ডাংগীরহাট বধ্যভূমি – Dangirhat Slaughterhouse

ডাংগীরহাট বধ্যভূমি
ধামোর ইউনিয়ন, আটোয়ারী, পঞ্চগড়।

ম্যাপঃ Google map

১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট ভোরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জহিরুল, কমান্ডার কালাম, কমান্ডার আনোয়ার ও কমান্ডার আসিরের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা গোয়ালপাড়া মোড়ে এম্বুসের মাধ্যমে ৩ জন পাকসেনাকে ধরে ভারতের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। একেরমধ্যে একজন পাক সেনা পালিয়ে পঞ্চগড় সুগারমিল পাকিস্তান ক্যাম্পে সেই আক্রমণের খবর পৌছে দিলে, পাক বাহিনী গোয়ালপাড়ার আশেপাশের গ্রাম, রুহিয়া, আটোয়ারী ও মির্জাপুর ক্যাম্প হতে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে এবং আশেপাশের গ্রামগুলিতে হানা দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাক সেনারা নিরীহ মানুষদের ডাংগীরহাট ক্যাম্পে বন্দি করে। ৪ আগস্ট দিন অতিবাহিত হলে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরেরা আটোয়ারী উপজেলার ধামোর ইউনিয়ন থেকে ২০-২৫ জন মানুষকে ধরে নিয়ে যায় ডাংগীরহাট পাকিস্তানি ক্যাম্পে। মির্জাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোঃ তছলিমউদ্দিন আহাম্মেদ ছিলেন ঐ দলে। তছলিমউদ্দিন চেয়ারম্যান তাঁর ব্যক্তিগত রিভলবারটি সহ ধৃত হন।

তসলিম উদ্দিন সহ অন্যান্যরা পাকসেনাদের হাতে আটক হলে জনাব তসলিম উদ্দিনের পারিবারিক কৃষি খামারের বিশ্বস্ত ড্রাইভার ফরিদপুর নিবাসী শেখ আঃ রহমান, তসলিম উদ্দিনের দুই সন্তানকে নিয়ে ভারতের দিকে এগুতে থাকেন। কিন্তু মাঝপথে বিবেকের তাড়নায়,ফিরে আসেন এবং পাকসেনাদের সামনে পড়েন। দিনাজপুরে নিহত সেক্টর কমান্ডারের ড্রাইভের নামের সাদৃশ্যতার কারণে পাকসেনারা শেখ আঃ রহমান সেই ব্যক্তি বলে ধারণা করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেই ড্রাইভার কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে, সে নিজে এবং জনাব তছলিমউদ্দিন বলেন যে, বছর দুয়েক যাবৎ শেখ আঃ রহমান এখানে আখ বহনকারী ট্রাকটর চালান। পাক সেনারা তাঁদের কথা বিশ্বাস করে না এবং তৎক্ষণাৎ শেখ আঃ রহমান-এর গায়ে থাকা গামছা দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে ফেলে। পাকসেনারা সেই রাতেই ড্রাইভার শেখ আঃ রহমানকে হত্যা করে। হত্যার আগে তার উপর করা হয় অমানবিক অত্যাচার, শেখ আঃ রহমান-এর দুই চোখ এবং দাঁত উপ্রে ফেলা হয়েছিল।

৪ আগস্ট রাতে পাক সেনারা বন্দিদেরকে ৭/৮ জনের দলে বিভক্ত করে ডাংগীরহাট বড় পুকুরপাড়ে বসিয়ে রাখে, তাঁদের গায়ের সাদা কাপড় দেখে মুক্তিসেনারা যেন অবস্থান না বুঝতে পারে, সেকারণে কাপড় খুলে নেয়া হয়। বন্দিদের মধ্যে বাটুল, মৌলভী সহ দুই-চার জনকে ছেড়েও দেয়া হয়। মোঃ তছলিমউদ্দিন এর পরিবারের সকল সদস্যরা ভারত এবং নিকটবর্তী সর্দারপাড়ায় অবস্থান করলেও তাঁর দুই ছেলে বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। তাঁরা সেই রাতে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত স্থানীয় মৌলভী সাহেবের কাছ থেকে মোঃ তছলিমউদ্দিনের খবর জানতে পারে। দুই সন্তান তাঁদের বাবার কাছে রাতের খাবার পৌঁছানোর চেষ্টাও করে। ৫ আগস্ট মোঃ তছলিমউদ্দিন আহাম্মেদকে ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। ঠাকুরগাঁও ক্যাম্প কমান্ডার তাকে ছেড়ে দিলেও পাক সেনারা তাকে ডাংগীরহাট ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। দুই দিন যাবৎ অমানবিক নির্যাতন শেষে ৬ আগস্ট পাক সেনারা মোঃ তছলিমউদ্দিন সহ ১৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এ গণহত্যায় সমগ্র মির্জাপুর-আটোয়ারী এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে।

৩ সেপ্টেম্বর মাটিগাড়া সইরত মোহাম্মদ ও আজিজ উদ্দিন আহমেদ সহ অনেকেই ডাংগীরহাট বধ্যভূমিতে হত্যা হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কর্তৃক ডাংগীরহাটের বর্তমান বঙ্গবন্ধু কলেজের পেছনে অন্তত ২৪ টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। দেশ শত্রুমুক্ত হলে জনাব তছলিমউদ্দিন আহাম্মেদ-এর সন্তান ও গ্রামবাসীরা গ্রামে ফিরে ডাঙ্গিরহাট বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখা অনেক গলিত লাশ দেখতে পান। মাটি দিয়ে চেপে রাখা শহীদদের লাশগুলি কুকুর শেয়াল খেয়ে ফেলেছিলো। জনাব তছলিমউদ্দিন আহাম্মেদ-এর মাথার সাদা চুল, কাপড় দেখে তাঁর সন্তানেরা মৃতদেহ সনাক্ত করেন। তছলিমউদ্দিন আহাম্মেদ-এর-এর জ্যৈষ্ঠ সন্তান আব্দুর রব ছিলেন আটোয়ারী উপজেলার প্রবীণ রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট সমাজ সেবক, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং ৩৬ বছর যাবত ৬নং ধামোর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান।

ডাংগীরহাট বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে তছলিমউদ্দিন চেয়ারম্যানসহ ৩ জনের কবর রয়েছে। কবরের স্মৃতিফলকে লেখা রয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নিহত শহীদ তসলিম উদ্দিন আহম্মেদ। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ধৃত ৪ আগস্ট বুধবার ১৯৭১, পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক নিহত ৬ আগস্ট ১৯৭১ শুক্রবার বিকাল ৫ টা।’ পাশের পুকুর পাড়ে রয়েছে অসংখ্য গণকবর।

শহীদের নামপিতার নামবয়সঠিকানা
বাংরা মোহাম্মদকিরামত আলী৫৮গাঞ্জাবাড়ি
তসলিম উদ্দিন আহম্মেদরজব আলী সরকার৬০ধামর ইউনিয়ন
শেখ আব্দুর রহমান(অজ্ঞাত)৪২ফরিদপুর জেলা
সমির উদ্দিন আহমেদ (বরিয়া)মহর আলী৫৭গিরাগাঁও
আফাজ উদ্দিননিয়ামুল২১গিরাগাঁও
বুধু মোহাম্মদনিয়ামুল১৮গিরাগাঁও
খলিলুর রহমানরহিম উদ্দিন মন্ডল৪০ফুটকিবাড়ী
কছিম উদ্দীনধনবর মোহাম্মদ৫০যুগীকাটা ডাংগী
বুধুধনবর মোহাম্মদ৪০যুগীকাটা ডাংগী
আজিম উদ্দীন আহম্মেদএকিন আলী৭০মাটিগারা
মোশারফ হোসেনমোহাম্মদ আলীমাটিগারা
সইরত মোহাম্মদ(অজ্ঞাত)৭০মাটিগারা
সাগর পাগলা(অজ্ঞাত)মাটিগারা
আক্কাস উদ্দীন(অজ্ঞাত)

অবস্থানঃ ডাংগীরহাট গণহত্যা ও নির্যাতন ক্যাম্পটি আটোয়ারী উপজেলার ধামোর ইউনিয়রের ডাংগীরহাটে অবস্থিত। গণ কবরের অবস্থান ক্যাম্পের সন্নিকটে বর্তমান বঙ্গবন্ধু কলেজের পূর্ব পাশে রাস্তা সংলগ্ন স্থানে।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি ও গণকবর | পঞ্চগড়ের তালিকাভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাপঞ্চগড়ের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা

 


তথ্যসূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) মুনতাসীর মামুন । ড. নাজমুল হক । আল ফরিদ
ছবিঃ খালেক জামান
Last updated: 18 April, 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn