পঞ্চগড় জেলার অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা শ্রী গোলকধাম মন্দির অষ্টাদশ শতকের স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শণ। ১৮৪৬ সালে নির্মিত গোলকধাম মন্দির বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। মন্দিরটি গোলককৃষ্ণ গোস্বামীর স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ হয়েছিল এবং তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়। ইতিহাস ও প্রত্নতত্বে আগ্রহী পর্যটকগণ ভিড় করেন প্রাচীন এই মন্দির প্রাঙ্গনে, নিজের চোখে দেখতে আসেন গ্রীক স্থাপত্যের প্রতিবিম্বের এক ঝলক।
গোলকধাম মন্দিরের নির্মাণশৈলীতে প্রাচীন গ্রীসের স্থাপত্যশিল্পের ছাপ পাওয়া যায়। দক্ষিণ মুখী এই মন্দিরটি মাটি থেকে বেশ উঁচুতে বৃত্তাকার ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের ভিত ৩ স্তরবিশিষ্ট। মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বারের সামনে রয়েছে সিঁড়ি। সিঁড়ির দুই পাশে রয়েছে দুটো তুলসী মঞ্চ। মন্দিরটি দেখতে ছয় কোণাকার। ছয়টি কোণে মোট ছয়টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারগুলো খিলান আকৃতির। খিলানের উপরের অংশে রয়েছে ফুল,পাতা ও পাখির নকশা। মন্দিরের প্রতিটি দরজায় বাম ও ডানদিকে দুটো করে করিন্থিয়ান কলাম আছে। করিন্থিয়ান কলামগুলোর উপরের অংশে ফুল ও মুখায়বের নকশা আছে। প্রতি দুই দরজার করিন্থিয়াম কলামের মাঝে রয়েছে একটি করে খাঁজ বিশিষ্ট কলাম।
মন্দিরের উপরে একটি নামের ফলক আছে। নামের ফলকের দু-পাশে একটি করে হাতির মুখায়বের নকশা রয়েছে। ফলক থেকে মন্দিরের স্থাপিতকাল জানা যায়। মন্দিরের প্রধান তলার উপরে আরও দুটো তলার মত গঠন দেখা যায়। মন্দিরটি যেন ইট, পাথর ও কাঠের স্থাপনার মেলবন্ধন। পুরো মন্দিরের পরতে পরতে রয়েছে রুচিশীলতার ছাপ। মন্দিরের সবচেয়ে উপরের তলায় রয়েছে ৫টি চূড়া। মাঝের চূড়াটি সবচেয়ে বড়, বাকিগুলো ছোট। প্রতিটি চূড়ার নিচের অংশে রয়েছে ৪টি করে সরু দরজা। বলাই বাহুল্য, এই সরু দরজাগুলোতেও ফুল ও নানা নকশা রয়েছে।দরজার উপরের দিকে গম্বুজ আকৃতির গঠনের উপরের রয়েছে কলসের মত ছোট গম্বুজ। কলস আকৃতির গম্বুজের গায়ে আকর্ষণীয় ফুল, লতাপাতার ভারী নকশা রয়েছে। প্রতিটি চূড়ার শীর্ষে রয়েছে একটি করে ত্রিশূল। আরও রয়েছে একটি নকশাদার গোলাকার পাত। এটি দেখতে অনেকটা সুদর্শন চক্রের মত। গোলাকার পাতের সাথে আড়াআড়িভাবে একটি দণ্ড সংযুক্ত। এটি শ্রী কৃষ্ণের বাঁশির প্রতীকী চিহ্ন বহন করে। সবচেয়ে বড় চূড়ার শীর্ষে গোলক ধাম নামযুক্ত পাতলা ফলক রয়েছে।
আঠারো শতকেও এমন নজরকাড়া স্থাপত্য নিদর্শন ছিল তা ভাবতেও অবাক লাগে। মন্দিরে অতীতের পোড়ামাটির নকশাগুলোর কোন অবশিষ্টও বেঁচে নেই। মন্দিরের ভেতরে কোন জাঁকজমকের ছাপ হারিয়েছে। মন্দিরের ভেতরের ঘরটি চার কোণাকার। ঘরের ছাদ কাঠের বীম দিয়ে তৈরি। অতীতে এখানে রাধাকৃষ্ণের পূজা করা হত। বর্তমানে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উদ্যোগে শ্রী কৃষ্ণের পূজা করা হয়।
দীর্ঘ সময়জুড়ে এই মন্দির অবহেলায় পড়ে ছিল। পরবর্তীতে ২০০০ সালে এই মন্দিরকে প্রত্নতাত্ত্বিক তালিকায় যুক্ত করা হয়। এছাড়া একটি তুলসী মঞ্চে ভেঙ্গে গিয়েছিল। যা ইতোমধ্যেই সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া মন্দিরের মূল রাস্তার সামনে রয়েছে একটি কুয়া। সংস্কারের অভাবে এখন এটি ব্যবহারযোগ্য নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক এই মন্দিরকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে সংস্কার কাজ এখন একটি দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে মন্দিরটি তাঁর জৌলুস হারিয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় ইট-রং-চুন খসে গেছে। কিন্তু এর মাঝেও স্থাপনা বৈশিষ্ট্য উঁকি দেয় সেই পুরনো রূপেই।
অবস্থানঃ গোলকধাম মন্দির দেবীগঞ্জ উপজেলা সদর হতে প্রায় ১২ কিমি উত্তর পশ্চিমে মাড়েয়া বাজার হইতে ২ মাইল দক্ষিণে করতোয়া নদীর সিকি মাইল পশ্চিমের শালডাঙ্গা ইউনিয়নে ছত্রশিকারপুর গ্রামে অবস্থিত। …Travel Tips | Accommodation | Tourist Spots
কিভাবে যাবেনঃ দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ থেকে বাসে বা অটো রিক্সা যোগে লক্ষীর হাট চৌরাস্তায় আসতে হবে। এরপর লক্ষীর হাট চৌরাস্তা নেমে অটো রিক্সা বা ভ্যান যোগে উত্তর দিকে প্রায় ৭ কিমি এসে শালডাঙ্গা বাজার। শালডাঙ্গা বাজার থেকে গোলকধাম মন্দির পায়ে হাঁটা পথ।
ছবিঃ দিপু রয়
Last updated: December 28, 2023