পঞ্চগড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মূল স্থানটি ছিল পঞ্চগড় জেলা পরিষদে অবস্থিত ডাকবাংলো এলাকায়। ১৯ এপ্রিল থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই এখানে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড় জেলায় ডাকবাংলো ও সুগার মিল মাঠেই তাদের বড় ঘাঁটি স্থাপন করে এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে। বড় ঘাঁটি দুটি পরবর্তীতে গণহত্যা ও নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই অধিকাংশ গণহত্যা এই ডাকবাংলো ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল।
১৯ এপ্রিল খান সেনারা পঞ্চগড় আক্রমণ করে সমস্ত শহর জ্বালিয়ে পঞ্চগড়ে মানুষ হত্যা শুরু করে। খান সেনারা দখল করে নেয় জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন তাঁরা পঞ্চগড় থেকে জগদল, অমরখানা ও তেঁতুলিয়া মুক্তাঞ্চলে অবস্থান নেয়। খান সেনারা জেলা পরিষদ ডাকবাংলাতে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে ডাকবাংলা ভবনের সামনের বিশাল গর্তে (যা বর্তমানে বধ্যভূমি) ফেলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পঞ্চগড় সদর থানার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও সমন্বয়কারী কমিটির প্রধান আনোয়ার হোসেন সরকার বর্ণনা করেন, বিডি হল ও থানা মাঠে বহু মানুষকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। কোন কোন সময় তারা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিএ একই গুলিতে ৫-৭ জনকে হত্যা করতো। এভাবে তারা ডাকবাংলো এলাকায় প্রায় ৫০০-এর অধিক মানুষকে হত্যা করে। ডাকবাংলো গণহত্যায় শত শত মানুষকে হত্যা করা হলেও অধিকাংশ শহীদের নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়নি। এদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা যায় তাঁরা হলেনঃ
(১) মাওলানা ইদ্রিস আলী | (১৫) নিধান মোহাম্মদ | (২৯) ইনসাফ আলী |
(২) আবু আরেফ আহম্মেদ | (১৬) খেতখেতু মোহাম্মদ | (৩০) শাহাদাত আলী |
(৩) লখিয়া | (১৭) রহিম উদ্দিন | (৩১) ওয়াজেদ আলী |
(৪) আব্দুর রহমান | (১৮) অজ্ঞাত শিশু | (৩২) আবুল মোহাম্মদ |
(৫) হারুন আর রশিদ | (১৯) শমসের আলী | (৩৩) মোঃ আব্দুল করিম |
(৬) নূর বকস | (২০) মঙ্গলু মোহাম্মদ | (৩৪) মশির উদ্দিন |
(৭) কাওসার আলম | (২১) বাবু মোহাম্মাদ | (৩৫) বাবুল হোসেন |
(৮) নুরুল হক | (২২) সেকেন্দার আলী ভূঁইয়া | (৩৬) তরিকুল |
(৯) শামসুল হুদা | (২৩) কবির ভূঁইয়া | (৩৭) মোকছেদ আলী |
(১০) ঘেরু মোহাম্মদ | (২৪) সিদ্দিক হুসেন | (৩৮) আব্দুস সোবহান |
(১১) মিন্টু | (২৫) শনিবুল্লাহ | (৩৯) আমির উদ্দিন |
(১২) মনছুর আলী চৌধুরী | (২৬) দোমাসু | (৪০) কশিম |
(১৩) ইয়াসিন আলী | (২৭) নইমুদ্দিন | (৪১) সমির উদ্দীন |
(১৪) আছিরুল হক | (২৮) বাবলু |
অবস্থানঃ পঞ্চগড় শহরের প্রাণ কেন্দ্রের শের-ই-বাংলা পার্ক বা চৌরঙ্গী পার্ক মোড়ের পশ্চিমে করতোয়া ব্রিজের উত্তর প্রান্তের শেষ মাথায় এবং পঞ্চগড় জেলা পরিষদের সামনে ডাকবাংলা বধ্যভূমির অবস্থান।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২০১০ সালের ২৭ নভেম্বর (বাংলা ১৩ পৌষ ১৪১৭ বঙ্গাব্দ) তৎকালীন জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক-এর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় ডাকবাংলো বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধটি উদ্ভোধন করেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জসিম উদ্দিন আহমেদ। স্মৃতিসৌধে উল্লেখিত রয়েছেঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত ৭১ এর বধ্যভূমি।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি ও গণকবর | পঞ্চগড়ের তালিকাভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা | পঞ্চগড়ের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা
তথ্যসূত্রঃ আল ফরিদ
Last updated: 22 April 2024