পঞ্চগড়ের টুপি – Hat industry of Panchagarh

শিল্পনৈপুণ্য, মান ও সৌন্দর্যের কারণে তেঁতুলিয়ার টুপির চাহিদা দেশজুড়ে। কারুকার্যময় নান্দনিক নকশা ও কুশনের ডিজাইনের পঞ্চগড়ের টুপি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। স্বল্প লাভের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর মানসম্মত টুপি তৈরির মাধ্যমে দেশের সুনাম ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বহির বিশ্বেও। অজপাড়াগাঁয়ে তৈরি টুপি গ্রামীণ অর্থনীতির মাইলফলক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

পঞ্চগড়ে বানিজ্যিক ভিত্তিতে টুপি শিল্পের গোড়াপত্তন হয় ১৯৯৫ সালে জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে তেঁতুলিয়া উপজেলার সবুজ শ্যামল আজিজনগর ও মাথাফাটা গ্রামে। মাথাফাটা গ্রামটি বর্তমানে টুপিপল্লী নামেই অধিক পরিচিত। এখানকার মেঠো পথের দু’পাশে ছায়াঘেরা পরিবেশে গত ৩০ বছরে ছোট পরিসরে ৮ থেকে ১০টি টুপির কারখানা গড়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র টুপি কারখানার মালিকেরা স্বল্প পুঁজির মাধ্যমে পাঁচ থেকে দশটি এমব্রয়ডারি মেশিন দিয়ে টুপি কারখানা শুরু করে। এসব টুপি কারখানার মালিকগণ সকলে নিজেরাই দক্ষ টুপি কারিগর। তেঁতুলিয়ার টুপি কারখানায় কাজ করে সচ্ছলতা ফিরেছে স্থানীয় ৪ শতাধিক পরিবারের। মাথাফাটা গ্রামের তৈরি টুপির ক্রেতাদের বেশির ভাগই ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের ব্যবসায়ী। তেঁতুলিয়ার টুপি যশোর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর সহ বড় শহরগুলোতে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়ে থাকে। কিছু ব্যবসায়ী সৌদি আবর, কুয়েত, পাকিস্তান, কাতার, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও তেঁতুলিয়ার টুপি রপ্তানি করছেন।

তেঁতুলিয়ায় টুপি শিল্পের পর্যায়ক্রম বিকাশের শুরু আল খাইয়্যাত ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। টুপিপল্লীর আল খাইয়্যাত ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রিকে বলা হয় বাংলাদেশে টুপি তৈরির পথিকৃৎ। দেশের সর্বপ্রথম নিত্যনতুন ডিজাইনসমৃদ্ধ মানসম্মত টুপি তৈরি করে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার এই কোম্পানী। ১৯৯১ সাল থেকে উদ্যোক্তা আব্দুল হান্নান স্থানীয় কারিগর আব্দুর রাজ্জাককে সাথে নিয়ে টুপি তৈরি করা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আব্দুল হান্নান টুপি উৎপাদন শুরু হয়। এ কারখানার তৈরিকৃত টুপি দেশে ও বিদেশে বাজারজাত হলে থেকে তেঁতুলিয়ায় তৈরিকৃত টুপির কদর ও ক্রেতার চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আল খাইয়্যাত সর্ববৃহৎ টুপি কারখানা হিসেবে দেশে খ্যাতি লাভ করে।

১৯৯১ সালে আব্দুল হান্নান ভার্সিটির ছাত্র থাকাবস্থায় তেঁতুলিয়ার চৌরাস্তা বাজারে আব্দুর রাজ্জাকের দর্জির দোকান থেকে পাঞ্জাবি বানিয়ে নিতো। আব্দুল হান্নান পাঞ্জাবির দক্ষ কারিগর আব্দুর রাজ্জাককে টুপি তৈরির অনুপ্রেরণা দেন। পাঞ্জাবির নিপুন কারিগর আব্দুর রাজ্জাক সর্বপ্রথম জিন্স প্যান্টের মোটা কাপড় দিয়ে সুন্দর টুপি তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু জিন্স প্যান্টের কাপড় দ্বারা সেলাইকৃত টুপি নিখুঁত হয়না। পরে দেশীয় সুতি কাপড় দিয়ে তৈরি করা টুপির নকশাও মার্জিত দেখায় না। একপর্যায়ে পেয়েন্টিং কাপড়, পেস্টিং ও নানা রঙের সুতা দিয়ে এমব্রয়ডারি মেশিনের সাহায্যে উন্নত মানের টুপি তৈরি করে সাফল্য অর্জন করেন আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৯৩ সালে এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে রাজ্জাক এবং হান্নান যৌথভাবে ১০০ টুপি তৈরি করেন। টুপি নিয়ে ঢাকার চকবাজার সহ বিভিন্ন দোকানে গেলে তাঁরা ব্যাপক সাড়া পান। আব্দুল হান্নান প্রথম টুপি তৈরির লভ্যাংশ এবং বন্ধুর কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা ধার করে ক্রয় করেন টুপি তৈরির মেশিন, রাজ্জাককে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মেসার্স আল খাইয়্যাত ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি। ১৯৯৪ সাল থেকে এ কারখানায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টুপি বানানো শুরু করে। আব্দুর রাজ্জাক আল খাইয়্যাত ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রিজে কারিগর হিসেবে আট বছর কর্মরত থাকার পরে পরবর্তীতে নিজে ১২টি এমব্রয়ডারি মেশিন কিনে মেসার্স আল-তামিম ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করেন।

মেসার্স আল ইকরা ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি

মাথাফাটা গ্রামের হারুন অর রশিদ লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকলেও সংসারে অভাব-অনটন থাকায় দশম শ্রেণীর পর আর পড়াশোনা করতে পারেনি। আল খাইয়্যাত ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রিজে টুপি তৈরির কাজ শেখা শুরু করেন ৮০০ টাকা বেতনে, পরে তাঁর দক্ষতার গুনে সেই মাসিক বেতন হয় সাড়ে চার হাজার টাকায় উন্নীত হয়। সেখানে ছয় বছর থাকার পর ২০০২ সালে হারুন অর রশিদ তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা পারভীনকে সাথে নিয়ে মেসার্স আল ইকরা ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি টুপি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুর দিকে একটি দোচালা ঘরে দুটি মেশিন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন তাঁরা। বর্তমানে (২০২৪) ইটের তৈরি পাকা বাড়িতে ২২টি মেশিন ও ৪০ জন নারী-পুরুষ কারিগর নিয়ে এই কারখানার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ব্যবসায় মূলধন বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি কর্মসংস্থান ব্যাংক পঞ্চগড় থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তার কারখানা থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১৫ শত টুপি তৈরি করে বিক্রি করেন।

২০১১ সালে তেঁতুলিয়ার মরিয়ম ইন্টারন্যাশনাল তাদের বিভিন্ন মডেল ও ডিজাইনের টুপি বিদেশে রফতানি করে সুনাম অর্জন করে। তৎকালীন সময়ে সেই কারখানায় স্থানীয় মহিলা সহ প্রায় ৪০-৫০ জন কারিগর কাজ করতেন। অন্যের কারখানায় বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন মাথাফাটা গ্রামের জুলহাস উদ্দীন। ২০১৭ সাল বাড়ির পাশে একটি টিনশেড পাকা ঘরে ৯টি এমব্রয়ডারি মেশিন দিয়ে টুপির ব্যবসা শুরু করে। তাঁর কারখানা নাম মেসার্স আল জিয়াত ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রিজ। মাথাফাটা গ্রামের ওসমান ক্যাম্প টুপি কারখানায় কারিগর সোহেল রানা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টুপি তৈরির কাজ ধরেন। সে প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা উপার্জন করে। টুপি তৈরির কাজ করে ছোট বোন ফরিদাকে ১০ হাজার খরচ করে বিয়ে দেন সোহেল রানা। বর্তমানে বাবা, মাকে সাথে নিয়ে টুপি উপার্জনের টাকায় সংসার পরিচালনা করছেন। তেঁতুলিয়ার মেসার্স ওসমান ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি, মেসার্স আলিঙ্গন ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি অন্যতম।

সারা বছরই টুপির চাহিদা থাকে ধর্ম প্রাণ মানুষের কাছে। তবে এর চাহিদা বেড়ে যায় মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব শবে বরাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময়। দেশে টুপির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রাজধানীর চকবাজার ও গুলিস্তানের খদ্দর মার্কেট। এ ছাড়া বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মার্কেটে পাইকারি ও খুচরা উভয় পদ্ধতিতেই টুপি বিক্রি হয়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার ও বকশির হাট, সিলেটের হাজী কুদরত উল্লাহ মার্কেট ও হজরত শাহ জালাল (র.)-এর মাজার, কুমিল্লার কান্দিরপাড় ইত্যাদি স্থানে পাইকারি দামে টুপি বিক্রি হয়। টুপিরও আছে নানা ধরন। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের খুচরা ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম জানান, বাজারে হাজি টুপি (গোল টুপি), নেট টুপি, পাঁচ কল্লি টুপি ইত্যাদি নানা ধরনের টুপি কিনতে পাওয়া যায়।

করোনা মহামারির কারণে তেঁতুলিয়ার বেশিরভাগ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। করোনাকালীন হারিয়ে যাওয়া পুঁজি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকটের কারণে টুপির ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বিদেশি টুপিতে দেশীয় বাজার ভরপুর এবং সুতার দাম বৃদ্ধিসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। করোনার ধকল কাটিয়ে বর্তমানে তেঁতুলিয়া উপজেলায় দুটি টুপি কারখানা চালু আছে। এর মধ্যে একটি মেসার্স আল ইকরা ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি। তেঁতুলিয়ার টুপির ঐতিহ্য ধরে রেখে বিগত দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে টুপি উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে কারখানাটি। কিন্তু স্বল্পপুঁজি ও কারিগর দিয়ে বাজারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন কার্যক্রম। পঞ্চগড়ে নতুন করে গড়ে উঠছে না বড় কোনো কারখানাও। আজিজনগর ও মাথাফাটা গ্রামের টুপি কারখানার মালিকদের দাবি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দিলে তৈরিকৃত টুপি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি স্বল্প শিক্ষিত বেকার যুবক ও নারীদের কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টিসহ রাজস্ব আয় বাড়বে। পঞ্চগড়ের টুপি শিল্পের প্রসার হলে সৃষ্টি হতে পারে আরো কর্মসংস্থান, যা দারিদ্রতা দূরীকরণের ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বাড়াবে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের গতিও। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, স্বল্প সুদে ঋণ, আমদানি করা টুপির ওপর কর আরোপ এবং রপ্তানি তত্ত্বাবধান টুপি শিল্পের অন্যতম সহায়ক হতে পারে।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের শিল্প ও অর্থনীতি


ছবিঃ ঢাকা মেইল
Last updated: 15 May 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

পঞ্চগড়ের টুপি