শত বছরের স্বনামধন্য নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পঞ্চগড় জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবীগঞ্জে অবস্থানরত চাকলাজাত ম্যানেজার মিঃ নরেন্দ্রনাথ সেন এর মাধ্যমে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারতের দেবীগঞ্জের করতোয়া নদীর পূর্ব-পাড়ে নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে সমগ্র জলপাইগুড়ি জেলায় মাত্র দুটি ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। একটি জলপাইগুড়ি জেলা সদরে, অপরটি দেবীগঞ্জে। প্রতিষ্টাকালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ বিদ্যালয়টির নামকরণ করেছিলেন নৃপেন্দ্র নারায়ণ ইংলিশ স্কুল। ১৯৮৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দেবীগঞ্জ সফরে এসে নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়টিকে সরকারি বিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করেন। পর্যায়ক্রমে সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে (২০২৪) নৃপেন্দ্র নারায়ন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, বা সংক্ষেপে এন এন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচয় বহন করছে।

নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রথমে মধ্য ইংরেজি স্কুল (M. E. School) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯০৭-৮ খ্রিস্টাব্দে উন্নীত হয় উচ্চ ইংরেজি স্কুলে (H. E. School)। প্রতিষ্ঠা পরবর্তী বছরে (১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে) নৃপেন্দ্র নারায়ন উচ্চ বিদ্যালয়-এর ছাত্র সংখ্যা ১৫৫ জনে উন্নীত হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়টির মোট ব্যয় হয় ৩৮৯১ টাকা। উক্ত অর্থের মধ্যে জেলা পরিষদের দান করেছিল ২৯৩ টাকা, ছাত্র বেতন থেকে আদায় হয় ১০৮৫ টাকা এবং অবশিষ্ট অর্থ কোচবিহার এস্টেট থেকে প্রদান করা হয়েছিল। ১৯০৭-৮ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২৫ টাকা ১ আনা ৭ পাই। খুব অল্পদিনের মধ্যেই নৃপেন্দ্র নারায়ন উচ্চ বিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করতে সক্ষম হয় এবং এর ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পায় বিপুল হারে। তৎকালীন আসাম, কোচবিহার, রংপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠী এই প্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ শিক্ষক মন্ডলীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষা অর্জন করেছেন।
মোট ২২.৯ একর পরিমাণ সুবিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত খ্যাতিমান নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল একটি সুশৃংখল ও সুবীরব্যবস্থিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে। অতি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি মিশনারি ভবনে এর যাত্রা শুরু হয়। বিদ্যালয়টির মূল ভবনটি নির্মিত প্রাচীন পুরাকীর্তি এবং জমিদার বাড়ির আদলে। চুন-সুরকির গাঁথুনি আর লোহার পাতের ছাদ দিয়ে বিদ্যালয়টি নির্মাণ করা হয়। অতীতে নিপেন্দ্র নারায়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র নিকটবর্তী ডোমার রেলস্টেশন দিয়ে দার্জিলিং-এ যাতায়াত করতো। ২৬ কক্ষের বিদ্যালয়টিতে রয়েছে একাডেমিক ভবন, বিজ্ঞানাগার, পাঠাগার, সংগ্রহশালা, হলরুম, শিক্ষক কমনরুম, কম্পিউটার ও ICT Learning Centre এবং নামাজঘর সহ প্রয়োজনীয় সকল ভৌত অবকাঠামো। পাঠাগারে রয়েছে আঠারো শতকের স্মৃতি সম্বলিত মূল্যবান বইয়ের সংগ্রহশালা। বিদ্যালয়ের সম্মুখ সড়কে রয়েছে বিদ্যালয়ের নামে একটি পায়রা চত্বর। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ-এর স্মৃতিস্বরূপ তাঁর একটি ছবি প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বাঁধানো রয়েছে। সকল প্রাক্তন শিক্ষকদের সম্মানার্থে বিদ্যালয়ের বাগানে তাঁদের প্রত্যেকের নামে একটি করে গাছ রোপন করা আছে। বিদ্যালয়ে আবাসস্থল হিসেবে মুসলিম এবং হিন্দু ছাত্রদের জন্য দুটি আলাদা বোর্ডিং হাউস বা ছাত্রাবাস ছিল। পরবর্তীতে দুটি ছাত্রাবাসই বন্ধ করে দেয়া হয়। হিন্দু ছাত্রাবাসটি বর্তমানে (২০২৪) দেবীগঞ্জ মহিলা কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বরাবরই ঈর্ষণীয় ফলাফলের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে আসছে। বিদ্যালয়টিতে অধ্যয়ন, খেলাধুলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও বিনোদন কর্মকাণ্ড চর্চা করা হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠা পরবর্তী মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান চালু ছিল, ১৯৮৭ সালে সরকারি করণ পরবর্তী এই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পূর্বে সহ-শিক্ষাদান ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে শুধু ছাত্রদের (ছেলে) শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে।
নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার শিক্ষাব্যবস্থার এক ঐতিহাসিক স্তম্ভ। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের দূরদর্শী পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবনে এর গভীর প্রভাব অনস্বীকার্য।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক সংকট বিদ্যমান। প্রধান শিক্ষকসহ মোট ২৬টি পদের মধ্যে মাত্র ১২ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। শিক্ষক সংকটের কারণে সাময়িকভাবে কিছু খণ্ডকালীন শিক্ষক রাখা হয়েছে, যাদের বেতন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে পরিশোধ করা হয়। প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে। তবে, বর্তমানে শিক্ষক সংকট এবং কিছু ভৌত অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এই সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে বিদ্যালয়টি তার অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করে আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারবে, যা এই অঞ্চলের শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় যেন তার শতবর্ষী ঐতিহ্যকে ধারণ করে আধুনিক শিক্ষার ধারক ও বাহক হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে যেতে পারে—এটাই সকলের প্রত্যাশা।
নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং স্থানীয় সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শন আপনাকে কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখার সুযোগ দেবে না, বরং আপনাকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং একটি অঞ্চলের জীবনযাত্রার একটি গভীর উপলব্ধি দেবে।
অবস্থানঃ নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে নৃপেন্দ্র নারায়ণ সড়কের পাশে এবং করতোয়া নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড় জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ | Travel Tips | Accommodation
তথ্যসূত্রঃ ড. নাজমুল হক | পঞ্চগড় : ইতিহাস ও লোকঐতিহ্য
Last updated: 21 May 2025