সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকহারে মরিচের চাষ পঞ্চগড় জেলাকে যেন মরিচের রাজ্যে পরিণত করেছে। পঞ্চগড় জেলায় যেদিকেই চোখ যায়, শুধু মরিচ আর মরিচ। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মরিচে লালে লাল হয়ে উঠেছে এখানকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সবুজ চা শিল্পের পর জেলার কৃষি অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে লাল সোনা খ্যাত এই মরিচ। মরিচের বাম্পার ফলন এবং গ্রামীণ চাষিদের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ার কারণে মরিচকে পঞ্চগড় জেলায় লাল সোনা বলে সম্বোধন করা হয়। অনুকূল আবহাওয়া আর অল্প খরচে অধিক লাভের আশায় এখানকার কৃষক ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছেন মরিচ চাষের দিকে। পঞ্চগড়ে বর্তমানে (২০২৪) প্রতি হেক্টরে মরিচের ফলন ৭০-৭৫ টন। পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মরিচের চাষ অনেক কৃষাণ-কৃষাণীরা ভাগ্য ফিরেছে, অনেকই হয়েছেন স্বাবলম্বী। ২০২৩ সালে পঞ্চগড়ে ৮ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়। এতে মোট উৎপাদিত মরিচের পরিমান ছিল ২২ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন। যার বিক্রয় মূল্য ছিল ৭৫০ কোটি টাকা
পঞ্চগড়ে গ্রীষ্মকালে থাকে মরিচের ভরা মৌসুম। যেদিকে চোখ যায় দেখা যায় লাল সোনায় ভরে উঠেছে জেলার চারপাশ। গাছে গাছে কাঁচা, আধাপাকা ও টকটকে লাল রঙের পাকা মরিচ শোভা পায়। লাল মরিচের রঙে রঙিন হয়ে উঠে চারপাশ। রৌদ্র তাপে লাল মরিচগুলি লাল গালিজার রুপ ধারণ করে। মরিচের লাল চাদরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন সৌন্দর্য পিপাসুরা। বাড়ির উঠান, রাস্তার ধার, পুকুরপাড়, ফাঁকা মাঠ ও বাড়ির ছাদ সহ বিভিন্ন জায়গায় সেসব মরিচ শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করেন চাষিরা। প্রতি মৌসুমে বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে থাকা লাল মরিচের ক্ষেতগুলি কৃষক-মজুরের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠে। তেঁতুলিয়া, আটোয়ারীর তোড়িয়া ও মির্জাপুরসহ বেশ কিছু এলাকাগুলোতে দেখা যায়, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে চাষিরা খেত থেকে তুলছেন টকটকে লাল মরিচ। পঞ্চগড় জেলার অন্যতম বড় মরিচ শুকানোর মাঠ আটোয়ারি উপজেলার মির্জাপুর মাঠ। বিশাল এই মাঠে, প্রতি মৌসুমে কয়েক হেক্টর জমির মরিচ একসঙ্গে শুকানো হয়।
করোনাকালীন আমদানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন সংকটের কারণে মরিচের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এলসি জটিলতাসহ নানা কারণে ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানিও কমে আসে। অর্থাৎ চাহিদার অনুপাতে মরিচের সরবরাহ অপ্রতুল হয়ে পরে। মূলত এই কারণেই মরিচের বাজারদরে উল্লম্ফন দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকহারে মরিচের আবাদ হচ্ছে পঞ্চগড়ে। দেশীয় উৎপাদন না বাড়লে মরিচের বাজার আরো চড়া হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে শুকনো মরিচের সবচেয়ে বেশি সরবরাহ হয় পঞ্চগড়, কুমিল্লা, ভোলা, চট্টগ্রাম, রায়পুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে। তবে আকার, বর্ণ ও স্বাদের মান ভালো হবার কারণে পঞ্চগড়ের মরিচের চাহিদা দেশে সবচেয়ে বেশি। ফলে কয়েক বছর ধরে পঞ্চগড়ে উৎপাদিত মরিচ রপ্তানি হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
স্থানীয় জাতের মরিচের পাশাপাশি পঞ্চগড়ে উচ্চফলনশীল (হাইব্রিড) জাতের বাঁশগাইয়্যা, বিন্দু, পাবনা, জিরা, হটমাস্টার, মল্লিকা, কারেন্টসহ বিভিন্ন মরিচের চাষ করছেন কৃষকেরা। আটোয়ারী, তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড় সদর উপজেলায় মরিচের চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। আটোয়ারী উপজেলার তোড়িয়া, সুখ্যাতি, নলপুখুরী, আলোয়াখোয়া, রাধানগর গ্রামে,ধামোর ইউনিয়ন সহ মির্জাপুর, বোদা উপজেলার বেংহারি বনগ্রাম ইউনিয়ন, মাঝগ্রাম, পঞ্চগড় সদর উপজেলার ফুটকীবাড়ি, নতুন হাট, হাড়িভাসা, মাগুড়া, গড়িনাবাড়ি এলাকায় মরিচের বাম্পার ফলন হয় প্রতি মৌসুমে। এসব এলাকার স্কুল মাঠ, শুকনো পুকুরের ধার, রাস্তা বাড়ির আশে-পাশে, বাড়ির উঠান, রাইস মিলের চাতাল, ক্ষেতের পাশে ও খোলা মাঠে প্লাস্টিক বিছিয়ে মাটিতে থরে থরে শুকানো হয় লাল মরিচ। চারদিক থেকে ভেসে আসে মরিচের ঝাঁজালো গন্ধ। কৃষকরা মাঠ থেকে মরিচ তুলে দু-তিন দিনের মাথায় শুকিয়ে বাজারজাত করেন। কৃষকদের কেউ জমি থেকে পাকা মরিচ তুলছেন, আবার কেউ পলিথিন বিছিয়ে শুকাতে দিচ্ছেন মরিচ। কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত থাকেন কৃষকের পরিবার-পরিজন। গ্রীষ্মকাল জুড়ে পঞ্চগড়ের প্রায় সর্বত্রই এমন দৃশ্য দেখা যায়।
প্রতি বিঘা জমি থেকে ২৫-৩০ মণ কাঁচা মরিচ উৎপাদন হয়। আর কাঁচা মরিচকে শুকনা করলে বিঘা প্রতি পাওয়া যায় ৮-১০ মণ। বিঘা প্রতি মরিচ উৎপাদনে খরচ হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। উৎপাদিত মরিচ বিক্রি করলে প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। মরিচ কাঁচা হিসেবে যা বিক্রি হয় তার চেয়েও বেশি বিক্রি করা হয় শুকিয়ে। রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মে দ্রুত মরিচ শুকিয়ে তা বিক্রি করে নগদ টাকা পান কৃষকরা। অনেকে কৃষক ভালো দামের আশায় মরিচ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে বর্ষাকালে বিক্রি করেন। কৃষকের সাথে সাথে ব্যবসায়ীরাও মরিচ, মরিচের বীজতলা, সার সরবরাহ, সংরক্ষণ ও বিক্রয় করেন। মরিচ চাষী এবং ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি যারা মরিচ তোলার সাথে জড়িত, তারাও আর্থিকভাবে উপকৃত হন। কৃষকের ক্ষেত পরিচর্যা ও মরিচ তুলে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন গ্রামীণ নারীরা। সংসারের কাজ সেরে এ সময়টাতে চাষিদের ক্ষেত থেকে মরিচ তুলতে ব্যস্ত থাকছেন তারা। বর্তমানে (২০২৪) প্রতি কেজি ৭-৯ টাকা দরে গ্রামীণ নারী ও মরিচ শ্রমিকেরা প্রতিদিন ৫শ থেকে ৭শ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। অর্থাৎ প্রতি মৌসুমে তারা মরিচ তুলে ১৫ থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত আয় করছেন। পঞ্চগড়ের স্থানীয় শ্রমিকদের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে শ্রমিকরাও মরিচ ক্ষেতে কাজ করছেন।
শুকনো মরিচ বাজারজাত ও বিভিন্ন বহুজাতিক কারখানায় সরবরাহ করার কাজে সরগরম হয়ে উঠে পঞ্চগড় জেলার পাইকারি বাজারগুলো। প্রতিদিনই এ এলাকার কাঁচা মরিচ ও শুকনো মরিচ কিনতে ছুটে আসছেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। জেলার শালবাহান, জগদল বাজার, ফুটকি বাড়ি বাজার, ঝলোই বাজার, ময়দান দিঘী বাজার ও টুনির হাটসহ বিভিন্ন হাট বাজার থেকে মরিচ কিনে নিয়ে যান তারা। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সর্ববৃহৎ হাট শালবাহান। দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে কুমিল্লা থেকে সরবরাহ করা শুকনো মরিচ বিক্রি হয় পাইকারিতে ৩৯০ টাকা, পঞ্চগড়ের মরিচ ৪১০ টাকা, রায়পুরের মরিচ ৪৩০ টাকা ও হাটহাজারীর মরিচ ৫০০ টাকায়। এছাড়া আমদানীকৃত ভারতীয় (গুজরাটি) মরিচ বিক্রি হয় ৩৬০-৩৭০ টাকায়। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা মরিচ বিক্রি হয় ৩৭০ টাকায়।
পঞ্চগড়ের মরিচে কদাচিৎ অ্যানথ্রাক্সনোজ (স্থানীয় ভাষায় টেপাপচা) দেখা গেলেও আবহাওয়ার অনুকূল্যতার কারণে মরিচ আবাদ ব্যাহত হয় না। ইদানিং পঞ্চগড়ে প্রসার ঘটছে জনপ্রিয় মালচিং পদ্ধতিতে মরিচের আবাদ। বাজারে সারা বছর মরিচের চাহিদা থাকায় মালচিং পদ্ধতি মরিচ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। এ পদ্ধতিতে জমি তৈরির জন্য মাঝখানে দুই পাশ থেকে কেটে দেড় ফুট চওড়া করে ও ৮-১২ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে বেড তৈরি করা হয়। তৈরি বেডগুলো মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্লাস্টিকের মালচিং পেপারের কালো রঙের দিকটা থাকে নিচের দিকে আর রূপালি রঙের দিকটা থাকে ওপরের দিকে অর্থাৎ সূর্যের দিকে। এ পদ্ধতিতে সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে মাটিকে রাখে ফসলের উপযোগী। পরে মালচিং পেপারের দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গোল গোল করে কেটে নেওয়া হয়। এরপর কেটে নেওয়া জায়গায় রোপণ করা হয় বীজ বা চারা। এরপর তিন ফুট উঁচুতে বাঁশ ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় মাচা। এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে দীর্ঘ সময় ধরে ফলন পাওয়া যায় এবং কৃষকরা অধিক লাভবান হন।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের শিল্প ও অর্থনীতি | পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ
তথ্যসূত্রঃ সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ
ছবিঃ ফিরোজ আল সাবাহ
Last updated: 14 May 2024