হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ের হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ। তেঁতুলিয়া আর দেবীগঞ্জ উপজেলার ফুলের খামারগুলো ভরে উঠেছে টিউলিপ আর দেশি-বিদেশী ফুলে। নেদারল্যান্ড, কাশ্মীর, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক নয় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ফুটছে দৃষ্টি নন্দনটিউলিপ ফুল। তেঁতুলিয়া উপজেলায় রাজসিক সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে বিস্তৃত টিউলিপ ফুলের বাগান, মাঘের শীতে বাগানজুড়ে বর্ণিল আভা ছড়ানো এসব ফুল দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা। টিউলিপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে তেঁতুলিয়ায় ছুটে আসছেন হাজারো পর্যটক। টিউলিপ চাষ তেঁতুলিয়ার পর্যটন, কৃষি অর্থনীতি এবং এগ্রো ট্যুরিজমে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায় দেশি ফুলের পাশাপাশি বিদেশী ফুল চাষাবাদ করা হচ্ছে।
তেঁতুলিয়ার টিউলিপের বাগানগুলোয় ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। দর্শনার্থীদের কেউ ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখেন, কেউ তুলেন ছবি, কেউবা মুঠোফোনে ভিডিও কলে দূরে থাকা স্বজনদের দেখান টিউলিপের সৌন্দর্য। কেউ কেউ আবার ফুল কিনে ফিরেন বাড়িতে। দর্শনার্থীরা টিকিট কেটে টিউলিপ বাগানে ঢুকেন। দর্জিপাড়া গ্রামে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ক্ষুদ্র চাষিরা বাগানের পাশে স্থাপন করেছেন ‘হোটেল টিউলিপ’ নামে একটি রেস্তোরাঁ। যেখানে ফুল দেখতে আসা মানুষ খেতে পারেন তেঁতুলিয়ার স্থানীয় গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার।
টিউলিপ শীত প্রধান অঞ্চলের ফুল। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘টিউলিপা’। এটি নেদারল্যান্ডস’র ফুল। যা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুত্বপূর্ণ ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ। এটি বাগানে কিংবা কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হয়। ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখার জন্য এর আবেদন অনন্য। বর্ষজীবি ও কন্দযুক্ত প্রজাতির এ গাছটি লিলিয়াসিয়ে পরিবারভূক্ত উদ্ভিদ। টিউলিপের প্রায় ১৫০ প্রজাতি এবং এদের অসংখ্য সংকর রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের হাইব্রিডসহ টিউলিপের সকল প্রজাতিকেই সাধারণভাবে টিউলিপ নামে ডাকা হয়। টিউলিপ মূলত বর্ষজীবি ও শীত প্রধান দেশের বসন্ত কালীন ফুল হিসেবে পরিচিত।
বছরের প্রায় চার মাস পঞ্চগড়ে শীতার্ত আবহাওয়া থাকায় টিউলিপ চাষের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ২০২২ সালে পরিক্ষামূলকভাবে তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের দর্জিপাড়া ও শারিয়াল জোত গ্রামে প্রথমবারের মতো বৃহৎ পরিসরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন পিকেএসএফ-এর সহযোগিতায় টিউলিপ চাষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ইকো-সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-ইএসডিও। তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জিপাড়া গ্রামের ২০ জন নারী উদ্যোক্তা চাষির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে আনা টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কাণ্ড) রোপণ করা হয়। ২০ জন চাষি মোট ২ একর জমিতে ১০ প্রজাতির ১ লাখ টিউলিপের বাল্ব রোপণ করেন। এই ফুল ফোটাতে ব্যবহার করা হয় উচ্চ কৃষিপ্রযুক্তি। ফুলগুলো একটি বিশেষ শেড নেটের (ছাউনির) নিচে চাষ করা হয়। আর চারপাশ ঘিরে দেওয়া হয় বিশেষ নেট দিয়ে, যা তাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করে সূর্যের আলো। ইএসডিও ‘র প্রকল্পে কনসালটেনসি দেন ২২ বছর ধরে চীনের কুনমিং এ বিদেশী ফুল নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজ্ঞ ড. হেইদি ওয়েরনেট।
তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ চাষে উপরোক্ত পাইলট প্রজেক্টে সাফল্যের ফলশ্রতিতে সাম্প্রতিক বছর গুলোতে শুরু হয়েছে ক্ষুদ্র চাষিদের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষ। কিছু স্থানীয় উদ্যোক্তা বৃহৎ পরিসরে টিউলিপের চাষ শুরু করেছেন। প্রতি মৌসুমে ফার্ম আকারে টিউলিপ ফুল চাষ করছেন প্রান্তিক ক্ষুদ্র চাষীরা। তেঁতুলিয়ার ব্যাপক এলাকা নিয়ে জমি প্রস্তুতের মধ্য দিয়ে টিউলিপের বীজ রোপন, জমিতে খন্ড খন্ড প্লট করে স্প্রে, লাঙ্গল দিয়ে লাইন টানা, লাইনের দুপাশে নারী-পুরুষরা মিলে টিউলিপের বীজ সারি সারি করে মাটিতে রোপন করছেন। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে রোপন শেষ করে ২১-২৩ দিনের মধ্যে গাছে কলি আসতে শুরু করে টিউলিপ বাগানে। টিউলিপ চাষ করে তেঁতুলিয়ায় ২০ নারী চাষি স্বাবলম্বী হয়েছেন।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল ধরা হয়। এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা হলে প্রাপ্তবয়সের আগে মানসম্মত ফুল নাও ফুটতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রোপণের ১৮ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কলি আসতে শুরু করে এবং ২৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত টিউলিপ ফুল স্থায়ী হয়। তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ রোপণের ২২ দিনের মাথায় ফুটতে শুরু করে মনোমুগ্ধকর টিউলিপ। ১০ প্রজাতির ১০টি রঙের মধ্যে প্রায় প্রতিটি ফুলই ফুটে সারিসারি ভাবে। অ্যান্টার্কটিকা (সাদা), ডাচ সানরাইজ (হলুদ), স্ট্রং গোল্ড (হলুদ), বেগুনি প্রিন্স (বেগুনি), ডেনমার্ক (কমলা), রিপে (কমলা), অ্যাড রেম (কমলা), টাইমলেস (লাল সাদা শেড), ইলে দে ফ্রান্স (লাল), লালিবেলা (লাল), বার্সেলোনা (গাঢ় গোলাপী), মিল্কশেক (হালকা গোলাপী) সহ ফুটে নানা রঙের টিউলিপ। বিস্তৃত পরিসরে টিউলিপের বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি বাগানজুড়ে ছড়ায় শুভ্রতা। ইএসডিও’র প্রথম প্রকল্পে ২০২২ সালে নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬২ টাকা। ২০২৩ সালে প্রান্তিক চাষীদের জন্য নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে খরচ হয়েছিল ৫৫ টাকা।
পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার নগর চেংঠীহাজরা ডাঙ্গা এলাকার কাউয়াপুকুর গ্রামে মেটাল অ্যাগ্রো লিমিটেড ৪০ একর জমিতে দেশি ফুলের পাশাপাশি প্রায় ১২০ প্রজাতির বিদেশী ফুল চাষাবাদ করা হচ্ছে। তাঁরা জাপানের বিখ্যাত ‘টাকি সিড’কোম্পানি থেকে বীজ ও চারা এনে ডাইয়েনতাস, এস্টার, মেথিউলা, এন্টিরিনাম, কেবেজকাট ফ্লাওয়ার, স্যালভিয়া, ভিইওলাসহ ১২০ প্রজাতির ফুল চাষ করে সফলতা অর্জন করেছে। এসব ফুলের বিদেশী নামের পরিবর্তে নন্দিনী, মিথিলাসহ দেশিয় সহজে উচ্চারণযোগ্য নাম দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মেটাল এগ্রো’র বাগানে অতিথি অভ্যর্থনার জন্য ব্যবহৃত জাপানি জাতের বিভিন্ন স্টিকের চাষও করা হচ্ছে। তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ ফুল ফুটলেও পরবর্তীকালে রোপণের জন্য টিউলিপ গাছের বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় টিউলিপ বাল্ব সংরক্ষণ করতে হয়, যা টিউলিপ চাষের বড় সীমাবদ্ধতা। বাণিজ্যিক চাষের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টিউলিপ ফুলের জাত উদ্ভাবন গবেষণায় এগিয়ে এসেছে দেশের এই শীর্ষ বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেটাল এগ্রো লিমিটেড। কৃষকদের মাধ্যমে এই ফুল চাষ প্রসারে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি ফুল চাষে দেশের বিভিন্ন এলাকার নার্সারি মালিক ও ফুল চাষীদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
তেঁতুলিয়ায় টিউলিপের পাশাপাশি কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় গোলাপ, জবা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমলিকা, জারবেরা, রডস্টিক, ডালিয়া, রজনীগন্ধা, ক্যালেন্ডোলা, সালভিয়া, এস্টার সহ বিভিন্ন জাতের ফুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবস, ১৩ ফেব্রুয়ারির পহেলা ফাল্গুন ও ১৪ ফেব্রুয়ারির ভালোবাসা দিবসে তেঁতুলিয়ার ফুলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। পঞ্চগড়ে সূর্যমুখী ফুল চাষেও লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। পঞ্চগড়ের ফুল এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও বিক্রি করছেন ফুল চাষিরা।
টিউলিপ চাষ প্রকল্পের উদ্যোক্তা ইএসডিও’র সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ছিল তেঁতুলিয়ার চাষিদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, তাঁদের পরিবারে আয় বাড়ানো, বিদেশ থেকে টিউলিপ ফুল আমদানি কমানো, পঞ্চগড় জেলাকে পর্যটন উপযোগী জেলা হিসেবে গড়ে তোলাসহ ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে উন্নত জাতের টিউলিপ ফুল উৎপাদনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। পঞ্চগড়ে ফুল চাষ ও সংরক্ষণে আধুনিক পদ্ধতি এবং কৌশলগত প্রকৃত জ্ঞানের অভাব, সুষ্ঠু বাজারজাতকরণে পরিবহণ সমস্যা, বিক্রয় কেন্দ্র ও হাট বাজারের সমস্যা, কোল্ডস্টোরেজের অভাব, ফুল চাষে সারের পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব, পাইকারি বাজার না থাকা, মানসম্মত ও উন্নত জাতের বিদেশি ফুলের অপর্যাপ্ত আমদানি বিদেশি ফুল চাষের নানান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
বাংলাদেশে ফুলের সম্ভাবনাময় একটি বাজার রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ফুলের বেশি একটা জাত নেই। বর্তমানে যশোর, চট্টগ্রাম ও সাভারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষ করা হচ্ছে, যা যথেষ্ট নয়। বাজারে গেলে আমরা গোলাপ, জবা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধাসহ মাত্র কয়েক জাতের ফুল দেখতে পাই। অথচ বিশ্ব বাজারে অনেক ফুল আছে। কৃষকরা ফুল চাষ করলে বিদেশী ক্রেতারা এখানে এসে ফুল কিনবেন। দীর্ঘদিন শীত থাকায় উত্তরাঞ্চল ফুল চাষের উপযোগী জায়গা। আশা করি অল্প সময়েই বাংলাদেশে ফুলের বাজার সৃষ্টি হবে। ভবিষ্যতে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হবে বাংলাদেশে উৎপাদিত বিদেশী ফুল।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের শিল্প ও অর্থনীতি | পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ
তথ্যসূত্রঃ সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ | Eco-Social Development Organization (ESDO) | Palli Karma-Sahayak Foundation (PKSF) | Metal Agro Ltd.
ছবিঃ সমকাল
ভিডিওঃ সময় টিভি
Last updated: 14 May 2024