বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির অংশ শতবর্ষ পুরনো ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলির মধ্যে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার আলোয়াখোয়া রাশ মেলা অন্যতম। পঞ্চগড়ের গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে মিশে রয়েছে পালা পার্বণিক এই মেলাটির আয়োজন। প্রতিবছর হেমন্তে ঘরে ঘরে নতুন ধানের নবান্নের আয়োজনের মধ্যেই বসে ২০০ বছরের আটোয়ারী আলোয়াখোয়া রাশ মেলা। উনবিংশ শতাব্দীতে আটোয়ারীর সীমান্তঘেষা বালিয়া এলাকায় নাগর নদীর তীরে চালু হওয়া আলোয়াখোয়া রাশ মেলাটি একবিংশ শতাব্দীতে এসে আটোয়ারী উপজেলার নিরাশি নামক স্থানে কালের সাক্ষী হয়ে আয়োজিত হয়ে আসছে।

আলোয়াখোয়া জমিদার তারিনী প্রসাদ রায়ের উদ্যোগে নাগর নদীর তীরে উনবিংশ শতকের ষাটের দশকে কার্তিকের রাধাকৃষ্ণের মিলন উপলক্ষে সৃষ্টি হওয়া আলোয়াখোয়া রাশ মেলা সময়ের ধারাবাহিকতায় জমিদার শ্যামা প্রসাদ রায়ের (বাচ্চা বাবু) সময় কালে বিশাল বিস্তৃতি লাভ করে ঐতিহাসিক মেলা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। আটোয়ারী উপজেলার প্রয়াত রাজনীতিবিদ ও সাবেক আইন মন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ ১৯৯৩ সালে আটোয়ারীতে আলোয়াখোয়া রাশ মেলাআয়োজন শুরু করেন। সেই সময়ে থেকে এই রাশ মেলা চলমান রয়েছে। স্থানীয় লোক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক ঐতিহাসিক আটোয়ারী আলোয়াখোয়া রাশ মেলা প্রতিবছর স্থানীয় জনমানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। হিন্দু ধর্মের রাশ পূর্ণিমা তিথি উপলক্ষে প্রতি বছর রাশ ঘুরানোর মাধ্যমে আটোয়ারী মির্জা গোলাম হাফিজ ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন মাঠে বসে ঐতিহ্যবাহী আলোয়াখোয়া রাশ মেলা। পূর্ণিমার রাতে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ রাজবেদীতে পূজা শুরু হয়। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ঈশ্বরকে খুশি করতে আসেন মাসব্যাপী এই উৎসবে।
আটোয়ারী আলোয়াখোয়া রাশ মেলার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর পূর্বে ব্রিটিশ আমলে আঠারো শতকের শুরুর দিকে উত্তরাধিকার সূত্রে ১৫৩ নং লাট ঝারগাঁওয়ের জমিদার শ্রী তরীনি প্রসাদ রায় চৌধুরী তাঁর বাসস্থানের দক্ষিণে বর্তমান বাংলাদেশ ভারত উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নাগর নদীর কোল ঘেঁষে একটি রাশ মন্দির স্থাপন করেন। বাংলা বর্ষ কার্তিক মাসের রাশ পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে পুজোর সময়ে সেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটতো, যা একসময় মেলায় রূপ নেয়। মন্দির সংলগ্ন সম্পূর্ণ এলাকাটি কাশবন বা ছন ঘাস দ্বারা আবৃত থাকতো। কথিত আছে, ইলুয়া বা কাশ কেটে মেলা বসানো হয় বলে মেলার নাম আলোয়াখোয়া। অথাৎ ইলুয়া থেকে আলোয়া, ইলুয়ার মোড়া থেকে খোয়া মিলে মেলার নাম হয় আলোয়াখোয়া মেলা। বর্তমানের আলোয়াখোয়া ইউনিয়ন-এর নাম এই আলোয়াখোয়া মেলা থেকেই এসেছে।
নাগর নদীর তীরে জমিদার শ্রী তরীনি প্রসাদ রায় চৌধুরী রাশ মেলাটি স্থাপন করলেও জমিদার পুত্র শ্রী শ্যামা প্রসাদ রায় চৌধুরী যিনি বাচ্চা বাবু নামেই অত্র এলাকায় আজও পরিচিত, তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই মেলাটি মন্দির সংলগ্ন এলাকাজুড়ে অধিক বিস্তৃতি পেয়ে আন্তর্জাতিক রুপ পরিগ্রহ করে। আলোয়াখোয়া রাশ মেলার খ্যাতি ক্রমান্বয়ে দূর দূরান্ত পর্যন্ত পরিব্যাপ্তি লাভ করে। জনশ্রুতি আছে এই মেলায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা যেমন ভুটান, নেপাল, কাশ্মীর; এমনকি সুদূর ইরান থেকেও লোকজন এসে হাতি, ঘোড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ কেনাবেচা করতেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে নাগর নদীটি আন্তর্জাতিক সীমারেখায় পরিণত হয়। এই সময় সীমানা নিরাপত্তার অজুহাতে উক্ত স্থানে মেলার আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ১৯৫৯ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া মহকুমায় রামনাথ এলাকার ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে আলোয়াখোয়ার মেলার নিয়মে রাজপূর্ণিমা তিথিতে রুহিয়া আজাদ মেলা নামে একটি মেলার আয়োজন শুরু হয়। ১৯৯৩ (বাংলা ১৪০১) সাল পর্যন্ত রুহিয়া আজাদ মেলা এ অঞ্চলের একমাত্র মেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯৩ মেলা আটোয়ারী মির্জা গোলাম হাফিজ ডিগ্রি কলেজের ম্যানেজিং কমিটি রুহিয়া আজাদ মেলা কমিটির কাছে মেলার আয়ের অংশ দাবী করলে উক্ত কমিটি তা প্রত্যাখান করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ-এর প্রচেষ্টায় ২৮ নভেম্বর ১৯৯৩ সালে আটোয়ারী উপজেলা মির্জাপুর ইউনিয়নের নিরাশি নামক স্থানে পুনরায় শুরু হয় এবং১৯৯৫ সালে আটোয়ারী আলোয়াখোয়া রাশ মেলা নতুন রূপে ব্যাপক জাকজমকভাবে আয়োজন করা হয়। স্থানীয়দের মতে মেলার নামকরণ, উদযাপনের স্থান ও সময়, মেলাটির বিস্তৃতি এবং জনসম্পৃক্ততার পরিপ্রেক্ষিতে নগর নদীর তীরের ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাশ মেলাটি পূর্ণরূপ লাভ করে আটোয়ারীতে ১৯৯৩-৯৫ সালে। তারপর থেকেই আটোয়ারী আলোয়াখোয়া রাশ মেলা নামে প্রতি বছর আটোয়ারী মির্জা গোলাম হাফিজ ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। উল্লেখিত রুহিয়া আজাদ মেলাটিও এখনো প্রতি বছর আয়োজন করা হয়।

১৯৯৫ সালে মির্জা গোলাম হাফিজ ও মেলা কমিটি নাগর নদী তীরের ঐতিহাসিক রাশ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু করেন। অর্থাভাবে এই রাশ মন্দিরের নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে কয়েক বছর ধরে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নির্মাণাধীন মন্দিরের পাশে টিনের চালা আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করে পূজা-অর্চনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক কালে পুরাতন আলোয়াখোয়া মেলার আদি স্থানে রাশ ঠাকুরের নামে প্রায় কয়েক একর জমি রয়েছে বলে অনুসন্ধান পাওয়া যায়। ঐ এলাকার কয়েক জন কৃষক রাশ ঠাকুরের সম্পত্তি অবৈধভাবে ভোগদখল করছে এবং কিছু সম্পত্তি অবৈধ ভাবে চা কোম্পানীর কাছে বিক্রি করেছে বলেও জানা যায়। ঠাকুরের সম্পত্তি উদ্ধার ও রক্ষার স্বার্থে বাংলা ২০০৭ সালে রাশ পূর্ণিমা তিথিতে পুনরায় স্বল্প পরিসরে রাশ ঘুরা ও একবেলা মেলা স্থাপন শুরু করা হয়। ঐতিহাসিক আলোয়াখোয়া মেলা আবার ধীরে ধীরে পূনর্জন্ম লাভ করে। ২০০৭ সাল থেকে সরকারের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে নাগর নদী তীরের আদি স্থানে সীমিত পরিসরে ২ অথবা ৩ দিনের জন্য আলোয়াখোয়া রাশ মেলাটি উদযাপিত হয়ে আসছে। রাশ পূর্ণিমা তিথি উপলক্ষে প্রতিবছর আটোয়ারীর সীমান্তঘেষা বালিয়া এলাকায় নাগর নদীতে পূণ্যস্নান করতে সমবেত হয় হাজার হাজার পূর্ণার্থী।
আটোয়ারী আলোয়াখোয়া রাশ মেলার প্রতি বছরের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, ব্যবসায়ী মহল, গণমাধ্যম কর্মীরা সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত থাকেন। আলোয়াখোয়া রাশ মেলা ডাঙ্গা এবং হেটো এই দুই ভাগে বিভক্ত। ডাঙ্গার উত্তর-পূর্ব অংশে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য। পশু কেনাবেচা আলোয়াখোয়া রাশ মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। হেটো অংশে থাকে মনোরম পরিবেশে সুস্থ্য বিনোদন ও আমোদ-প্রমোদের জন্য সার্কাস, মটরসাইকেল/গাড়ী খেলা, পুতুল নাচ,যাত্রা, জাদু, নাগোর দোলা-সহ নানা চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা। মেলায় নিয়মিত মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং উম্মুক্ত মাঠে আঁতশবাজির আয়োজন করা হয়। সমগ্র মেলাজুড়ে ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রীর বিপণন তথা মাটি, কাঠ ও স্টিলের আসবাব, খেলনাসহ নানা রকমারী খাদ্য সামগ্রির দোকান বসানো হয়।
আটোয়ারী উপজেলা পরিষদ এবং মেলা কমিটি মেলার সার্বিক আয়োজনের দায়িত্বে থাকে। পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে মেলার ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার বিষয়টি তদারক করা হয়। মেলায় আগত দর্শনার্থী সহ সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে চব্বিশ ঘন্টা নিয়োজিত থাকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্মানিত সদস্যগণ সহ মেলা পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দ। মেলা হতে উপার্জিত অর্থ পঞ্চগড় জেলার সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হয়।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য ঘটনা প্রবাহ
তথ্যসূত্রঃ সুজন চন্দ্র বর্মন (আপন) | আলোয়াখোয়া ইউনিয়ন পরিষদ তথ্য সেবা কেন্দ্র
ছবিঃ সুমন বকুল
Last updated: 6 April 2025