বৃহত্তর ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় অঞ্চলের বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজীতিবিদ, সমাজ হিতৈষী আলহাজ নূরুল হক চৌধুরী ছিলেন জনদরদী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ঠাকুরগাঁও পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় নূরুল হক চৌধুরী ঠাকুরগাঁও মহকুমার মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঠাকুরগাঁও মহকুমা থেকে ১৯৫৫-১৯৫৮, ১৯৬২-১৯৬৫ এবং ১৯৬৫-১৯৬৯ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২-১৯৬৫ মেয়াদে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ও ১৯৬৫-১৯৬৯ মেয়াদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পার্লামেন্টারী সেক্রেচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নূরুল হক চৌধুরী দিনাজপুর জেলা বোর্ডের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
জনাব নুরূল হক চৌধুরী ছিলেন বালিয়া স্টেটের সর্বশেষ জমিদার। বালিয়া চৌধুরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত জমিদার ও সমাজসেবক মেহের বকস্ চৌধুরী ছিলেন তাঁর নানা। নুরুল হক চৌধুরী ১৯০২ সালে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত দিনাজপুর জেলার তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার বালিয়া ইউনিয়নে সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হেকমতুল্লা চৌধুরী। তিনি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জনাব চৌধুরী রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আই.এ.পাস করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ডিস্টিংশনে বি.এ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ল’ পাস করে তিনি কলকাতাতেই কিছুদিন আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। নুরুল হক চৌধুরী এরপরে ঠাকুরগাঁওয়ে এসে আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। এখানে আইন পেশায় পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় পঞ্চগড়, বোদা, তেঁতুলিয়া, দেবীগঞ্জ ও আটোয়ারী থানা যাঁদের নেতৃত্বে পাকিস্তান অংশে আসে, আলহাজ নূরুল হক চৌধুরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
নুরুল হক চৌধুরী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর আজাদ ফৌজের ডেপুটি ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পক্ষে মুসলমানদের ভোটের ব্যাবস্থা করা হয়। ঠাকুরগাঁও এর জনগণ পাকিস্তানের পক্ষে আন্দোলন শুরু করে। ঠাকুরগাঁও হাইস্কুলের কয়েকজন শিক্ষক একই স্কুলের মুসলিম বোর্ডিং এর ছাত্রদের নিয়ে জননেতা নুরুল হক চৌধুরীর নের্তৃত্বে কাজ করতে থাকেন। ঠাকুরগাঁও পাকিস্তান অংশে পড়বে নাকি ভারত অংশে পড়বে এ নিয়ে কয়েকদিন উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কারণ দেশ বিভাগের তারিখ ঠিক হলেও রাডক্লিফ সীমানা কমিশনের রিপোর্ট তখনো প্রকাশ করা হয়নি। এ সময় ঠাকুরগাঁওয়ের লোকজন জানতে পারে যে ঠাকুরগাঁও মহকুমা বালুরঘাট জলপাইগুড়ি করিডর হিসেবে ভারতের অংশে পরিণত হচ্ছে এবং এজন্য সেতাবগঞ্জ সুগারমিলের ম্যানেজার মি.গোয়াংকা ভারত পাকিস্তান সীমারেখা নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা মিঃ রেডক্লিফকে নাকি একলাখ টাকা উপহার দিয়েছেন। এ সংবাদ প্রচার হবার পর ঠাকুরগাঁও এর ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। রুহিয়াতে মুসলীম লীগের জরুরি কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। নুরুল হক চৌধুরী এ সভায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। কনফারেন্স-এর ১ নং প্রস্তাব ছিল, যেহেতু ঠাকুরগাঁও মহকুমা একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল সেহেতু এটি পাকিস্তান অংশে হবার দাবিদার। তা সত্বও যদি ভারতের অংশ হিসেবে ফেলা হয় তবে এ এলাকায় অবধারিত দাঙ্গার আশংকা থাকবে। মুসলিম লীগ নেতা নুরুল হক চৌধুরী ঐদিনই প্রস্তাবের এক কপি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কংগ্রেস অফিসে এক কপি ও রেডক্লিফ-এর অফিসে জমা দেন। ঐতিহাসিক রুহিয়া কনফারেন্স এর ফলে এবং নুরুল হক চৌধুরীর প্রচেষ্টার কারনে সেই অঞ্চল গুলো পাকিস্তান এর অধিভুক্ত হয়।
আলহাজ নূরুল হক চৌধুরী দিনাজপুর জেলা পরিষদের সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর ধরে কাজ করেছেন। এ সময়ে তিনি ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় এলাকায় প্রচুর দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ১৯৫৮ সালে ঠাকুরগাঁও পৌরসভা গঠিত হলে তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তিনি ঠাকুরগাঁও মহকুমার মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে আলহাজ নূরুল হক চৌধুরী দিনাজপুর জাতীয় পরিষদ ২ আসন (বর্তমানে ঠাকুরগাঁও ১, ২ ও আংশিক ৩ আসন) থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে একই আসন থেকে জাতীয় পরিষদের দ্বিতীয়বারের জন্য এম.এন.এ নির্বাচিত হন। প্রথমবারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এবং পরবর্তী নির্বাচনের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী থাকা অবস্থায় ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন থানা ও ইউনিয়নে অনেকগুলো পোষ্ট অফিস স্থাপন করেন। একই সময়ে তিনি অত্র এলাকায় প্রচুর রাস্তা তৈরি করেছিলেন। তৎকালীন ইকবাল রোড(বর্তমান বঙ্গবন্ধু সড়ক) ঠাকুরগাঁও সুগার মিল ও ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়ক নির্মাণে অবদান রেখেছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় এক সময় চালু হয়েছিল ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তাঁর অবদান রয়েছে। ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়-এর প্রতিটি উপজেলায় বালিকা বিদ্যালয় (গার্লস স্কুল) সৃষ্টি তাঁরই অবদান। ঠাকুরগাঁও সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ঠাকুরগাঁও কাচারী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে আলহাজ নূরুল হক চৌধুরী খুব সহজ সরল সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি ১৯৭০ এর পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং আমৃত্যু নিজেকে জনহিতৈষী কাজে নিয়োজিত রাখেন। তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। সদালাপী ও বন্ধুভাবাপন্ন এই মানুষটি ১৯৮৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ৮৫ বছর বয়সে শূন্য ব্যাংক ব্যালেন্স ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি চৌচালা টিনের ঘর ও পিতৃপ্রদত্ত সম্পত্তি রেখে ইন্তেকাল করেন। তাকে ঠাকুরগাঁও পৌরসভাধীন মুন্সীপাড়া গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।
অত্র অঞ্চলের মহান নেতা নূরুল হক চৌধুরী ব্যক্তিগত জীবনে ২ ছেলে ও ১ মেয়ের পিতা ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র নিজ কর্মস্থলে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর ১ম পুত্র মরহুম এ্যাডভোকেট দুলাল চৌধুরী ছিলেন ঠাকুরগাঁও বারের নামকরা উকিল, ২য় পুত্র মরহুম কামাল চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তাঁর নাতি ব্যারিস্টার নূর উস সাদিক লিংকনস ইন থেকে পাস করা ঠাকুরগাঁও এর প্রথম ব্যারিস্টার এবং সুসাহিত্যিক। ব্যারিস্টার সাদিকের বিখ্যাত লেখা সহশ্রাংশু চোখ,লাশকাটা ঘর। তাঁর অন্য দুই নাতি এ্যাডভোকেট শফিক চৌধুরী ও এ্যাডভোকেট হাবিব চৌধুরী বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। তাঁর নাতনী স্নিগ্ধা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর বর্তমানে ঢাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল “অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল”র শিক্ষক। তাঁর একমাত্র জামাতা ঠাকুরগাঁও এর সুপ্রাচীন এম.বি.বি.এস. পাস করা চিকিৎসক মরহুম ডাঃ আজিজ। নুরুল হক চৌধুরীর দুই দৌহিত্র হলেন বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মরহুম ডাঃ মামুন,ও ডাঃ চপল। তাঁর দৌহিত্রী নাসরিন জাহান আইভি ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
জনদরদী ও কিংবদন্তি নূরুল হক চৌধুরী এই অঞ্চলের উন্নয়নে অবিস্মরণীয় অবদান রাখার পরেও তাঁকে সঠিক মুল্যায়ন করা হয়না। আজ অবধি তাঁর নামে কোনো স্থাপনার নামকরণ করা হয়নি। এমনকি তাঁর স্মরণ এ কোনো স্মৃতি সংসদ গঠনেরো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মুন্সিপাড়া গোরস্থান নূরুল হক চৌধুরী’র নামফলকহীন কবরটি বর্তমানে (২০২৫) পরে রয়েছে অরক্ষিতভাবে।
তথ্যসূত্রঃ চৌধুরী মোঃ সিফাত বিন সারোয়ার (নির্ণয় চৌধুরী) | ব্যারিস্টার নূর উস সাদিক | ঠাকুরগাঁও পরিক্রমা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য | শাহিদ জাকিরুল হক চৌধুরী | মোঃ আসাদুল ইসলাম (লিমন) | দিনাজপুরের ইতিহাস (লেখকঃ ড.মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান) | দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র-৫ (লেখকঃ মেহরাব আলী) | সংগ্রামী ঠাকুরগাঁও ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ (লেখকঃ মোঃ এমদাদুল হক)
Last updated: 11 June 2025