বোদেশ্বরী মন্দির – Bodeshwari Temple

বোদেশ্বরী মন্দির
বোদা, পঞ্চগড়।

ম্যাপঃ Google map

বোদা উপজেলায় অবস্থিত শ্রী বোদেশ্বরী মন্দির পঞ্চগড় জনপদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মন্দির। স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস করা হয়, বোদেশ্বরী মন্দির সারা বিশ্বের ৫১টি শক্তিপীঠস্থানের মধ্যে একটি। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ায় জগতমাতা সতী শ্রী শ্রী ভ্রামরীদেবী এবং মহেশ্বর ভৈরবঅমর পূজিত হয়ে আসছেন।বোদেশ্বরী মন্দির ব্রিটিশ কোম্পানি আমলে পুনঃনির্মাণ হলেও মূল মন্দিরটি ছিল অতি প্রাচীন। এই মন্দির প্রাঙ্গনেই নাকি বখতিয়ার খলজি তাঁর সেনাবাহিনীসহ অবরুদ্ধ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ও সংরক্ষিত বোদেশ্বরী মন্দির দেখতে দর্শনার্থী, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও পর্যটকরা নিয়মিত আসেন মন্দির প্রাঙ্গনে। বোদেশ্বরী মন্দিরের নামানুসারেই বোদা উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে।

করতোয়া নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে ২.৭৮ একর জমিতে নির্মিত বোদেশ্বরী একটি দালান শ্রেণীর মন্দির। জলপাইগুড়ি জেলার বিখ্যাত জল্পেস মন্দিরের স্থাপত্য কৌশলের সঙ্গে রয়েছে এর ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য। মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি মূল গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সতী দেবী এবং শিব লিঙ্গ। আছে প্রদক্ষিণ পথ ও টানেলের মতো প্রবেশ পথ। মন্দিরটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩ ফিট উঁচু। দক্ষিণের বহিঃ দেয়ালে রয়েছে আয়তাকার অন্তঃপ্রবিষ্ট প্যানেল। বারান্দা থেকে গর্ভগৃহে প্রবেশের তিনটি খোলা দরজার স্তম্ভগুলো বলয় আকারে পরিবেষ্টিত, খিলান ও ভাঁজ যুক্ত। শিবলিঙ্গ, ব্রহ্মাবিষ্ণু, গণেশ প্রভৃতি ১৮টি মূর্তি ও বিগ্রহ এখানে বাইরে থেকে এনে জড়ো করা হলেও এগুলো ছিল স্থানান্তরযোগ্য। কালো পাথরের একটি গণেশ মূর্তিও রয়েছে এই সংগ্রহের মধ্যে। বিভিন্ন পূজোর সময় উল্লেখিত সকল দেবতা, দেবী ও বিগ্রহের পুজো করা হয়। এছাড়া আদিবাসীদের পূজার্চনার রীতিতে প্রস্তর পূজা বা লৌকিক পূজারও ব্যবস্থা রয়েছে এই মন্দিরে। বর্তমানে (২০০৯) এই মন্দিরের প্রায় ৯টি মূর্তি খোয়া গেছে। বর্তমান মন্দিরের ৫০ ফুট পূর্ব-দক্ষিণে একটি অতি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। সেই মন্দির কালের আবর্তে মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। দু চারটি আস্ত ইট যা দেখা যায়, তাতে মনে হয় ঐ মন্দির ছিল অতি প্রাচীন। সেই প্রাচীন মন্দিরকেই ৫১ পিঠের এক পীঠ বলে পরিচিত করা হয়।

প্রতিবছর সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম দিবস মহালয়া উপলক্ষে ভক্তদের উপস্থিতিতে মিলনমেলায় পরিনত হয়ে ওঠে বোদেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দির প্রাঙ্গণ। মহালয়া দিবসকে কেন্দ্র করে মাতৃপূজা, শিবপূজা, বিষ্ণুপূজার পাশাপাশি পুষ্পাঞ্জলি, চন্ডিপাঠ, গীতাপাঠ, মাতৃভজন ও কীর্তনসহ ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলা ছাড়াও ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী থেকে কয়েক হাজার ভক্ত নারী পুরুষ অংশ নেয় বোদেশ্বরীর শান্তি ও সম্প্রীতিমুলক ধর্মসভায়। ধর্মীও সম্প্রীতি ও শান্তি প্রর্থনায় দিনভর চলে পুঁজা অর্চনা আর পূন্য স্নান। পিতামাতা আর পূর্বপুরুষদের স্বর্গ বাসের আশায় মন্দিরের পাশে করতোয়া নদীর তল্লিবাড়ি ঘাটে মাথার চুল ফেলে পূন্য স্নান করেন সনাতন ধর্মালম্বী ভক্তরা। শারদীয় দূর্গোৎসবের জন্য আরাধনার মাধ্যমে আমন্ত্রন জানানো হয় দেবীকে। দেবী সীতার স্মৃতিবিজরিত স্থান হওয়ায় মহালয়ায় বোদেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দির ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে।

পৌরাণিক কাহিনী এবং বোদেশ্বরী মন্দির সর্ম্পকে প্রচলিত মতবাদ থেকে জানা যায়, হিন্দু ধর্মের ১৮টি পুরাণের মধ্যে স্কন্দ পুরাণ একটি। সেই স্কন্দ পুরাণে কাশির উল্লেখ্য রয়েছে। রাজা দক্ষ একটি যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। ভোলানাথ শিব রাজা দক্ষের জামাই ছিলেন। রাজা দক্ষ কখনোই শিবকে জামাই হিসেবে মেনে নেননি। কারণ মহাবীর শিব সর্বদাই ছিলেন উদাসীন এবং নেশা ও ধ্যানগ্রস্ত। উক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানে মুনি-ঋষিগণ ও অন্যান্য দেবতাগণ নিমন্ত্রিত হলেও রাজা দক্ষ জামাই তথা দেবী দুর্গার স্বামী ভোলানাথ শিব নিমন্ত্রিত ছিলেন না। এ কথা শিবের সহধর্মিনী জানা মাত্রই ক্ষোভে দেহ ত্যাগ করেন। শিব তার সহধর্মিনীর মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে শবদেহটি কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর সর্বস্তরে উন্মাদের ন্যায় ঘুরতে থাকেন এবং প্রলয়ের সৃষ্টি করেন। সে মুহূর্তে স্বর্গের রাজা বিষ্ণুদেব তা সহ্য করতে না পেরে স্বর্গ হতে একটি সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করেন। চক্রের স্পর্শে শব দেহটি ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়। শবের ৫১টি খণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশে পড়ে দুইটি খণ্ড। একটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আরেকটি পঞ্চগড়ের বোদেশ্বরীতে। মহামায়ার খণ্ডিত অংশ যে স্থানে পড়েছে তাকে পীঠস্থান বলা হয়। বোদেশ্বরী মহাপীঠ এরই একটি। বোদেশ্বরী মন্দিরে সতীর দেহের গোড়ালি অংশ পড়ে হয় বলে প্রচলিত আছে। সে কারণে হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে এ স্থানটি পবিত্র তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং পৌরণিক কাহিনীর সূত্রে গাঁথা সতীর অঙ্গের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয় বোদেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দির।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায় যে, সতীদেহের ৫১ টি খন্ড যে যে স্থানে পতিত হয় সেই স্থানগুলো অতি প্রাচীনকাল থেকে রূপান্তরিত হয় অতি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে। উত্তর-পূর্ব ভারতে এরকম একমাত্র মন্দিরটির নাম আসামের কামরূপ জেলার কামাক্ষা মন্দির। কিন্তু পৌরণিক অভিধানগুলোতে যে ৫১টি পিঠের নাম উল্লখ্য রয়েছে, তার মধ্যে বোদেশ্বরী মন্দিরের নাম কোথাও পাওয়া যায় না। দেবীকুঠ নামক স্থানে সতীর চরণদয় পতিত হয়। সেই দেবীকুঠ যে বোদেশ্বর-এর কাছাকাছি দেবীগঞ্জে নয়, তা বলাই বাহুল্য। কোচবিহারের রাজাগণ কামাক্ষা, জল্পেস এবং বানেশ্বর তীর্থ মন্দিরে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। কিন্তু বোদেশ্বরীতে এসে তীর্থযাত্রা করে গেছেন, এ ধরনের বিবরণ কোচবিহারের ইতিহাস’সহ অন্যান্য প্রামানিক গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায় না।

মহারাজা প্রাণনারায়ন বোদেশ্বরী মন্দিরে অধিষ্ঠিত বিগ্রহের সেবাপূজার জন্য ভূমি দান করেছিলেন। প্রাচীন বোদেশ্বরী মন্দির সম্পর্কে এর বেশি বিবরণ না পাওয়ার কারণে অনুমান করা যায় যে, বোদেশ্বরী পীঠ না হয়ে, উপপীঠ হওয়ারও যৌক্তিক সম্ভাবনা বিরাজমান। কারণ সতী দেহ প্রধান ৫১ খন্ডে পরিণত হলেও আরো অসংখ্য উপখন্ডে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সে স্থানসমূহ লাভ করেছিল তীর্থ মহিমা। অবশ্য এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মতামত দিতে পারেন বিশেষজ্ঞ হিন্দু ধর্মবেত্তাগণ।

নির্মাণকালঃ ইতিহাসবিদদের প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়,বোদা অঞ্চল ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত জনপদ। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে পঞ্চগড়সহ সমগ্র উত্তর বঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত ছিল। বোদেশ্বরী মন্দিরটি কবে নির্মিত হয়েছে, কে নির্মাণ করেছেন এ ব্যাপারে স্থানীয়রা জানাতে না পারলেও বোদেশ্বরী মন্দিরের মূল অংশ পাল আমলে নির্মিত বলে মনে করা হয়। বর্তমান মন্দিরের ৫০ ফুট দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ৫১ পীঠের এক পীঠ বলে পরিচিতি প্রাচীন মন্দিরটি প্রাকৃতিক কারণে ধ্বংস হয়ে গেলে কোচবিহারের মহারাজা বর্তমান মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্থান ভাগাভাগির পর প্রতিকুল পরিস্থিতির কারণে বোদেশ্বরী মন্দিরে ভক্তদের উপস্থিতি কমতে থাকে। তবে সাম্প্রতিক কয়েক যুগ ধরে এখানে মহালয়ায় ও নিয়মিত পূজা অর্চনা করেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

অবস্থানঃ করতোয়া নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে ২.৭৮ একর জমিতে নির্মিত ঐতিহাসিক এ মন্দিরটির অবস্থান পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বোদেশ্বরী গ্রামে। Travel Tips | Accommodation | Tourist Spots

মিনাজ-ই- সিরাজী রচিত তরকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থের বর্নণা অনুযায়ী, বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনকালে বোদেশ্বরী মন্দির চত্বরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। বগুড়ার মহাস্থান গড়ে প্রাপ্ত ওই সময়কার শিলালিপি এবং ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, তিব্বত অভিযানে ব্যর্থ ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি দস্যুদের আক্রমণের ভয়ে তুর্কি ঘোড়সোয়ার বাহিনী নিয়ে বোদেশ্বরীর কাছে প্রবাহিত খরস্রোতা নদী করতোয়া পাড়ি দিয়ে নেকমরদের দিকে রওয়ানা কালে সাঁতারে অনভ্যস্থ তুর্কি বাহিনীর অনেক ঘোড় সওয়ার ঘোড়াসহ ডুবে মারা যায়। বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে দস্যুদের ভয়ে খিলজি করতোয়া নদীর তীরে জঙ্গলে একটি ভগ্ন মন্দিরে আশ্রয় নেন। পরে তিনি দেখতে পান একটি ভগ্ন দূর্গ। গবেষকদের মতে এটিই ছিল বোদেশ্বরী গড়। পাল রাজারা মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষণের জন্য নির্মাণ করেন দূর্গ।

বোদেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গনে ঢোকার সময় বামধারে দেয়ালে লেখায় ত্রিস্রোতা শব্দটি পাওয়া যায়। যার অর্থ তিনটি নদীর স্রোত এককালে এখানে বিদ্যমান ছিল। ১. তিস্তা নদীর স্রোত (এখন আর নেই) ২.করতোয়া নদীর স্রোত (কোয়ার্টার কিমি পশ্চিমে এখনো বিদ্যমান) এবং ৩. ঘোড়ামারা নদীর স্রোত (এখন খাত হিসেবে আছে)। বখতিয়ার খলজির ব্যর্থ তিব্বত অভিযান শেষে প্রত্যাবর্তন কালে নদী পার হতে গিয়ে ঘোড়াসহ সৈন্য মারা পড়ায় বর্তমান বোদা উপজেলার মাড়েয়া এবং বড়শশী ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে করতোয়া নদীর ঘাট এখনও ঘোড়ামারা ঘাট নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। মন্দিরটির পাশে অপর দুটি গড়েরও সন্ধান পাওয়া গেছে। ভিতর গড় ও বাহিরগড় নামে গড় দুটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত। ঐতিহাসিক বোদেশ্বরী মন্দির বাহিরগড়ের প্রাচীর পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় দেড় মাইল এবং উত্তর-দক্ষিণে এক মাইল লম্বা। মাটির তৈরি এই গড়ের দেয়ালগুলি গড় উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট। দেয়ালের উপরে রয়েছে অসংখ্য বড়বড় শালগাছ। দেয়ালের বাইরের অংশে রয়েছে ৩৫ ফুট চওড়া পরিখা।

 


তথ্যসূত্রঃ পঞ্চগড় জেলের ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি | ড. নাজমুল হক | তোফাজ্জল হোসেন | কামরুল ইসলাম কামু
Last updated: 19 February 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn