১৯৭১ এর ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় মুক্ত হওয়ার দিনে পঞ্চগড় চিনিকল এলাকায় উড়তে থাকা পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে গিয়ে শহীদ হন হারুন আর রশিদ রবি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রবির এমন বীরত্বের কথা আজও শোনা যায় তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে। পঞ্চগড় জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মেলে রবি’র সাহসিকতার বর্ণনা। পঞ্চগড় মুক্ত হওয়ার দিনে দলের সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা রবির মৃত্যুতে সহযোদ্ধাদের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া।
পঞ্চগড় মুক্ত হবার অন্তিম লগ্নে পঞ্চগড় চিনিকল এলাকা জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠ। কিন্তু তখনো চিনিকলের গ্যারেজের সামনে উড়ছিল পাকিস্তানের পতাকা। স্টেনগান কাঁধে নিয়েই দৌড় দেন হারুন অর রশিদ রবি। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তিনি ওড়াতে যাচ্ছিলেন লাল–সবুজের প্রিয় পতাকা। পাশের বাঙ্কার আহত অবস্থায় পরে থাকা পাকিস্তানি এক সেনার গুলিতে হঠাৎ ঝাঁঝরা হয়ে যায় রবির বুক। পঞ্চগড় মুক্ত হওয়ার আনন্দ সেদিন বিষাদে পরিণত হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রবির রক্তে।
৭১’এর টগবগে যুবক হারুন আর রশিদ সবার কাছে পরিচিত ছিলেন রবি নামে। শহীদ হারুন অর রশিদের জন্মস্থান পঞ্চগড় সদরের ১৫ কিমি দূরের হাড়িভাসা ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী উত্তর প্রধানপাড়া। রবির জন্মদিন ১৯৫১ সালের ১১ জুলাই। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে রবি ছিলেন চতুর্থ। বাবার নাম ফজলুল করিম প্রধান। তাঁর হারুন অর রশিদ নামটি রাখেন দাদা উমের উদ্দিন প্রধান। তবে দেখতে খুব সুন্দর হওয়ায় বোন জামাতা আদর করে ডাকতেন রবি। লেখাপড়ায় ভালো ছিল রবি। আবার প্রতিবাদীও ছিল। বাড়ির পাশের পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকির সেনাদের আচার-আচরণ রবির ভালো লাগত না। রবির ছোট ভাই মাহবুব আলম-এর বর্ণনায় পাওয়া যায় কিশোর রবির সাহসিকতার গল্প…
…দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সাল। হাড়িভাসা বাজারের কাছে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনারে স্থানীয় লোকজন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা রবিও ছিলেন। সবাই যখন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল, তখন কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা বুট পরেই বেদির ওপর হাঁটছিল। সদা সাহসী রবি তা দেখে স্থির থাকতে পারেননি। বলেছিলেন, ‘আপনারা জুতা খুলে বেদিতে উঠুন।’ কিন্তু তা শুনে পাকিস্তানিরা হাসাহাসি করতে থাকে। একপর্যায়ে রবির সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয় এবং একপর্যায়ে মানুষ একত্র হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গণধোলাই দেয়। জনতা তাদের কয়েকজনের অস্ত্রও কেড়ে নেয়। রাতে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে সে অস্ত্র উদ্ধার করে পাকিস্তানি সেনারা। তখন কিছুদিন পালিয়ে ছিলেন রবি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রবি বিএ পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময় পাকিস্তানিদের অত্যাচারে তাঁর পরিবারের অন্যরা ভারতে আশ্রয় নিলেও পরিবারের কাউকে না জানিয়েই চাকুরীজীবি বড় ভাই হামিদুর রহমানের সঙ্গে হারুন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে দুই ভাই ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকায় মুজিব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। রবি ছিলেন গ্রুপ লিডার। প্রশিক্ষণ শেষে মে মাসের শেষ দিকে রবি ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অধীনে যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁরা ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর এলাকার কোটগছ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প গড়েন। কোটগছ থেকে খুব কাছেই ছিল বাংলাদেশের পঞ্চগড়। তাঁরা হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতেন পঞ্চগড়ের ফকিরগঞ্জ, ফকিরের হাট, আলোয়াখোয়া, ফুটকিবাড়ি, কিসমত, নয়নিবুরুজ এলাকায়। বড় ভাই হামিদুর রহমান ছিলেন কম্পানি কমান্ডার। রবির সহযোদ্ধা নুরুল ইসলামের মতে রবি এত সাহসী ছিলেন যে যুদ্ধে কোনো অপারেশনের কথা উঠলেই সবার আগে যেতে চাইতেন। টগবগে যুবক হারুন যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন অকুতোভয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর শেরকির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। রবি সব সময় বলতেন, যেভাবেই হোক দেশকে স্বাধীন করতেই হবে।
২৮ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর চেকপোস্ট থেকে বর্ষিত হয় শত শত গোলা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ভূমিকম্পের মতো প্রকম্পিত হয় পঞ্চগড়ের মাটি। ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। ২৯ নভেম্বর সকালে তাঁরা পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে ফকিরের হাট এলাকায় পাকিস্তানি ১২টি ট্যাংককে পিছু হটিয়ে দুপুর নাগাদ এগিয়ে আসেন পঞ্চগড় চিনিকল পর্যন্ত। সেখানেই ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে বাংকার তৈরি করে যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পাকিস্তানি সেনারা পঞ্চগড় চিনিকল এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর একসময় চিনিকল এলাকায় চারদিকে সুনসান নীরবতা দেখে ওই এলাকা পাকিস্তানি সেনা মুক্ত হয়েছে ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনি দিতে থাকেন। কিন্তু তখনো চিনিকল এলাকায় গ্যারেজের সামনে একটি পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল। হঠাৎ করেই এমন দৃশ্য দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি সাহসী যোদ্ধা হারুন অর রশিদ। স্টেনগান কাঁধে নিয়েই হারুন দৌড়ে গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলে বাংলাদেশি পতাকা ওড়াতে যান। এ সময় পাশের একটি বাংকারে আহত অবস্থায় পড়ে থাকা পাকিস্তানি এক সৈনিকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় হারুনের বুক। এ সময় তাঁর বড় ভাই কোম্পানি কমান্ডার হামিদুর রহমান তাঁর পাশে ছিলেন।
হারুন অর রশিদ শহীদ হওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর বাবার কাছে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে সত্য ও ন্যায়ের পথে নিজেদের লড়াই, বীরত্ব আর বিজয়ের আত্মবিশ্বাস উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর এলাকার কোটগছ থেকে ছোট ভাই মাহবুব আলম প্রধানের মাধ্যমে চিঠিটি প্রেরণ করেন রবি। চিঠির তারিখ ৮ আগস্ট ১৯৭১। চিঠিটি আজও তাঁর ভাতিজা (মাহবুব আলমের ছেলে) রায়হানুজ্জামান প্রধান জীবনের সংগ্রহে রয়েছে। চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলোঃ
‘৮.৮.৭১
আব্বা,
আচ্ছালামো আলায়কুম। আশা করি বাড়ীর সকলে মঙ্গল মতে আছেন। আপনাদের দোয়ায় আমরা ভাল আছি। এতদিন ধরে খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে চিঠি লিখতে পরিনি। অবশ্য এখন সৈনিক তাই সৈনিকের ফুরসত কোনদিন হয় না। তবুও হাতে যতটুকু সময় মেলে তার ভিতর দিয়ে আপনাদের খোঁজ করব। আম্মা কি রূপ আছে। বুজান, দুলাভাই, ডলি বুজান কেমন আছে। আপনারা বর্তমানে কোথায় আছেন। চিন্তা করার কিছু নাই। সময় হলেই বাড়ীতে ফিরব। মরতে একদিন হবেই। মরার আগে যেন ১০/২০টা পশ্চিমা জানোয়ারকে খতম করতে পারি এই দোয়াই করবেন। আমাদের মত কত ভাই প্রাণ দিল এবং এখনও দিচ্ছে। আমরা বর্তমানে পচাগড়ের পিছনে আছি। বাড়ীর সবাইকে দোয়া করতে বলবেন। আমাদের এ লড়াই সত্যের, ন্যায়ের। কাজেই জয় আমাদের হবেই। সেদিন বেশি দূরে নয়। দৈনিক ২/৪ জন পাক ফৌজ মরতে আছে। বিশেষ আর কি—
ভাইজিও অপর পৃষ্ঠায় লিখবে। খোদা হাফেজ।
ইতি,
রবি
রবিকে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কোটগছ বিএসএফ ক্যাম্পের সামনে দাফন করা হয়। ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী মেজর শেরকি সকলের সাথে, বড় ভাই হামিদুর রহমানের উপস্থিতে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রবির দাফন সম্পন্ন করব। হারুন আর রশিদ রবি একজন তালিকাভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। রবির নামে পঞ্চগড় সুগার মিল সড়ক ও হাড়িভাসার ঢাঙ্গীপুকুর-বাঙ্গালপাড়া সড়কের নামকরণ হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রবির কবরটি বাংলাদেশে এনে ইতিহাস সংবলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির আবেদন করা হয়েছে পরিবার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষথেকে। প্রতিবছরের ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় মুক্ত দিবসের সাথে জড়িয়ে থাকে রবির স্মৃতি।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের তালিকাভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা | পঞ্চগড়ের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা | মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিসৌধ ও গণকবর | পঞ্চগড়ের অন্যান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ
তথ্যসূত্রঃ রাজিউর রহমান | লুৎফর রহমান | মাহবুব আলম | গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে | ড. নাজমুল হক | পঞ্চগড়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
ছবিঃ লুৎফর রহমান
Last updated: 19 January 2024