সেবা এবং পর্যটকদের ব্যাপক সমাগমের কারণে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত এক দশকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি, আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য ও যাত্রী চলাচল বেড়েছে কয়েকগুন।

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয় উত্তরের এই দ্বার। নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার্থে ১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাবান্ধা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে এবং ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে এই বন্দরে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৬ সালে চালু করা হয় ইমিগ্রেশন সেবা।

বন্দরের অবস্থানঃ বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে জিরো (0) পয়েন্ট-এ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের অবস্থান। এই স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ি স্থলবন্দর অবস্থিত। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ২৬.৬২৯৫° উত্তর ৮৮.৪১২৬° পূর্ব।

বাংলাবান্ধার প্রধান সুবিধা হলো এই বন্দরটি চারটি দেশকে সংযুক্ত করেছে। ভৌগলিকভাবে বাংলাবান্ধা ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর, শিলিগুড়ি, জলপাইগুঁড়ি জেলার ভেতরেই যেন তেঁতুলিয়া উপজেলার অবস্থান। তেঁতুলিয়ার চারপাশে রয়েছে ভারতের স্থানীয় বিধান-নগর, চাত্তের হাট, ঘোসপুর, রাহমু, ফুলবাড়ি ও আমবাড়িয়া। বাংলাদেশের ও ভারতের মধ্যে যতগুলো স্থলবন্দর চালু রয়েছে তার মধ্যে বাংলাবান্ধা অবস্থান সবচেয়ে সুবিধাজনক। এখান থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ৭ কিমি, শিলিগুড়ি ১৬ কিমি, নেপাল সীমান্ত ৫৪ কিমি, ভুটান ৬৮ কিমিচীন সীমান্ত মাত্র ২০০ কিমি দূরে অবস্থিত। বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাঁকরভিটা ট্রানজিট পয়েন্টের দুরত্ব ৬১ কিমি। অন্যদিকে এই স্থলবন্দর থেকে বাংলাদেশের উপজেলা শহর তেঁতুলিয়া দূরত্ব মাত্র ১৮ কিমি। পঞ্চগড় জেলা শহরের দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিমি এবং রাজধানী ঢাকা হতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের দূরত্ব ৪৯৫ কিমি।

যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের পার্শ্ববর্তী ভারতের শিলিগুড়ির মতো সমৃদ্ধ শহর অন্যান্য স্থলবন্দরের কাছে নেই। সড়কপথে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর অতিক্রম করেছে এশিয়ান হাইওয়ে-২। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর বাংলাবান্ধার সাথে সরাসরি সড়কপথে সংযুক্ত। বাংলাবান্ধার মাধ্যমে নেপাল, ভুটান এবং ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ এসব দেশকে বেবসাবাণিজ্যে সাবলম্বী এবং বাংলাদেশের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। রেলপথে ফুলবাড়ি স্থলবন্দর ভারত-এর জলপাইগুড়ি জেলার নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১০ কিমি দূরে অবস্থিত। আকাশপথে ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক করিডোর হচ্ছে দার্জিলিং জেলার বাগডোগরা বিমানবন্দর যা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে মাএ ১৬ কিমি দূরে। বাংলাবান্ধা থেকে সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট-এর দূরত্ব ১০০ কিমি।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরকে রেলপথে সংযোগ করার জন্য পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা রেলপথ বর্তমানে (২০২৪) নির্মাণাধীন। চতুর্দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা সম্বলিত বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পর্যন্ত রেললাইন চালু হলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ বহুমাত্রিক সফলতা অর্জন সম্ভব হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেলপথে স্বল্প সময়ে যাওয়া যাবে চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে। বাংলাবান্ধা থেকে ঢাকা আসতে যে সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে তার অর্ধেক সময়ে চীনে পৌঁছে দেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ভারতে যেতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট আর নেপাল ও ভুটানে যেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। Travel Tips | Accommodation

পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাঃ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বাংলাবান্ধা ল্যান্ড পোর্ট লিংক লিমিটেড। ২৫ বছরের জন্য এ স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনার নিমিত্তে ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারিতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে বেসরকারী পোর্ট অপারেটরের মধ্যে Concession Agreement (CA) স্বাক্ষরিত হয়। CA অনুযায়ী পোর্ট অপারেটর ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারী থেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের কমার্শিয়াল অপারেশন শুরু করে।

অবকাঠামোঃ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের মহানন্দা নদীর তীরে ও ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ১০.৪৮২২ একর জমিতে স্থাপিত। বর্তমানে এখানে পণ্য ধারণ ক্ষমতাঃ ৫০০ মে.টন। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে রয়েছে ১ টি ওয়্যারহাউস, ১ টি (৪৮৮০০ বর্গফুট) ওপেন স্ট্যাক ইয়ার্ড, ১ টি ট্রাক টার্মিনাল, ২ টি ওয়েব্রিজ স্কেল, ১ টি স্ট্যান্ডবাই পাওয়ার জেনারেটর, ১ টি প্রশাসনিক ভবন, ১ টি ডরমেটরী, ১ টি ব্যারাক হাউস, ১ টি কাস্টমস গোডাউন, ১ টি টয়লেট কমপ্লেক্স, সিকিউরিটি পোস্ট, অবসারভেশন টাওয়ার, সীমান্ত প্রাচীরসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। 

বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কমার্সিয়াল ব্যাঙ্ক, ATM, মানিট্রান্সফার এবং আধুনিক আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে। বর্তমানে (২০২৪) নির্মাণাধীন পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা রেলপথের বাংলাবান্ধা স্টেশনের পাশে আধুনিক শপিং মল তৈরি প্রক্রিয়াধীন। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের পণ্য ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্থান স্বল্পতার সমাধান ও বন্দরের আয়তন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বন্দর এলাকার ১৬.৪৪২ একর জমি অধিগ্রহন প্রকৃয়াধীন রয়েছে। অধিগ্রহন শেষ হলে বাংলাবান্ধা বন্দরের আয়তন ২৭ একরে পরিণত হবে।

আমদানি-রপ্তানি বাংলাবান্ধা স্থলবন্দ দিয়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় পাথর। আর বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সামগ্রীসহ পাট, জুট, গ্লাস, ওষুধ সবচেয়ে বেশি রফতানি করা হয়। আমদানিকৃত বেশির ভাগ পণ্য আসে নেপাল থেকে। বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন গড়ে একহাজার মেট্রিক টন পাথর ও নেপাল থেকে গড়ে প্রতিদিন ১০০ মে. টন ডাল আসে।

আমদানিযোগ্য পণ্য রপ্তানিযোগ্য পণ্য
[ক] ন্যাশনাল বোর্ড রেভিনিউ-এর নোটিফিকেশন নং ৩৪৬/ডি/কাস/৭৭, তারিখঃ ২৪/৫/১৯৭৭ এ বর্ণিত শর্তাদি সাপেক্ষে ভুটানে উৎপাদিত ও প্রক্রিয়াজাত সকল পণ্য (সুতা ও আলু ব্যতীত) এবং নেপালে উৎপাদিত ও প্রক্রিয়াজাত সকল পণ্য ও বন্ডেড প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানিকৃত এক্রাইলিক সুতা (অন্যান্য সুতা ও আলু ব্যতীত)।

[খ] ভারত থেকে ডুপ্লেক্স বোর্ড, নিউজপ্রিন্ট, ক্রাফট পেপার, সিগারেট পেপারসহ সকল প্রকার পেপার ও পেপার বোর্ড, মাছ, সুতা, আলু (HC Code 0701.90.19 ও 0701.90.29), গুঁড়া দুধ, জুস, টোব্যাকো (প্রঠিষ্টিত মূসক নিবন্ধিত বিড়ি উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কাঁচামাল হিসাবে আমদানীয় তামাক ডাঁটা ব্যতীত), রেডিও-টিভি পার্টস, সাইকেল পার্টস, মোটর পার্টস, ফরমিকা শীট, সিরামিক ওয়্যার, স্যানিটারী ওয়্যার, স্টেইনলেস স্টিলওয়্যার, মার্বেল স্ল্যাব এন্ড টাইলস, মিক্সড ফেব্রিক্স ব্যতীত অন্যান্য সকল প্রকার আমদানিতব্য মালামাল/পণ্য।

সকল প্রকার রপ্তানিযোগ্য পণ্য।

ভারত থেকে মূলত পাথর এবং নেপাল থেকে মসুর ডালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ভারতে রফতানি করা হয় টাঙ্গাইল শাড়ী, ফার্নিচার, কোমল পানীয়, চানাচুরসহ নানান পণ্য। নেপালে রফতানি করা হয় বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু, পাট, ব্যাটারি, কোমলপানিয়, সাবান, বিস্কুট, চানাচুর, জুস, কাঁচসহ বিভিন্ন দ্রব্য। বাংলাদেশ থেকে এখন নেপাল ও ভারতে রফতানি হয় প্রচুর আলু।

সাল আমদানি
লক্ষ মে.টন
রপ্তানি
লক্ষ মে.টন
২০১৫-১৬ ৯.৩৫ 0.৩১
২০১৬-১৭ 0.0৭
২০১৭-১৮ ১২.০৭ 0.৬৯
২০১৮-১৯ ১৭.৯৭ 0.৪৩
২০১৯-২০ ১১.৮৬ ১.১৩
২০২০-২১ ১৬.৯৩ ১.১২
২০২১-২২ ১৬.৫৫ ১.৬৪
২০২২-২৩ ১৫.৮৮ ০.৮

এই পথে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক আমদানি পণ্য আনা হয়, আর ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ যাতায়াত করে। প্রতিদিন এ স্থলবন্দরে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। জীবিকা নির্বাহে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষাভাবে এই বন্দরের সঙ্গে যুক্ত।

ইমিগ্রেশন সেবাঃ ২০১৬ সালে বাংলাবান্ধা দিয়ে ইমিগ্রেশন চালু হওয়ার পর প্রতিদিনই কয়েকশো পর্যটক যাতায়াত করেন এই বন্দর দিয়ে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারত, নেপাল কিংবা ভুটান যাতায়াত হয়েছে সহজতর। রংপুর বিভাগের হাজারো পর্যটক, ভারতগামী রোগী, স্থানীয় ব্যবসায়ীগণ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন ব্যবহার করেন। সারা বছরজুড়ে নেপাল, ভুটান, দার্জিলিং, গ্যাংটক, ডুয়ার্স ভ্রমণকারী পর্যটকরা অনায়াসে বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে পৌঁছে যান তাঁদের গন্তব্যে। অন্যদিকে এসকল ভ্রমণকারীরা তাদের যাত্রাপথে তেঁতুলিয়ার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করেন।

সাল আগমন বহির্গমন
২০২২-২৩ অর্থবছরে যাত্রী গমনাগমনের তথ্য ২১০১৮ জন ১৮২৮৬ জন

রাজস্ব আয়ঃ বাংলাবান্ধা বন্দর থেকে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা প্রতি অর্থবছরেই শতভাগ অর্জিত হয়। বছরে আমদানি রপ্তানি হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য। আমদানি রপ্তানি আগের তুলনায় দ্বিগুন হয়েছে এবং সাথে সাথে সরকারি রাজস্ব আয় অনেক বেড়েছে।

সাল রাজস্ব আয়
কোটি টাকা
২০১৫-১৬ 0.২৫
২০১৬-১৭ 0.২৪
২০১৭-১৮ 0.৪৮
২০১৮-১৯ ৩.১৫
২০১৯-২০ ৩.৩৩
২০২০-২১ ৩.৫৫
২০২১-২২ ৩.৬৩
২০২২-২৩ ৪.১১

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইতিহাসঃ চতুর দেশীয় বাণিজ্যিক পয়েন্ট বাংলাবান্ধায় স্থলবন্দর ১৯৭৮ সালের নেপাল-বাংলাদেশ চুক্তি এবং ১৯৭৬ সালের সাফটা চুক্তির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্বজনীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পৃক্ততা এবং বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মদ এবং নেপাল সরকারের কৃষিমন্ত্রী চক্র প্রসাদ বাসতুলা বাংলাবান্ধা বন্দরে বাংলাদেশ-নেপাল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের উদ্বোধন করেন।অপার সম্ভাবনাময় বাংলাবান্ধা বন্দর পূর্বাঙ্গভাবে চালুর জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ তখন প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে স্থলবন্দরের অফিস ভবন, ট্রাকিয়ার্ড পুলিশ ব্যারাক, কাস্টমস ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করেন।

স্থলপথে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সহজতর করার লক্ষ্যে ২০০২ সালের ১২জানুয়ারিতে এ শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়।

এরপর ২০০৪ সালের ২২ মে স্থলবন্দরের ওয়ার হাউজসহ অবকাঠামোর উদ্বোধন করা হয়। সেদিন বাংলাবান্ধা পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে চালুর উদ্দেশ্যে স্থলবন্দরের সঙ্গে কর্মকর্তা ও প্রয়োজনীয় জনবল ব্যারাকে উপস্থিত হন। কিন্তু উদ্বোধন ঘোষণা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে স্থলবন্দরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে ব্যারাক থেকে লাইনে নেওয়া হয় এবং পর্যায়ক্রমে ব্যাংক ও অন্য কর্মকর্তাগণ অজ্ঞাত কারণে সেখান থেকে ফিরে যান। তখনো উত্তরাঞ্চলের জনসাধারণ জানতো না যে বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের বিপরীতে শুধু ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার হবে।

২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ব্যক্তি মালিকানায় বন্দরগুলো বিওটির ভিত্তিতে ছেড়ে দেয়ার জন্য দরপত্র আহবান করে। দলপত্র বিজয়ী প্রতিষ্ঠানকে ২৫ বছরের জন্য বন্দর গুলো অর্থায়ন নির্মাণ এবং পরিচালনা করবে সেই দরপত্রে হিলি বিরল সোনামসজিদ ও বাংলাবান্ধা চারটি বন্দর বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০০৫ সালের ৯ অক্টোবর স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাবান্ধা ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেড এর Concession Agreement (CA) স্বাক্ষরিত হয়। CA অনুযায়ী পোর্ট অপারেটর ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট স্থলবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করে।

২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আওতায় দেশ দু’টির মধ্যে আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়। বাংলাবান্ধায় বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল চালু হয়। তেঁতুলিয়ায় বাংলাবান্ধার জিরো পয়েন্টে ফলক উম্মোচন করে কৃষিমন্ত্রী বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি স্থল বন্দরের মাধ্যমে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী দিনে ভারত থেকে ৩টি ট্রাকে ৩০ টন ব্যালেস্ট পাথর আসে এবং বাংলাদেশ থেকে ২ টি ট্রাকে ৯ টন গার্মেন্ট ঝুট ভারতে যায়।

প্রকৃতপক্ষে উক্ত দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি ও সরকারি বিধি মোতাবেক বাংলাদেশী ব্যাবসায়ীরা শুধুমাত্র পাথর আমদানী করতে পারে ভারত থেকে। আর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের সকল বৈধ পন্য ক্রয় করার সুযোগ পায়। বাংলাদেশে অবাধ রপ্তানীর সুযোগ না পেয়ে ব্যবসার আগ্রহ হারাতে থাকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যাবসায়ী সংগঠন গুলোর সমন্বয়হীনতা ও বলিষ্ঠ ভূমিকার অভাবে সম্ভাবনাময় বাংলাবান্ধা তখনও পূর্ণ স্থলবন্দরের রূপ পায়না।

স্থানীয়ভাবে বাংলাবান্ধা বন্দরের গুরুত্ব অনুধাবন করে পঞ্চগড় নাগরিক কমিটির আহবানে এক কঠোর কর্মসূচীতে জেলার সকল স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম কর্মীসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ১ ঘন্টা কর্ম বিরতি রেখে হাতেহাত মিলিয়ে পঞ্চগড় শের-এ-বাংলা পার্ক থেকে বাংলাবান্দা জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৫ কিলোমিটার মানববন্ধনে ইমিগ্রেশন চেক-পোষ্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পূর্নাঙ্গ চালুর জোর দাবি জানায়।

২০১২ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সাথে আঞ্চলিক ও আন্তসীমান্ত বাণিজ্য বাড়াতে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি আরও বলেন এ বন্দর পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে দক্ষিণ-পূর্ব ও মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হবে।

২০১৬ সালে পর্যটন সম্ভাবনা বেগবান করতে বাংলাবান্ধা দিয়ে ইমিগ্রেশন চালু হয়। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাবান্ধায় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জেনারেল (অব.) বিজয় কুমার সিং এবং ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ইমিগ্রেশন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। ইমিগ্রেশন সেবা শুরুর পর প্রতিদিনই কয়েকশো পর্যটক যাতায়াত করেন বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে। স্থানীয় মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ইমিগ্রেশন সুবিধা চালুর সিদ্ধান্তে পঞ্চগড়ের সর্বত্র আনন্দ, উল্লাসের প্রকাশ দেখা যায়। জেলা প্রশাসন স্থানীয় জনসাধারণ, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দল পক্ষ থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা করা হয়।

২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ভুটানের সাথে পণ্য আমদানি-রপ্তানি শুরু হয় বাংলাবান্ধা দিয়ে। …আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের শিল্প ও বাণিজ্য

 


তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ | বাংলাবান্ধা ল্যান্ড পোর্ট লিংক লিমিটেড | মোঃ লুৎফর রহমান
ছবিঃ রাজীব ধর
Last updated: 13 January 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর - Banglabandha Land Port
বাংলাবান্ধা, তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়।

ম্যাপঃ Google map

বাংলাবান্ধা ল্যান্ড পোর্ট লিঃ
Email: info@blplbd.com
Website: www.blplbd.com
Facebook: facebook.com/blplbd