ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় হিমালয়কন্যা খ্যাত পঞ্চগড় ব্যতিক্রম একটি শহর। জেলার ভূভাগে রয়েছে বিভিন্ন আকারের প্রচুর নুড়ি পাথর, আর এই ভূগর্ভের নুড়ি পাথরের বিভিন্ন কালানুক্রমিক নমুনা নিয়ে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র পাথরের সংগ্রহশালা পঞ্চগড় রকস্ মিউজিয়াম। ইতিহাস অন্বেষণ, অনুসন্ধান এবং জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে পঞ্চগড় রকস্ মিউজিয়াম ভ্রমণ হতে পারে আপনার একটি অনন্য ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। রকস্ মিউজিয়ামে পাথর বা শিলাখণ্ডের নানা দুর্লভ সংগ্রহের পাশাপাশি রয়েছে পঞ্চগড় জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও লোকজ উপাদানের বিশাল সংগ্রহশালা। রকস্ মিউজিয়াম শুধু পঞ্চগড়ের নয়, সারা দেশের পর্যটক ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক মনোমুগ্ধকর দর্শনীয় স্থান।
রকস্ মিউজিয়াম – সংগ্রহশালাঃ পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের মূল ফটক পার হলে ডান পাশে দেখা যায় ছোটবড় পাথরে সাজানো মাঠের একাংশ। পাথরের এ জাদুঘরের সামনে গোল চক্করের অবয়বে বেশ কয়েকটি বড় আকারের শতবছর পুরনো পাথর বসানো রয়েছে। রকস্ মিউজিয়ামে অভ্যন্তরীণ ও উন্মুক্ত দুই রকমের গ্যালারি রয়েছে। মিউজিয়ামে সংগৃহীত সবকিছু বর্ণনাসহ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটি পাথরের পাশে লেখা রয়েছে কোন স্থান থেকে এবং কারা সংগ্রহ করেছেন এ মূল্যবান প্রত্নসম্পদ।
উন্মুক্ত গ্যালারিতে রয়েছে বিশাল আকৃতির বেলে পাথর, গ্রানাইট পাথর, কোয়ার্জাহিট, ব্যাসল্ট, শেল, মার্বেল বিভিন্ন নামের ও বর্ণের শিলা। সিলিকায়িত কাঠ বা গাছ থেকে পাথর, নকশা করা অলংকৃত খিলান ও বিভিন্ন রেখা, লেখা ও চিত্রাঙ্কিত শিলা এবং ধূসর ও কালো রঙয়ের কাদা। একটি পাঁচফুট লম্বা কোয়ার্জাইট পাথর স্থাপিত হয়েছিল সম্ভবত কোনো সমাধিক্ষেত্রে।
ভবনের নিচতলার বড় কক্ষটিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা সময়ে সংগ্রহ করা নানা আকার আর রঙের দুর্লভ কিছু পাথর। লম্বাটে, গোলাকার; সাদা, হলুদ, কালো। পাথরের পাশাপাশি অন্যান্য আরও কিছু সংগ্রহও আছে। আছে প্রাচীনকালের মূর্তি, টেরাকোটা বা পোড়ামাটির নকশা, প্রাচীন মুদ্রা। রয়েছে জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ আস্ত শাল গাছের বিশাল আকৃতির ঐতিহ্যবাহী ডিঙি নৌকা।
রকস্ মিউজিয়াম-এ কি কি আছে?
(ক) বড় আকারের বেলেপাথর, গ্রানাইড, কোয়ার্জাইট, ব্যাসল্ট শেল শ্রেণি সংগ্রহ, মার্বেল, মাইকাসিস্ট ও নাইস। ৩-৪ ইঞ্চি থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত আকারের প্রায় ৬০ টি প্রত্নতাত্ত্বিক শিলা সংরক্ষিত আছে মিউজিয়ামে।
(খ) প্রস্তরীভূত কাঠ বা কাঠ থেকে রূপান্তরিত শিলা যা প্রস্তরীভূত কাঠ শ্রেণির সংগ্রহ।
(গ) নকশা, চিহ্ন, অলংকৃত খিলান ও পাথর। বিভিন্ন রেখা, চিত্র, অক্ষরচিহ্ন সংবলিত পাথর।
(ঘ) ধূসর ও কালো রঙের বড় বড় পাথর। বিভিন্ন আকৃতির রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয় পাললিক রূপান্তরিত কংলোমারেট বা নুড়িপাথর।
(ঙ) সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি শ্রেণির সুন্দর ছোট পাথর।
(চ) হলুদ ও গাঢ় হলুদ রঙের বালি, কাচ বালি, খনিজ বালি, সাদা কাদাসহ নানা বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ বালি।
(ছ) লাইম স্টোন, তরঙ্গায়িত চ্যাপটা পাথর। কঠিন শিলা, পলি ও কুমোর মাটি।
(জ) সুলতানি আমলের ইট ও মসজিদ এবং কবরে ব্যবহার করা মধ্যযুগীয় ইট, পাথর, চুন ও সুরকি।
(ঝ) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পঞ্চগড়ের নৃগোষ্ঠীর ব্যবহার করা নানা দ্রব্যসামগ্রী ও ধর্মীয় নিদর্শনাদি।
(ঞ) আদিবাসীদের ব্যবহার করা খোচালো, ছোনোহাটা বা ঢাকি, বারুন, কুলা, ব্যবহার করা আধুনিক ধাতবপত্র, শিকারের অস্ত্র, বিয়ের ঢালা, কিয়া সিঁদুর, কাঠের চিরনি, বল্লম, তীর-ধনুক, আরশি, পেচি, খোট, কড়ি, তুলসী ও পুঁথির মালা। বসার খাট-সহ পাট ও বাঁশ দিয়ে তৈরি দ্রব্যসামগ্রী। সাকামচুকি, সাঁওতাল বিড়ি ইত্যাদি।
(ট) সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে আসা মনসা মূর্তি (মাটি), হাতির পৃষ্ঠে সাওয়ায়ী (মাটির তৈরি), কলনাগ (মনসা) লোহার তৈরি, বিষহরী (পিতল), বিষ্ণুমূর্তি (ব্রোঞ্জ), মনসা দেবী (একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী), গঙ্গাদেবী (পিতল ও কাসার মিশ্রণ), গণেশ মূর্তি, মসৃণ কালো পাথর (শিবলিঙ্গ), চুন-সুরকির মূর্তি ইত্যাদি।
(ঠ) উত্তরাঞ্চলে ব্যবহার করা বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র। আনুমানিক ১০০ থেকে ৩০০ বছর আগের, খেলনা, প্রাণী, হুকার মুখ, প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, চেরাগদানি, ছিদ্রযুক্ত নল, গুটি মৃৎপাত্র, নানা রকমের পাহাড়পুরে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের অনুরূপ ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র (১২০০ শতকের), হনুমান মূর্তি (পোড়ামাটি), কাপড় নকশা করার ছাঁচ, কুয়োর রিং ও পাতিল।
(ড) ১৮৬২ সালের ব্রিটিশ ভারতীয় মুদ্রা ও ১৯৬৯ সালের পাকিস্তান শাসনামলের মুদ্রা সহ ৬৬টির অধিক মুদ্রা এখানে সংগৃহীত রয়েছে।
(ঢ) ধাতব কলস, গ্যাসজাতীয় পদার্থের কাচের বোল, গাছা, বাউলি, আগর, সুলটি, হাতুড়ি (কাঠ), তেল-উত্তোলক, কুঠি (কোশ দিয়ে তৈরি), পাথরের সেতুতে ব্যবহার করা আয়ুধ, পাথরের সিল, নৌকার গলাই ও ব্যবহার করা পিতলের চোখ, খইঞ্চা খাওয়ার গ্লাস (কাসা), ইঁদুর ধরার লোহার ফাঁদ, ধাতব পাত্র প্রভৃতি।
(ণ) ২০০ বছর পুরাতন কাঠের সিন্দুক, ১২৫ বছর পুরনো গাড়িয়ালের চাকা।
(ত) আগের যুগে ব্যবহার করা কলের গান, অলংকৃত পাখা, ১৯২২ সালে নির্মিত ঘরের বেড়া হিসেবে ব্যবহার করা বাঁশের বেড়া (হাতি, ফুল, মাছ, ছাত্রা, ঘোড়া প্রভৃতির নকশাবিশিষ্ট), সামুদ্রিক ঝিনুক ও শঙ্খ, কাঠের পানকৌটা, বাঁশের তৈরি লবণের কৌটা, ঠুমি, ঠসা (বাঁশের তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র), টারশিকিয়া, কাচিয়া, কাস্তি/কাঠাই, ডাহরই, ফুতি খড়ম, খড়ম, টপুনি, তাড়ি, খনা, বঁ, বেঁও, খমক (বাদ্যযন্ত্র), কাঠের সিন্দুকে ব্যবহার করা পাসি, খুচিং, কাঠা, দন, দরুয়া, একতারা, দোতরা, ঢেঁকি, ঢোল, মাথাল প্রভৃতি।
(থ) ভিমরুলের চাক (সাততলা বিশিষ্ট), অশ্মীভূত পিঁপড়ার বাসা, খোকমাছির চাক, হাতির দাঁত, গোবরে পদ্মফুল, হনুমানের মাথা (কাঠ), পঞ্চগড়ের প্রথম মহকুমা প্রশাসক ও জেলা প্রশাসকের ব্যবহার করা চেয়ার, মোঘল সৈনিকের ব্যবহার করা তরবারি, তলোয়ার ইত্যাদি।
(দ) জাদুঘরে দুটি বৃহৎ শালকাঠের নৌকা সংরক্ষিত রয়েছে। বড় নৌকাটির দৈর্ঘ্য ৩৫ ফুট এবং ছোট নৌকাটির দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট। এগুলোর আকার ও আকৃতি বর্তমান বাংলাদেশে প্রাপ্ত নৌকার সাথে মেলে না। ধারণা করা যেতে পারে যে, সেগুলো আদিবাসীদের দ্বারা নির্মিত ও ব্যবহৃত হতো।
তুলনামূলক বড় ডিঙ্গি নৌকাটি পঞ্চগড় থানার অমরখানা গ্রামের চাওয়াই নদীর মাহানতের ঘাট থেকে ৮ ফুট নিচে খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে।একটিমাত্র গাছ খোদাই করে নির্মিত। প্রাচীনকালে আদিবাসীরা সম্ভবত এই ডিঙ্গি নৌকাটি ব্যবহার করেন। এ ধরনের নৌকা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ পুঞ্জে প্রাচীনকালে আদিবাসীরা ব্যবহার করত। যুদ্ধের নৌকা হিসেবেও ব্যবহার করত। প্রদর্শিত এই নৌকাটির নির্মাণকালের বয়স আনুমানিক প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর হতে পারে এবং নৌকাটি শালকাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। নৌকাটির আকৃতি দেখে মনে মনে হয় এটি ডিঙ্গিজাতীয় নৌকা।নৌকাটির প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে বুকানন হ্যামিলটনের মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চগড়ে এসে করোতোয়া নদীতে একটি মাঝারি প্রকৃতির প্রবহমান নৌকা দেখতে পান। এই নদীবক্ষে ভজনপুর এলাকায় ১৫ টন এবং পঞ্চগড় এলাকায় ৩৫ টন ওজনের মালবাহী জাহাজ ও নৌকা চলাচল করত। অনুমান করা যায়, করোতোয়া নদীটির স্রোতধারা অত্যন্ত প্রবহমান এবং নদীটি গভীর ছিল। বোধকরি সে কারণে বাণিজ্যিক পণ্যবাহী জাহাজ এই নদীপথে চলাচল করত। আলোচ্য কাঠের তৈরি নৌকাটিতে নৌকাবাইচ হতো। প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাকে বা অন্য কোনো কারণে হয়তো নৌকাটি ডুবে যায়। সেটি পরবর্তীকালে আর উদ্ধার করা সম্ভব না হলে ক্রমান্বয়ে আস্তে আস্তে বালি আর মাটিচাপা পড়ে ঢেকে যায়।
(ধ) মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার ছবি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি ও পলাশীর প্রান্তর। শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের ছবি, উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের ছবি ইত্যাদি। সাম্প্রতিক সময়ে মিউজিয়ামের সাথে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার তৈরি করা হয়েছে।
(ন) পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের জন্য ব্যবহৃত প্রথম চেয়ার।
(প) রকস্ মিউজিয়ামে প্রাঙ্গনে রয়েছে ড.নাজমুল হক-এর নিজহাতে গড়া পঞ্চগড়ের প্রথম চা বাগান। নাজমুল হক ১৯৯৮ সালে পঞ্চগড়ে চা শিল্পের সূচনা করেন।
(ফ) রকস্ মিউজিয়ামে রয়েছে পঞ্চগড়ের সর্বপ্রথম ব্যবহৃত কম্পিউটার।
পাথর বা শিলা’র ধরণ প্রধানত তিনটি- আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা এবং রূপান্তরিত শিলা। রকস্ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত শিলাগুলোর মধ্যে তিন ধরনের শিলাই উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রানাইট, বেলেপাথর, চুনাপাথর, সিস্ট, সিলিকা প্রভৃতি। এখানে সংরক্ষিত শিলাগুলোকে তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নাজমুল হক এবং নাজিবা সাইয়ারা তাঁদের ‘Rocks Museum: A Key for Uncloaking Ancient Human Habitation’ গ্রন্থে শিলাগুলোকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন- পরিবেশগত শিলা, প্রত্নতাত্ত্বিক শিলা, নৃতাত্ত্বিক শিলা এবং জাতিতাত্ত্বিক শিলা।
সেগুলোর মধ্যে পরিবেশগত শিলা বলতে বিভিন্ন উপাদানে তৈরি আগ্নেয়, পাললিক এবং রূপান্তরিত শিলাকে বোঝানো হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক শিলা বলতে বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবহার্য শিলাখন্ডকে বোঝানো হয়েছে- যেগুলো দ্বারা প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বোঝা সম্ভব। যেমন- সমাধি কিংবা বিভিন্ন স্থানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত শিলাখন্ড দ্বারা নির্মিত পাথরের স্লাব প্রভৃতি। নৃতাত্ত্বিক শিলা বলতে মানুষের ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ বহন করে এমন নিদর্শন যেমন বিভিন্ন আকৃতি দিয়ে কাটা শিলা যেগুলো কোনো বৃহৎ শিলার অংশ হতে পারে৷ এছাড়াও পাথরের তৈজসপত্র, পাথরের হাতিয়ার, বিভিন্ন ধরনের চিত্র বা সংকেতযুক্ত শিলাখন্ড৷ রকস্ মিউজিয়ামে বিভিন্ন ধরনের পাথর এবং পাথরের তৈরি উপাদান ছাড়াও রয়েছে দুটি বৃহৎ শালকাঠের নৌকা। ধারণামতে সেগুলো প্রায় হাজার বছরের পুরনো। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, ভিতরগড় প্রত্নস্থান থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের প্রত্ননির্দশন যেমন ইট, এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া মুর্তি, বাঁশের তৈরি নিদর্শন প্রভৃতি।
কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হল রকস্ মিউজিয়ামঃ ১ মার্চ ১৯৯৭ সালে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে তৎকালীন অধ্যক্ষ ড.নাজমুল হক সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে রকস্ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক এএফএম সাইফুল ইসলাম ১৯৯৭ সালের ২৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে মিউজিয়ামটি উদ্বোধন করেন। ১৯৯৭ সালে রকস্ মিউজিয়ামটি প্রথমে সরকারি মহিলা কলেজের একটি কক্ষে স্থাপিত হলেও পরে নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। ২০০৮ সালে এলজিইডি বিভাগ থেকে একটি দ্বিতল ‘রকস ভবন’ নির্মাণ করে দেওয়া হয় জাদুঘরের জন্য।
পঞ্চগড় রকস্ মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ড.নাজমুল হক ৯০’এর দশকে তাঁর গবেষণাকর্মের প্রাথমিকপর্যায়ে সমগ্র পঞ্চগড় জেলাজুড়ে বিভিন্নধর্মী পাথরের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। তিনি উপলব্ধি করেন সমতলভূমি পঞ্চগড় জেলায় পার্বত্য ভূমি না থাকায়, এই পাথরগুলো অন্য কোনো অঞ্চল থেকে এসেছে। পঞ্চগড়ের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ও দার্জিলিং সীমান্ত হিসেবে এ জেলাকে বেষ্টিত করে রেখেছে। ভারতের এই অঞ্চলগুলোতে বিশেষ করে হিমালয় পর্বতমালা নানা ধরনের শিলা পাওয়া যায়। পঞ্চগড় জেলাকে বেষ্টিত করে রেখেছে তিনটি বড় নদী- করতোয়া, মহানন্দা ও তিস্তা এবং এখানে রয়েছে আরোও প্রায় ২০টি ছোট নদী। এই নদীগুলোর উৎপত্তি হিমালয় বেল্ট, ভুটান, সিকিম এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৷ ড.হক অনুধাবন করেন পঞ্চগড়ে প্রাপ্ত সেই বৃহদাকার পাথরগুলো নদী দ্বারা বাহিত হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে অথবা কারো দ্বারা এখানে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রকৃতি কিংবা মানুষের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে এই পাথরগুলোর সাথে ৷
সেই অনুধাবনের ভিত্তিতেই ড.নাজমুল হক শিলাখন্ডগুলোকে সংগ্রহ করা শুরু করেন। জাদুঘর গড়তে প্রথমদিকে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাথর সংগ্রহ করেছেন, পরে নিয়েছেন স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তাও। তিনি শিলাখণ্ডের বয়স নির্ণয়, ভূ-বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান, প্রাগৈতিহাসিক কালের নমুনা সংগ্রহ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক পাথরের জাদুঘরটি স্থাপন করেন।
১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চগড় রকস্ মিউজিয়ামের শিলা এবং সকল উপাদান সংগ্রহকাল ১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। ড.নাজমুল হক পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে সেই দীর্ঘ সময়ে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে মিউজিয়ামের সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। ড.নাজমুল হক-এর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এবং এর চমৎকার প্রদর্শনী মিউজিয়ামটিকে পঞ্চগড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেছে।
কখন যাবেনঃ দেশের মধ্যে একমাত্র পাথরের জাদুঘর হওয়ায় বছরজুড়েই দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এখানে ঘুরতে আসেন । শীতকালে পঞ্চগড়ে চা বাগান ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসা অধিক সংখ্যক পর্যটক রকস্ মিউজিয়াম দেখতে আসেন। তখন দর্শনার্থীদের চাপে কর্তৃপক্ষকে বন্ধের দিনও কলেজ ক্যাম্পাস খোলা রাখতে হয়।
(ক) মিউজিয়াম সপ্তাহে ছয় দিন খোলা থাকে (মঙ্গলবার বন্ধ থাকে)।
(খ) সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীগণ মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে পারবেন।
(গ) সরকারি ছুটি ও পরীক্ষার দিন ব্যতীত পঞ্চগড় রকস্ মিউজিয়াম দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
অবস্থানঃ সরকারি মহিলা কলেজ, পঞ্চগড় সদর। পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে আধাকিলোমিটার পূর্বে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর পঞ্চগড় রকস্ মিউজিয়াম-এর অবস্থান।
কিভাবে যাবেনঃ পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল অথবা পঞ্চগড় রেল স্টেশন থেকে যেকোনো লোকাল পরিবহন (অটোরিক্সা বা ভ্যান) যোগে ১০-১৫ মিনিটে পৌঁছাতে পারবেন রকস্ মিউজিয়ামে। …Travel Tips | Accommodation | Tourist Spots
প্রবেশ ফি ও নিয়মাবলীঃ মিউজিয়াম তত্ত্বাবধান ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বহন করার জন্য প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।(ডিসেম্বর ২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী)
(ক) দর্শনার্থী ফি ২০ (বিশ ) টাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য ফি ১০ (দশ) টাকা
(খ)মিউজিয়ামের নিদর্শনসমূহ স্পর্শ করা যাবেনা।
(গ)মিউজিয়ামে রক্ষিত পরিদর্শন বহিতে আপনার মূল্যবান মতামত দিতে পারেন।
(ঘ)মিউজিয়ামটি সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত।
বর্তমান ব্যবস্থাপনাঃ দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চগড় রকস্ মিউজিয়াম। বর্তমানে মিউজিয়ামটি পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অধীনে রয়েছে ৷ মিউজিয়াম পরিচালনার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে থেকে ৫ টাকা করে মিউজিয়াম ফি এবং মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নের জন্য দর্শনার্থীদের কাছ থেকে প্রবেশমূল্য নেয়া হয়।
বর্তমানে জাদুঘরটির সংরক্ষণ ও পরিচালনার জন্য কিউরেটরের অভাব ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপনায় পেশাদারির ঘাটতি রয়েছে। দুইতলা ভবনটি জাদুঘরের জন্য নির্মিত হলেও বহুমূল্যবান অনেক পাথর কলেজ প্রাঙ্গণে উন্মুক্তভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে ৷ দীর্ঘকাল ব্যবহারে কারণে শোকেস ও আসবাবপত্র, লেবেলিং কিছুটা পুরনো হয়ে পড়েছে।
রকস্ মিউজিয়ামের সংগ্রহ গুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে ইতিহাস সমৃদ্ধ অন্যতম জাদুঘর হিসাবে পরিচিতি পাবে। কয়েকশো বছরের পুরনো বিভিন্ন স্মারক ও সংগৃহিত উপকরণগুলোর তদারকি সঠিকভাবে করা হলে, তা গবেষণায় ও প্রত্নতত্ব নিদর্শন অনুসন্ধানে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
পঞ্চগড় মিউজিয়ামের গুরুত্বঃ বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এ অঞ্চলে পাথরের নিদর্শন তেমন পাওয়া যায়না। বিভিন্ন স্থাপনায় ইট, সুড়কির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়৷ তদুপরি, পাথরের যে নিদর্শনগুলো পাওয়া গিয়েছে সেগুলোও সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি বললেই চলে ৷ অথচ এই ভিন্নধর্মী রকস্ মিউজিয়ামটি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ ৷ রকস্ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত পাথরগুলো নব্যপ্রস্তরযুগের প্রমাণ বহন করছে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠাতা ড.নাজমুল হক। অনেকগুলো পাথর পাওয়া গেছে ভিতরগড় এলাকায়, ধারণা করা হয় যে সেগুলোও অনেক পুরনো। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু পাথর সেতু নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে ৷ এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে পাথরের ব্যবহার লক্ষণীয়। বিভিন্ন পাথরের গায়ে জ্যামিতিক নকশা, তীর ধনুক, মানুষের চোখ ইত্যাদি অঙ্কিত রয়েছে৷ এছাড়াও কিছু কিছু সংকেত নেপালি, ব্রাহ্মি এবং চিনা লিপির সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বলে নাজমুল হকের পূর্বোক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে৷ অন্যদিকে, পাথরের হাতিয়ার নিঃসন্দেহে প্রাগৈতিহাসিক পাথরের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে ৷ এখানে সংরক্ষিত অনেক পাথরের সাথে অতীত মানুষের ধর্মীয় রীতির সংশ্লিষ্টতা থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়া যায় না। পাশাপাশি, এই নিদর্শনগুলো হিমালয়ের পাদদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের পরিচয় বহন করতে পারে। রকস্ মিউজিয়ামে আছে হাজার বছর পুরনো বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক পাথর খন্ড। যেখানে আমরা বিভিন্ন যুগের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি, তাঁদের কৃষ্টি কালচার জানতে পারি, তাঁরা কি ধরণের সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতো, তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবন কেমন ছিল তা জানতে পারি।
পাথরগুলোর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, পার্শ্ববর্তী দার্জিলিংয়ের সমকালে পঞ্চগড় অঞ্চলেও নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ ভালোভাবেই বিস্তার ছিল। বাংলাদেশে এখনো প্রত্ন ঐতিহাসিক ও প্রস্তর যুগের হাতিয়ার ও উপকরণ খুব বেশি একটা পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান অব্যাহত রাখলে পঞ্চগড় জেলায় হয়তো প্রস্তর যুগের প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হতে পারে। আঞ্চলিক ঐতিহ্যের প্রাচীন ইতিহাসকে জীবিত রাখতে দেশের দুর্লভ এই মিউজিয়ামকে সংরক্ষণ গুরুত্ববহ।
তথ্যসূত্রঃ ড.নাজমুল হক | উম্মে হালিমা শ্রাবনী | নুরুল হুদা বাবু | কামরুজ্জামান (বিএসডিএ, দিনাজপুর)
Last updated: 27 December 2023