পঞ্চগড় জেলার প্রথম চা বাগান – First Tea Garden

পঞ্চগড় জেলার প্রথম চা বাগান
পঞ্চগড় মহিলা কলেজ, পঞ্চগড় সদর।

ম্যাপঃ Google map

গত দুই দশকে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমির চা-শিল্পে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যেসব উঁচু জমিতে কোনো ফসল হতো না, পতিত অবস্থায় পড়ে থাকত, সেসব জমিতে চা চাষ করে এ জেলার আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে চা-চাষিদের। পঞ্চগড়ে প্রতিষ্ঠিত চা-শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছিল পঞ্চগড়ের প্রথম চা চাষের উদ্যোগ থেকে।

পঞ্চগড় জেলার প্রথম চা বাগানটির অবস্থান পঞ্চগড় মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে। প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পঞ্চগড়ে চা-চাষের সূচনা করেন ড. নাজমুল হক। পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শীর্ষস্থানীয় গবেষক ও লেখক জনাব ড. নাজমুল হক পঞ্চগড় মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে কর্মরত থাকাকালীন এখানকার খনিজ সম্পদ (নুড়ি পাথর), চা উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বলেন এবং প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পঞ্চগড়ে চা-চাষের সূচনা করেন। পঞ্চগড়ের প্রথম এই চা বাগানটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯৮ সালে।

ড. নাজমুল হকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে পঞ্চগড় মহিলা কলেজে পঞ্চগড়-এর প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠার কাহিনী প্রথম চা বাগান তথ্য ফলকে উধৃত আছে এভাবেঃ

রকস মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব রবিউল ইসলাম আমাকে বল্লেন,”অধ্যাক্ষ সাহেব, পঞ্চগড় জেলার মাটি চা বাগান তৈরীর জন্য উপযুক্ত। আপনি একটা চা বাগান করতে পারবেন না?” আমি বলি- “কেনো নয়? ১৫দিন অপেক্ষা করুন।” মিরগড় সীমান্তের ওপারে ভারতের ডানকান কোম্পানির বিস্তৃত চা বাগান আছে। আমি কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করলাম। আমার কলেজের কর্মচারী আব্দুস সামাদ তার বাড়ির পাশের ভারতীয় চা বাগানের কর্মচারীদের সঙ্গে এপার থেকে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো। তাদের কাছে জেনে নিই চা বাগান করার নিয়ম কানুন।

কলেজ ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়টা ছিল মাছের পেটের মতো। তার উপর ইপিল গাছের ছায়া। চা বাগানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। আরেক কর্মচারী কফিলউদ্দিনকে দিয়ে জমি তৈরী করা হলো। একদিন আব্দুস সামাদ ভ্যানে করে নিয়ে এলো ১৭৮ টি চারা, ডানকান কোম্পানী থেকে বিনা মূল্যে। চারা লাগানো হলো। খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠলো দুটি পাতা, একটি কুঁড়ি। জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলাম ১৯৯৮ সালের ৭ মে বাগান উদ্বোধন করলেন মহানন্দে, পঞ্চগড় জেলার প্রথম চা বাগান।

অবস্থানঃ পঞ্চগড় জেলার প্রথম চা বাগানটি পঞ্চগড় শহরের পঞ্চগড় মহিলা কলেজ প্রাঙ্গনে অবস্থিত।

ড. নাজমুল হকের প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক কালে পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবং পঞ্চগড় জেলার চা বিপ্লব-এর রূপকার জনাব মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম-এর নেতৃত্বে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের তরুণ কিছু সরকারি কর্মচারীদের সাথে নিয়ে সামাজিক চা-বাগান (Social tea gardening) ধারণা (Concept) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পঞ্চগড় জেলা সার্কিট হাউসের সামনে একটি চা বাগান করেন। পঞ্চগড় জেলার সার্কিট হাউসের ঐতিহাসিক এই চা-বাগানটি ছিল পঞ্চগড় জেলার আরেকটি অন্যতম প্রথম ও পথিকৃৎ চা-বাগান।

১৯৯৯ সনে জনাব মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান পরবর্তীকালে মীরগড়ে সমতল ভূমিতে চা-বাগান দেখে পঞ্চগড়ের মাটিতে চা চাষের সম্ভাবনা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। ভারত আর বাংলাদেশের পরিবেশ, মাটি, জলবায়ুর সাদৃশ্যতার কারণে পঞ্চগড়েও চা চাষের সম্ভাবনা যাচাইয়ে উদ্দেশ্যে তৎকালীন সময়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনে কর্মরত কিছু তরুণ ও উৎসাহী সরকারী অফিসারদের নিয়ে তিনি তৎপরত হন। পঞ্চগড় জেলার চা বিপ্লব-এর রূপকার জনাব মুহাম্মদ রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে সেই টীমের মেম্বার ছিলেন মোঃ দেলওয়ার হোসাইন, আব্দুস সালাম, ইয়াহিয়া চৌধুরী, ফজলুল হক, পরিমল দেব, জাকির হোসেন এবং শাখাওয়াত হোসেন।

১৯৯৯ সনে ভারত তেঁতুলিয়ায় সীমানা পিলার ৪৩৬ এর নিকট নো-ম্যানস ল্যান্ডে চা-বাগান (নন্দী মাতৃ চা-বাগান) তৈরী করে। জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম সাহেব তেঁতুলিয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিমল দেব’কে চা-চারা সংগ্রহ করতে বলেন। পরিমল দেব তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব নজরুল ইসলামকে যেভাবেই হোক চারা সংগ্রহ করতে অনুরোধ করলে তিনি এক প্রকার চুরি করেই সীমান্তের ওপারের ভারতের চা বাগান থেকে চা-চারা সংগ্রহ করে দেন।

এডিসি মোঃ দেলওয়ার হোসাইন-এর উদ্যোগে এবং উনার মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে চাকরি করার সুবাদে চা চারা রোপন পদ্ধতির ধারণার উপর ভিত্তি করে, স্থানীয় হায়দার আলী’র সহযোগিতায় পঞ্চগড় জেলা সার্কিট হাউসের সামনে কিছু খালি জায়গায় চা-বাগানের মাটি প্রস্তুত করা হয়। পঞ্চগড় জেলায় চা উৎপাদন করা সম্ভব কি না – এটি ছিল তার প্রদর্শনী (Demonstration) বাগান। এই বাগানের সফলতাই পঞ্চগড় জেলায় চা-বিপ্লব ঘটিয়েছিলো।

চা-বাগানের প্রচলিত (Conventional tea estate) পদ্ধতি সংরক্ষণ করে এর পাশাপাশি সামাজিক চা-বাগানের (Social tea gardening) ধারণা (Concept) আনা হয়। এই ধারণায় প্রান্তিক চাষীরা তাদের জমি হারাবেন না, তারা নিজ জমিতে অন্য ফসলের পরিবর্তে চা চাষ করবেন, উৎপাদিত চা-পাতা প্রচলিত চা-বাগানের কারখানায় অথবা আলাদাভাবে স্থাপিত কারখানায় বিক্রি করবেন। জেলা প্রশাসক জনাব মুহাম্মদ রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের তরুণ সরকারি কর্মচারীদের সেই ধারণা (Concept) নিয়ে চা-বাগান করার উদ্যোগটি পরবর্তীতে এই অঞ্চলে চা-বিপ্লবের রূপ নিয়েছে।

 


তথ্যসূত্রঃ ড. নাজমুল হক | হাসনুর রশিদ বাবু | মোঃ দেলওয়ার হোসাইন
ছবিঃ জুয়েল থিওটোনিয়াস | তারিকুল ইসলাম সালমান
Last updated: 23 February 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn