অর্গানিক চা উৎপাদন করে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া আজ বিশ্বনন্দিত। অর্গানিক চা উৎপাদনের পথিকৃৎ তেঁতুলিয়ার কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট থেকে উৎপাদিত অর্গানিক চা পঞ্চগড়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। কাজী এন্ড কাজী প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ১০০ ভাগ অর্গানিক চা উৎপাদিত করছে পঞ্চগড়ে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে, কোনোরকম ক্ষতিকর রাসায়নিক ও কৃত্রিম উপাদান ছাড়া, পোকা দমনেও কোন কীটনাশক ব্যবহার না করে উৎপাদিত চা হলো অর্গানিক বা ভেষজ চা। কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে উৎপাদিত হয় অর্গানিক চা। A cup of happiness স্লোগানে ২০০৭ সাল থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার নামানুসারে বিশ্ববাজারে Teatulia Tea ব্র্যান্ডের চা রপ্তানি শুরু করে কাজি অ্যান্ড কাজি টি এস্টেট। প্রথমে এই চা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে রপ্তানি শুরু হয় এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এটিকে অর্গানিক চা হিসেবে স্বাকৃতি দেয়। Teatulia Tea এখন বিশ্বের স্বীকৃত প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস ম্যাগাজিন ও সার্কেল আপের করা ২০১৫ সালের বিশ্বের সেরা ২৫টি চায়ের ব্র্যান্ডের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া অর্গানিক চা।
২০০০ সালে দেশের প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার রওশনপুর এলাকায় অর্গানিক পদ্ধতিতে চা চাষ শুরু করে কাজী গ্রুপ। ২০০৩ সালে পরীক্ষামূলক চা উৎপাদনে যায় প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৫ সাল থেকে তাঁদের চা কারখানায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। বাগানে অর্গানিক চা উৎপাদনের জন্য অর্গানিক প্রক্রিয়ায় জমি প্রস্তুত, পশুপাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিতকরণ, অর্গানিক প্রক্রিয়ায় কীটনাশক তৈরি এবং এর প্রয়োগ করা হয়। কাজী এন্ড কাজী সমবায় ডেইরি থেকে সংগৃহীত গোবর ও সবুজ লতাপাতার সমন্বয়ে জৈব সার তৈরি করা হয়। নিম, নিশিন্দা ও বিষকাঁটালি ইত্যাদি ভেষজ ও ঔষধি পাতার মিশ্রণে তৈরি হয় বায়োপেস্টিসাইড। চায়ের পাতা উত্তোলন করা হয় হাত দিয়ে। চায়ের দুটি পাতা আর একটি কুড়িই তুলে থাকে তারা। সেই পাতা পরিচ্ছন্ন পদ্ধতিতে কারখানায় নিয়ে প্রক্রিয়াজাতের পর তৈরি হয় অর্গানিক চা। তেঁতুলিয়ার কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট-এর চা বাগান সম্পূর্ণ কম্পোজিট টি এস্টেট। কাজী অ্যান্ড কাজী চায়ের উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা পঞ্চগড়ে হলেও প্যাকেজিং হয়ে থাকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে।
কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটে অর্গানিক চায়ের পাশাপাশি পঞ্চগড়ে নিজস্ব ডেইরি ফার্মে উৎপাদিত দুধ থেকে অর্গানিক পদ্ধতিতে ক্রিম টোস্ট মিষ্টি, কাটাভোগ, রাজভোগ, কালোজাম, বালুসাই, চমচম, বটফল, ছানা, ছানা সন্দেশ, প্যারা সন্দেশ, পাটারি সন্দেশ, মণ্ডা সন্দেশ, রসমালাই, দুধমালাই, মিষ্টি দই, মাখন ও ঘি তৈরি করে বিক্রি করে তারা। নির্ভেজাল মধুও উৎপাদন ও বিক্রি হয় এখানে। কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের এ সকল উৎপাদিত অর্গানিক পণ্য পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার রওশনপুর ও পঞ্চগড় জেলা শহরের মীনা বাজার এই দুই আউটলেট থেকে বিক্রি করা হয়। বাহারি রকমের অর্গানিক চাসহ মিষ্টি, মধু ও ঘি কিনতে প্রতিদিন ভিড় লেগেই থাকে এ দুই আউটলেটে। পঞ্চগড়ে আসা পর্যটকরা খাওয়ার পাশাপাশি কিনে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যায়।
অর্গানিক চা উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠান আর দেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে কাজী অ্যান্ড কাজী। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তর (ইউএসডিএ), দেশটির খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন দপ্তরের (এফডিএ) খাদ্যের মান দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান হ্যাজার্ড অ্যানালাইসিস ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্টের (এইচএসিসিপি) কাছ থেকে পেয়েছে স্বীকৃতি। পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের স্বীকৃতি হিসেবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রেইনফরেস্ট অ্যালায়েন্সের বিশেষ সনদ পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং জাপান সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজী অ্যান্ড কাজী টির অর্গানিক চা রপ্তানি হচ্ছে। বিদেশে বিখ্যাত স্টোর ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় শোভা পাচ্ছে তেঁতুলিয়া ব্র্যান্ড। দেশে শ্রেষ্ঠ বৈচিত্র্যময় চা কম্পানি হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে কাজী অ্যান্ড কাজী টি।
২০২২ সালে কাজী অ্যান্ড কাজীর বাগানে ৫ লাখ ৯৬ হাজার কেজি অর্গানিক চা উৎপাদন হয়। ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৩৯ হাজার কেজি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে অর্গানিক চায়ের বাজার এখন ৩৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের সমপরিমাণ। বৈশ্বিক বাজারে অর্গানিক চা-এর চাহিদার পাশাপাশি দেশেও এ চায়ের বাজার বাড়ছে দিন দিন।
ব্ল্যাক ও গ্রিন—এ দুই ক্যাটাগরিতে অর্গানিক চা উৎপাদন করে কাজী অ্যান্ড কাজী। এ দুই ক্যাটাগরির ভেতরে আরো ৭০ থেকে ৮০ প্রকারের চা হয়। চা পাতার সঙ্গে তুলসী পাতা, পুদিনা পাতা, লেবু, জেসমিন, আদাসহ বিভিন্ন উপকারি পণ্য দিয়ে হরেক রকমের চা বানায় প্রতিষ্ঠানটি। বাজারে তাদের ১৫ থেকে ২০ ধরনের অর্গানিক চা বেচাকেনা হচ্ছে। কাজী অ্যান্ড কাজী’র অর্গানিক চায়ের ব্র্যান্ড গুলো হলো ব্ল্যাক, অর্থডক্স ব্ল্যাক, অর্থডক্স গ্রিন, ফার্স্ট ফ্ল্যাশ, প্রিসটাইন ব্ল্যাক, জেসমিন গ্রিন, গ্রিন মিন্ট, তুলসী, মেডলি মিক্সড, জিনজার, লেমন, হারমোনি, অর্থডক্স ওলোং, অর্থডক্স লেমন, হোয়াইট টি অন্যতম। হোয়াইট টি সবচেয়ে দামি চা। ক্লাসিক ব্ল্যাক, সবুজের নির্যাস সমৃদ্ধ, হারবাল ইনফিউশন ও চারধরনের চায়ের মিশ্রণে মেডিলি টি, যারা হালকা ফ্লেভার পছন্দ করেন তাদের জন্য মৌলিক এক পদ্ধতিতে তৈরি হয় অর্থোডক্স গ্রিন টি। এই পদ্ধতিতে গোটা চায়ের পাতা আর কুঁড়িকে রোল করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। অর্গানিক পদ্ধতিতে তৈরি তুলসী পাতার সঙ্গে ব্ল্যাক টি স্পাইসি ব্লেন্ডে তৈরি হয় তুলসী টি। তারুণ্যময় গুণসম্পন্ন অ্যান্টি অক্সিডেন্টের পাশাপাশি ঔষধি গুণাবলী জ্বর ঠাণ্ডা নিমিষেই মুক্তি দিতে সক্ষম। সাধারণ ব্ল্যাক টি-এর সঙ্গে অর্গানিক উপায়ে চাষ করা আদা মিশিয়ে তৈরি হয় জিঞ্জার টি।
অর্গানিক চা-এর মৌলিক উপকারিতাঃ
(১) ওজন কমাতে সাহায্য করে।
(২) স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।
(৩) ডায়বেটিস প্রতিরোধে সহায়ক।
(৪) শরীরের অতিরিক্ত ক্যালরি দূর করে।
(৫) মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে।
(৬) হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
(৭) অবসাদ দূর করে।
(৮) ত্বকের যত্নে ব্যবহার করা যায়।
(৯) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
(১০) ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
পঞ্চগড়ে কাজী অ্যান্ড কাজীর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল অর্গানিক চায়ের চাষ। এখন এটি ছড়িয়ে পড়েছে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতে। পাঁচটি জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ১০টি ও অনিবন্ধিত ১৭টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৫১০টি নিবন্ধিত ও ৫ হাজার ৮০০টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান (২৫ একর পর্যন্ত) রয়েছে। চায়ের এলাকা সম্প্রসারিত হলেও কাজী অ্যান্ড কাজী সেই শুরুর লক্ষ্য, অর্থাৎ অর্গানিক চায়ের চাষ অব্যাহত রেখেছে। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের পাশাপাশি আরও দুটি প্রতিষ্ঠান অর্গানিক চা করছে।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের চা শিল্প । কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট | কাজী শাহেদ আহমেদ | আনন্দধারা রিসোর্ট | পঞ্চগড়ের শিল্প ও অর্থনীতি
তথ্যসূত্রঃ teatulia.com | kazifarms.com | মো. লুৎফর রহমান | মাসুদ রুমী
Last updated: 8 May 2024