বঙ্গভঙ্গে পঞ্চগড় – Panchagarh during the partition of Bengal

১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান দেশ ভাগের সময়ে ১৪ আগস্ট পঞ্চগড় জেলাকে ভারতের আওতাভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু ১৮ আগস্ট সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে পঞ্চগড়কে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর অংশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ সমগ্র পঞ্চগড় অঞ্চল ৩ দিনের জন্য ভারতের অংশ ছিল। বঙ্গভঙ্গ কালে পঞ্চগড় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার অধীনে একটি থানা। পরবর্তীতে পঞ্চগড় ১৯৮০ সালে মহকুমা এবং ১৯৮৪ সালে পূর্ণ জেলার মর্যাদা লাভ করে।

১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গের পূর্বে সমগ্র পঞ্চগড় অঞ্চল (আটোয়ারী উপজেলা বাদে) ছিলো অবিভক্ত বাংলার দার্জিলিং/জলপাইগুড়ির অধীন। পঞ্চগড় অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় সমান হওয়ায় এই এলাকা ভারত নাকি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে এই নিয়ে শুরু হয় তোড়জোড় ও দেন দরবার। কৃষক আন্দোলনের অঞ্চল হিসেবে এই থানাগুলোতে কংগ্রেসের প্রভাব ছিল কম। কমরেড হিসেবে চিহ্নিত তেভাগা আন্দোলনের বহু নেতা কর্মী ছিলেন কারাগারে অথবা আত্মগোপনে। সুতরাং হিন্দু জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই অঞ্চলকে ভারত ভুক্তির দাবি এই অঞ্চলে বেশি শক্তিশালী হওয়ার অবকাশ লাভ করেনি। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কলকাতায় অবস্থান করেই চেষ্টা চালিয়েছেন সমস্ত জলপাইগুড়ি জেলাকে ভারত ভুক্ত করার। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জলপাইগুড়ি জেলা শাখার মুসলিম লীগ জলপাইগুড়ি জেলার মুসলিম প্রধান পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, বোদা, দেবীগঞ্জ ও পাটগ্রাম থানাকে পাকিস্তান ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন ও জনমত সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

১৯৪৭ সালের ৩ জুনে ভারত-পাকিস্তান বিভাগের পক্ষে/বিপক্ষে বঙ্গীয় আইনসভা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সদস্য ও অন্য ভাগে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার সদস্যগণ অন্তর্ভুক্ত হন। সাময়িকভাবে বিভক্ত ইউনিটদ্বয় ২০ জুন বিভক্তিকরণ বিষয়ের ওপর ভোটা-ভুটির জন্য সমবেত হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার প্রতিনিধিগণ বিভক্তির পক্ষে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার প্রতিনিধিরা বিপক্ষে ভোট দেন। এই ভোটা-ভুটির মাধ্যমেই বাংলা বিভক্তির ক্ষেত্র প্রস্ত্তত হয় এবং ভোটের পরই পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করার জন্য সীমান্ত কমিশন (Boundary Commission) গঠন করা হয়।

১৯৪৭ সালে জলপাইগুড়ি জেলার মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে নবাব মোশাররফ হোসেন এবং বোদার ডাঃ সলিমউল্লাহ। ডাঃ সলিমউল্লাহ ছিলেন বহুভাষিক বাগ্মী ও অনলবর্ষী। তাঁদের কয়েকজন সহযোদ্ধার মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজী হালিম উল্লাহ (জমাদারপাড়া), দারাজ উদ্দিন আহমদ এডভোকেট (চন্দনবাড়ি), মোঃ আব্দুল করিম ও মোঃ সিরাজুল করিম (চন্দনবাড়ি), মির্জা গোলাম হাফিজ (মির্জাপুর), আইয়ুব হক অ্যাডভোকেট (বুড়াবুড়ি), জফিরুদ্দিন আহমদ (পঞ্চগড়), গমির উদ্দিন প্রধান (টোকরাভাষা), মোঃ মহিরউদ্দিন সরকার (মন্নাপাড়া), ডাঃ আতাউর রহমান (মারেয়া), মোবারক আলী (ভজনপুর) প্রমূখ। এ সকল নেতৃবৃন্দ সংশ্লিষ্ট থানার প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন এবং উল্লেখিত অঞ্চলগুলোকে পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য সকলকে উজ্জীবিত করেন। বস্তুত এই অঞ্চলে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টির চেয়ে জলপাইগুড়ি জেলাকে নতুন রাষ্ট্রের অন্তর্গত করার জন্য জনগণ ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ অধিক তৎপর ও সোচ্চার ছিলেন।

ঠাকুরগাঁও মহকুমা (বর্তমানে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা)-এর জনগণ পাকিস্তান অংশে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে আন্দোলন শুরু করে। ঠাকুরগাঁও হাইস্কুলের কয়েকজন শিক্ষক একই স্কুলের মুসলিম বোর্ডিং এর ছাত্রদের নিয়ে জনমত তৈরী করতে থাকেন। ঠাকুরগাঁও পাকিস্তান অংশে পড়বে, নাকি ভারত অংশে পড়বে এ নিয়ে কয়েকদিন উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কারণ দেশ বিভাগের তারিখ ঠিক হলেও রাডক্লিফ সীমানা কমিশনের রিপোর্ট তখনো প্রকাশ করা হয়নি। এ সময় ঠাকুরগাঁওয়ের লোকজন জানতে পারে যে ঠাকুরগাঁও মহকুমা বালুরঘাট জলপাইগুড়ি করিডর হিসেবে ভারতের অংশে পরিণত হচ্ছে এবং এজন্য সেতাবগঞ্জ সুগারমিলের ম্যানেজার মিঃ গোয়াংকা ভারত পাকিস্তান সীমারেখা নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা মিঃ র‍্যাডক্লিফকে নাকি একলাখ টাকা উপহার দিয়েছেন। এ সংবাদ প্রচার হবার পর ঠাকুরগাঁও ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ঠাকুরগাঁও-এর রুহিয়াতে মুসলীম লীগের নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় জরুরি এক কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। যা ঐতিহাসিক রুহিয়া কনফারেন্স নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ রুহিয়া কনফারেন্স-এর প্রস্তাব ছিল, যেহেতু ঠাকুরগাঁও মহকুমা একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল সেহেতু এটি পাকিস্তান অংশে হবার দাবিদার। তা সত্ত্বেও যদি ভারতের অংশ হিসেবে ফেলা হয় তবে, এ এলাকায় অবধারিত দাঙ্গার আশংকা থাকবে। রুহিয়া কনফারেন্স-এর প্রচেষ্টার পুরোধা ব্যাক্তিত্ব ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা এ্যাডভোকেট নুরূল হক চৌধুরী

মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদ্বয় পঞ্চগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ ও জলপাইগুড়ি থানার সর্বত্র ঘুরে ঘুরে আন্দোলনকে সঙ্গবদ্ধ করতে থাকেন। জলপাইগুড়িতে অ্যাডভোকেট জাহারতউল্লাহ’র বাসভবনে মুসলিম লীগ নেতাকর্মীদের সমাবেশ ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। ডাঃ সলিমউল্লাহ, মির্জা গোলাম হাফিজ, আইয়ুব হক যেতেন সেখানে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা নিজ নিজ প্রস্তাবিত দেশের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ফলে সীমানা নির্ধারণের জন্য গঠিত র‍্যাডক্লিফ বাউন্ডারি কমিশনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যথাক্রমে ১৬ ও ১৭ ই জুলাই ১৯৪৭ তারিখে স্ব-স্ব দলের লিখিত দাবি পেশ করেন। মুসলিম লীগের পক্ষে যখন মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছিল না, সে সময় জলপাইগুড়ির কিছু কিছু চা বাগানের শ্রমিকদের সংখ্যা তাত্ত্বিক পরিসংখ্যান কমিশনের নিকট উপস্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে সহযোগিতা করার জন্য জুলাই মাসে প্রয়োজনীয় দলিলপত্র সহ প্রথমে মির্জা গোলাম হাফিজ ও একদিন পর আইয়ুব হক দাঙ্গা বিক্ষুব্ধ কলকাতায় গমন করেন। তাঁরা মেমোরেন্ডাম পেশ করেন ভেলভেডিয়া হাউসে অবস্থানরত বাউন্ডারি কমিশনের নিকট।

অবশেষে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীনতা পেল ভারত বর্ষ। ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ তারিখের স্বাধীনতা ঘোষণায় দেখা গেল ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ধারণাগত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই পাকিস্তান ও ভারতের সীমানা নির্ধারণ হয়েছে। ফলে ১৫ই আগস্ট পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, বোদা ও দেবীগঞ্জে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

গভর্নর মাউন্টব্যাটেন বস্তুত র‍্যাডক্লিফ কমিশনের রিপোর্ট যথাসময়েই পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্বে তা প্রকাশ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। ১৭ ই আগস্ট রেডিওতে র‍্যাডক্লিফ কমিশনের সুপারিশ সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। সেই অনুযায়ী ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার সঙ্গে সংযুক্ত পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, বোদা ও দেবীগঞ্জ থানাকে পুনরায় পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার আওতাভুক্ত করা হয়। ১৮ই আগস্ট চারটি থানায় ভারতীয় পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করা হয়।

এর ফলে বোদা, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় এলাকার পাঁচটি মুসলিম অধ্যুষিত থানা (পুলিশ স্টেশন) পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং ভারতীয় কংগ্রেসের পরামর্শে চা উৎপাদনকারী জেলা দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) ভাগে পড়ে। ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা আধিক্যের থানা ভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী পঞ্চগড়ের থানাগুলো পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ববঙ্গের দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিনিময়ে দিনাজপুর রাজ্যের ১০ টি প্রশাসনিক থানাকে হিন্দুস্তান এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা পশ্চিম দিনাজপুর নামে পরিচিত হয়। উল্লেখিত চারটি থানা প্রথমে ভারত এবং পরে পাকিস্তান ভুক্ত হওয়ার কারণে উভয় দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ও মুসলমান দেশ ত্যাগ করেন। ১৯৪৭-পূর্ব দিনাজপুরের ৩০ থানার মধ্যে পাকিস্তানে থাকে ২০ থানা (৬৫ ভাগ এলাকা) এবং ভারতে যায় ১০ থানা (৩৫ ভাগ অঞ্চল)। পাকিস্তানি প্রশাসনিক পদ্ধতিতে ১৯৪৯ সালের ১৫ মার্চ পঞ্চগড় শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মুন্সেফ কোর্ট। ১৯৪৯-৫০ সালে দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চগড় অঞ্চলে ব্যাপক মুসলিম শরণার্থীর আগমন ঘটে। তেঁতুলিয়া এবং আটোয়ারীর মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গের এলাকাটি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ছিল বিহার রাজ্যের অন্তর্গত। এরপর ভারতের ভাষা ভিত্তিক হিসাবে রাজ্যের সীমানা পুনর্বিন্যাস করলে উক্ত এলাকাটি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় আসে। ১৯৯২ সালে ভারত-এর পশ্চিম দিনাজপুর ভেঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর নামে ভাগ করা হয়েছে। এছাড়াও দিনাজপুর রাজ্যের কিছু অংশ চলে যায় রংপুর, বগুড়া ও তৎকালীন রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমায় (বর্তমানে নওগাঁ জেলা)। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিন্যাস এর সময়ে আবারো খন্ডিত হয় দিনাজপুর। দিনাজপুর-এর অন্তর্গত অপর ২ মহকুমা ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় আলাদা জেলার মর্যাদা লাভ করে।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহ  | পঞ্চগড়ের মানচিত্র | পঞ্চগড় মুক্ত দিবস


তথ্যসূত্রঃ পঞ্চগড় : ইতিহাস ও লোকঐতিহ্য | পঞ্চগড় জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস | ড. নাজমুল হক 
Last updated: 20 June 2025

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

Place: পঞ্চগড়

Date: 1947-08-17