পঞ্চগড়ে কমলা চাষ – Orange Cultivation

পঞ্চগড়ে বিগত এক দশকে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কমলার চাষ। বাজারে চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমলার বাণিজ্যিক চাষাবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কমলা চাষের উপযোগী পঞ্চগড়ের জলবায়ু ও মাটিকে কাজে লাগিয়ে কমলা চাষকে বাস্ততায় রূপ দিয়েছে এ জেলার মানুষ। বর্তমানে পঞ্চগড়ে কমলা এবং মাল্টা চাষের ফলে পাল্টে যাচ্ছে এ জেলার আর্থ সামাজিক উন্নয়নের ধারা। পঞ্চগড়ের চা চাষ যেমন অর্থনীতিতে অনূকুল প্রভাব ফেলেছে তেমনি কমলা এবং মাল্টা চাষ এখানকার প্রান্তিক অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ।

পঞ্চগড়ে উৎপাদিত কমলার আকার, রং ও স্বাদ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার কমলার মতো। পঞ্চগড়ের কমলা খুবই সুস্বাদু এবং রসালো। এখানকার কমলা ফরমালিন মুক্ত হওয়ায় বাজারে অন্যান্য কমলার চাইতে এর চাহিদা অনেক বেশি। পঞ্চগড়ের কমলা স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রফতানি হচ্ছে। হাল্কা-দোঁয়াশ মাটি কমলা চাষের উপযোগী। আর ওই মাটিতে চুনের মাত্রা তথা অম্লত্ব (পিএইচ) বেশি থাকলে কমলা হয় উৎকৃষ্ট। পঞ্চগড়ের মাটিতে এ দুটি গুণাগুণই রয়েছে। আর পঞ্চগড়ের শীতল আবহাওয়া কমলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে এ অঞ্চলের কমলা গাছগুলোতে মুকুল আসে। আট বছর বয়সী একটি কমলা গাছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০০টি কমলা ধারণ করে। কমলা বিক্রিতেও ঝামেলা নেই। ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগান থেকেই ফল কিনে নিয়ে যান। কমলা গাছ রোপনের পর অল্প পরিশ্রমে ভাল ফলন ও মূল্য পাওয়ায় অনেক কমলা চাষীর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কমলার পাশাপাশি মাল্টার চাষও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মাল্টার চারা রোপণের পর এক বছরের মধ্যেই ফল চলে আসে।

২০০৯ সালে পঞ্চগড়ের একটি কমলার গাছ

প্রারম্ভিক কালে পঞ্চগড়ে সখের বসে বাড়ির আঙ্গিনায় কমলার চাষ শুরু হলেও, কমলা চাষ বাণিজ্যিক রূপ পায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ২০০৬-০৭ অর্থবছরে পাঁচ বছরমেয়াদী কমলা উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের হাত ধরে। এ প্রকল্পের অধীনে জেলার চারটি উপজেলায় গ্রামভিত্তিক কমলা গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বসত বাড়ির আঙ্গিনায় ও এর আশ পাশে ব্যক্তি পর্যায়ে কমলা চাষের জন্য প্রায় ৫ হাজার পরিবারের মধ্যে ৮৮ হাজার কমলা চারা বিতরণ করা হয়। মোট ১৯৫টি বাগান গড়ে তুলে, প্রতিটি বাগানে ১৫৬টি করে চারা রোপণ করা হয়। জেলার ১৫ হাজার চাষীকে কমলা চাষাবাদের কলাকৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি দুই লক্ষাধিকের বেশি উন্নতমানের চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। ২০১১-২০১২ সাল নাগাদ পাঁচ বছরেই বাগানগুলিতে ফল ধারণ করে। কমলা চাষে উদ্বুদ্ধ হয় চাষীরা। বসতবাড়ির আঙ্গিনা ছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে কমলা চাষের সম্প্রসারণ ঘটে। জেলায় কমলা গাছের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে উক্ত প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়ের সদর, বোদা, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া উপজেলার ১৪১ হেক্টর জমিতে বাগান আকারে কমলা চাষ করা হয়। ২০১৪ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর প্রকল্পের অধীনে শতাধিক বাগান ও বসতবাড়ির আশপাশে প্রায় ৪১ হাজার কমলার গাছ রোপণ করার মাধ্যমে জেলার পাঁচ উপজেলায় প্রায় ৭৩ হেক্টর জমিতে কমলার চাষ করা হয়। ২০১৬ সালে বোদা উপজেলায় ৪০ শতক জমির প্লট করে ২৮ টি কমলা প্রদর্শনী প্লট করা হয়। এতে ২৮ শত কমলার চারা সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়। ২০২২ সালে মোট ৩৭ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে কমলার চাষ হয়েছে, উৎপাদন হয় ২৭৭ মেট্রিক টন কমলা।

পঞ্চগড় জেলায় কমলা চাষের বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে কমলা আমদানি হ্রাস ও এর রফতানি বৃদ্ধি, পুষ্টি চাহিদা মেটানো ও কৃষকের আয় বৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। পঞ্চগড়ে পাকিস্তানি ও দার্জিলিং কমলা, ইম্পেরিয়াল ম্যান্ডারিন, অস্ট্রিলিয়ান কমলা, মাল্টা বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়ে আসছে। পঞ্চগড়ে রাসায়নিক সার ছাড়া জৈব সার প্রয়োগ করে বিষমুক্ত উপায়ে চাষ করা উন্নত মানের কমলার বাজার ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত থাকলে পঞ্চগড়ের কমলার চাষ প্রান্তিক অর্থনৈতিক উন্নতি এবং দেশের কমলার চাহিদা পূরণে অনেক অবদান রাখবে।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের শিল্প ও অর্থনীতি | পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ


ছবিঃ এস.এ. সেলিম
Last updated: 14 May 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

পঞ্চগড়ে কমলা চাষ