প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো। মহানন্দা নদীঘেঁষে উঁচু একটি টিলার ওপর অবস্থিত শত বছরের পুরোনো ডাকবাংলোটি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী। তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর একপাশে বাংলাদেশ আর অন্যপাশে ভারত। হিমালয়ের পাদদেশ হতে উৎপন্ন হয়ে ডাকবাংলো ঘেঁষে বহমান মহানন্দা নদীর অপরপাশে সীমান্তের কাটাঁতারের বেড়া আর ভারতের শিলিগুড়ি। ডাকবাংলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানন্দা নদীতে নুড়ি পাথর উত্তোলনের দৃশ্য, তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নারের স্থাপনা – সবকিছু নজর কাড়ে পর্যটকদের। ব্রিটিশ আমলের এই ডাকবাংলো বর্তমানে পঞ্চগড় জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত এবং এখন এটি জেলা পরিষদ ডাকবাংলো নামে পরিচিত।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে প্রতি বছর পর্যটকরা ছুটে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা শহরের টাইগার হিল পয়েন্টে। কেউ কেউ সরাসরি নেপালে গিয়েও কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যবেক্ষণ করেন। যাদের এসব সুযোগ হয় না তাঁদের জন্য দেশের মাটি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা অবলোকনের উত্তম জায়গা তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো। ডাকবাংলো খানিকটা উঁচু হওয়ায় সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় পরিষ্কারভাবে। তেঁতুলিয়া থেকে প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর থেকে দৃশ্যমান হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ। হেমন্ত ও শীতকালে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না থাকায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তেঁতুলিয়ায় ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ, ভিড় করেন তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার ভিউ পয়েন্ট-এ। বর্ষাকালেও তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো থেকে মহানন্দা নদীর অপূর্ব সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর আকর্ষণঃ আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটন মুখী করার লক্ষ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসনের একাধিক উদ্যোগ ও সৃজনশীল পরিকল্পনায় নির্মিত নতুন নতুন স্থাপনায় তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো এবং তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নারকে আকর্ষণীয় রূপ দেওয়া হয়েছে।
- পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়া দেখা।
- মহানন্দা নদীর আকর্ষণীয় সৌন্দর্য।
- ২০০ মিটার প্রশস্ত মহানন্দা নদীর অপরপাশে ভারত।
- মহানন্দা নদীতে শ্রমিকদের পাথর তোলার অপরূপ দৃশ্য।
- বর্ষাকালে মহানন্দা নদীর মনোরম দৃশ্য।
- কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার ভিউ পয়েন্ট।
- ডাকবাংলো প্রাঙ্গনের শতবর্ষী গাছ, সমতল ভূমির চা-বাগান।
- ইকো পার্ক, হার্ট শেড, তেঁতুলিয়া লাভ কর্নার এবং ওয়াচ টাওয়ার।
- আবহমান বাংলার চিত্তাকর্ষক দৃশ্য।
- গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ঢেকি, কৃষক-কৃষাণী।
- বঙ্গবন্ধুর তর্জনী, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ চত্বর, ৭ বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি।
- স্বাধীনতার তীর্থভূমি তেঁতুলিয়া।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও লালন ফকিরের ভাস্কর্য।
- অপ্রতিরোধ্য বাংলা জাদুঘর।
- তেঁতুলিয়া জিরো পয়েন্ট, চা কন্যার ভাস্কর্য।
- মহানন্দা ডাইনিং হল, কমিউনিটি হলরুম ও কমপ্লেক্স।
- তোঁতা পাখি, হাতি, চিতাবাঘ, বানর, খোরগোশের ভাস্কর্য।
- শিশুদের খেলার জন্য দোলনা, স্লিপার, নাগরদোলা।
- তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নার।
- অত্যাধুনিক বেরং কমপ্লেক্স (থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ) এবং নবনির্মিত কাঠের কটেজ।
- বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট (তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নার থেকে দূরত্ব ১৭ কিমি)।
ডাকবাংলোর ইতিহাসঃ অতি প্রাচীন স্থাপনা তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর ইতিহাস অনেক পুরোনো। বর্তমানে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো নামে পরিচিত এই ডাকবাংলোটি কোন সময়ে, কে নির্মাণ করেন কিংবা ডাকবাংলোটি কত খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় ঐতিহাসিক ডাকবাংলোটি কুচবিহারের রাজা নির্মাণ করেছিলেন। এর নির্মাণ কৌশল অনেকটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের। ডাকবাংলোটি প্রায় ২.২০ একর জমির মাঝখানে টিলার উপর অবস্থিত। ডাকবাংলোর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত বছরের পুরোনো গাছপালাগুলো কালের সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্রিটিশ শাসকেরা অত্র অঞ্চলের শাসন কার্য পরিচালনার জন্য এই অঞ্চলে বিশ্রামাগার হিসাবে এই ডাকবাংলোটি ব্যবহার করতেন। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তেতুলিয়ায় একটি ক্যান্টনমেন্ট ছিল। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ওই পরিত্যক্ত সেনানিবাসটি ব্রিটিশ সৈনিকদের ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তেঁতুলিয়া শহরের পাশেই পুরানা পল্টন নামক স্থানে ব্রিটিশ সৈনিকদের একটি সমাধিস্থল রয়েছে। সেখানে ছোট দুটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। স্থাপত্যরীতির দিক থেকে স্মৃতিস্তম্ভ দুটি অসাধারণ। তেঁতুলিয়ায় সিকিমের মহারাজার শাসনামলে একটি সেনানিবাস নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। ক্যান্টনমেন্ট দুটি বর্তমান ডাকবাংলার পাশেই স্থাপিত হয়েছিল।
তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী। প্রথম দিকে এখানে বসে সভা করতেন মন্ত্রী-কর্মকর্তারা। পরে ডাকবাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার বসবাস করতেন। এখানে বসেই ৬ নম্বর সেক্টরের যাবতীয় পরিকল্পনা করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা ছিল মুক্তাঞ্চল। পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানার চাওয়াই নদীর সেতু বোমা দিয়ে ভেঙে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ কারণে তেঁতুলিয়ায় আর যেতে পারেনি পাকিস্তানি বাহিনী। এই মুক্তাঞ্চলে গিয়ে কাজ করেছেন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীসহ প্রবাসী সরকারের অন্য মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা। যুদ্ধকালীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর কর্মকর্তাদের অবস্থানের জন্য নিরাপদ স্থান ছিল তেঁতুলিয়ার ঐতিহাসিক ডাকবাংলো। …আরো পড়ুন পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি ও গণকবর | মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া
স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়ার অসাধারণ অবদানের কথা চিরস্মরণীয় করে রাখতে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো ভবনের পাশে চারকোনা বেদির উপরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভটির নামকরণ করা হয়েছে স্বাধীনতার তীর্থভূমি তেঁতুলিয়া। এই স্তম্ভে উৎকীর্ণ করা রয়েছে কবি রহমানের স্বাধীনতা তুমি কবিতাটিঃ
স্বাধীনতা তুমি
স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল, ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ
সৃষ্টি সুখের উল্লাশে কাঁপা …
ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে পুরনো দুটি ভবনের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত অত্যাধুনিক এবং সুসজ্জিত বেরং কমপ্লেক্স ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বেরং কমপ্লেক্সের পাশে একটি কাঠের কটেজ তৈরী করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে ও পর্যটকদের বিনোদন জন্য ডাকবাংলোর পিকনিক কর্ণারের একটি পরিত্যক্ত ঘরকে অপ্রতিরোধ্য বাংলা জাদুঘর হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ডাকবাংলোর পাশেই বন বিভাগের ৩০০ একর জমিতে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। এর একটি অংশে তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ কর্তৃক নির্মিত করা হয়েছে তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নার। এই পিকনিক কর্নারটি বনভোজনের জন্য সমগ্র উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়। ডাকবাংলো ও পিকনিক কর্নার-এর অবস্থান পাশাপাশি হওয়ায় কারণে এই স্থানটি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এখানে অনেক দেশী- বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে। শীতকালের শুরু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিললেই বেড়ে যায় মানুষের আনাগোনা।
ডাকবাংলোর অবস্থানঃ তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো বা জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, তেঁতুলিয়া উপজেলা সদর-এ অবস্থিত। তেঁতুলিয়া উপজেলা বাসস্ট্যান্ড হতে ১.৪ কিমি দূরত্বে তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা সড়কের বাম পাশে ডাকবাংলোটির অবস্থান। তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর দুটি ভবন, ডাকবাংলোর মূল ভবন এবং এর পাশে আরেকটি দোতালা ভবন রয়েছে।
কখন যাবেনঃ সীমান্তঘেঁষা মহানন্দা নদী সংলগ্ন অপরূপ সৌন্দর্যে লীলাভূমি নামে খ্যাত তেঁতুলিয়ায় সারাবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারও পর্যটকের আগমন ঘটে। বিশেষ করে শীতকালের শুরুতে (অক্টোবর-নভেম্বর) ও শীতের শেষে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) প্রাকৃতিক নৈসর্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এবং পিকনিক খেতে অসংখ্য পর্যটক তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো দেখতে আসেন। এ সময়টাতে তেঁতুলিয়ায় মেঘ-কুয়াশামুক্ত আকাশের উত্তর-পশ্চিমে তাকালেই দেখা মেলে বরফাচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘার। রোদ পড়ে এর বরফ এমনভাবে ঝলমল করতে থাকে যে, সে এক অপরূপ দৃশ্য, কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপের অভূতপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করেন দর্শনার্থীরা। বর্ষাকালে মহানন্দা নদীতে পানি থাকলে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর সার্বিক দৃশ্য আরও বেশী মনোরম রূপ ধারণ করে।
কিভাবে যাবেনঃ পঞ্চগড় জেলার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের পাশে ধাক্কামারা মোড় থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার বাসে সহজেই তেঁতুলিয়া পৌঁছে যাবেন। তেঁতুলিয়া বাসস্ট্যান্ড হতে অটো ভ্যান ভাড়া নিলে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো ১০ মিনিটের পথ। তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন স্থান বেড়ানোর জন্য পঞ্চগড় শহর থেকে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া ভালো। সারা দিনের জন্য এসব জায়গা ঘুরতে রিজার্ভ কারের ভাড়া ২৫০০-৩৫০০ টাকা। পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন এবং শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে এসব ভাড়ার গাড়ি পাওয়া যাবে। …Travel Tips | Accommodation | Tourist Spots
তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো ভাড়া করবেন কিভাবেঃ তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার অথবা পঞ্চগড় ডিসি সাহেবের পূর্বঅনুমতি সাপেক্ষে যেকেউ তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো ভাড়া করতে পারবেন। সরকারি চাকুরীজীবিগণ প্রাধান্য পাবার কারণে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে অথবা সপ্তাহান্তে প্রায়ই তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো খালি থাকে না। ডাকবাংলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে চাইলে কেয়ারটেকারের (+88 0173 735 9451, +880 175 102 6225, +880 1734 805 535) সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। পূর্বানুমতি নেয়া থাকলে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো প্রাঙ্গনে তাবুতে (Tent) রাত্রিযাপন করা যায়। ডাকবাংলোতে গাড়ি পার্কিং এর সুবিধা রয়েছে।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড় জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ | মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া
Last updated: 22 December 2023