পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে ১৬ কিমি উত্তরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর অবস্থিত ভিতরগড় দুর্গ নগরী দেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল। উত্তরবঙ্গের প্রাচীন ইতিহাসে বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরের বানগড়, বিরাটগড় এবং পঞ্চগড়ের ভিতরগড় রাজ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে এবং সাম্প্রতিক কালে ইতিহাস বিশ্লেষণ, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এবং খননের নিরিখে উল্লেখিত সময়কালের একাধিক দুর্গ নগরীর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া গেছে। খুঁজে পাওয়া দুর্গ নগরীর মধ্যে মহাস্থানগড় প্রাচীন দুর্গ নগরী বলে বিবেচিত। কিন্তু আয়তনের দিক থেকে ভিতরগড় দুর্গনগরী ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ। মধ্যযুগীয় সুপ্রাচীন ভিতরগড় দূর্গের সম্পূর্ণ এলাকার আয়তন ছিল ২৫ বর্গ কিমি। ঐতিহাসিক ভিতরগড় দুর্গ নগরীটি মূলত পঞ্চগড় জেলা সদরের অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত। এর মাটির নিচে লুকিয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার, অসংখ্য স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নবস্তু। পুরো দুর্গটি কয়েকটি স্তরে চারটি আবেষ্টনী দেওয়াল দিয়ে বিভক্ত ও এর উত্তর দিকের দেওয়াল এবং পূর্ব-পশ্চিম দেওয়ালের কিছু অংশ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় পড়েছে।
১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বুকানন হ্যামিল্টন ভিতরগড় পরিদর্শন শেষে নগরীটি চারটি আভ্যন্তরীক গড়ের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ইঙ্গ-আইরিশ সরকারী কর্মকর্তা রবার্ট মন্টগোমারি মার্টিন কর্তৃক লিখিত দ্য হিস্ট্ররী, এন্টিকুইটিয, টপোগ্রাফি এণ্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ইস্টার্ণ ইন্ডিয়া গ্রন্থটির ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ৩য় খণ্ডে সর্বপ্রথম ভিতরগড় দুর্গের উল্লেখ দেখা যায়। ২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব)-এর সহযোগী অধ্যাপক প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. শাহনাজ হুসনে জাহান ভিতরগড় দুর্গ নগরীর গুরুত্ব অনুধাবন করে তা খননের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে ইউল্যাব-এর তত্ত্বাবধানে, ড. শাহনাজের নেতৃত্বে এবং সর্বোপরি ইউল্যাব-এর ছাত্র-ছাত্রীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বেশ কয়েকবার খননকাজ পরিচালনা করে ভিতরগড় দুর্গের অভ্যন্তরে ২২ প্রত্নস্থল চিহ্নিত করে। এ প্রত্নস্থলসমূহ পঞ্চগড় জেলা সদরের অমরখানা ইউনিয়নের খালপাড়া গ্রাম ছাড়াও প্রধানপাড়া, ছোট কামাত, চুমানুপাড়া, কমলাপাড়া, সেনপাড়া, পেশকার পাড়া, জমাদার পাড়া, বড় কামাত, মেহনা ভিটা ও সিপাহি পাড়া গ্রাম জুড়ে অবস্থিত।
ভিতরগড় দুর্গনগরী এলাকাজুড়ে দ্বারা পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণাধর্মী প্রকল্পটি ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কাল যাবৎ পরিচালনা করা হয়। প্রত্নতত্ত্ব খনন প্রকল্পটি ২০০৯ সাল থেকে ইউল্যাব দ্বারা অর্থায়ন এবং ২০১৩ সাল থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পেয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে সামগ্রিক জরীপ পরিচালনা করে।
নির্মানকালঃ ভিতরগড় রাজ্য সম্পর্কিত খুব কম বা কোন নথিভুক্ত ইতিহাস নেই, এই দুর্গের আশেপাশে বসবাসকারী লোকদের মনে হাজার বছর ধরে শুধুমাত্র মৌখিক ঐতিহ্যে (উপাখ্যান/গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা) ভিতরগড় রাজ্য একটি কিংবদন্তি ইতিহাস হিসাবে বেঁচে আছে। ভিতরগড় দুর্গ নগরী নির্মানকাল সম্পর্কে দুটো ধারণা পাওয়া যায়। (ক) কামরূপের শূদ্র বংশীয় রাজা দেবেশ্বরের বংশজাত পৃথু রাজার নাম ভিতরগড়ের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। রাজা পৃথু এক হাজার বছর আগে বর্তমান উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের স্বাধীন শাসক হিসেবে প্রাচীন ভিতরগড় নগরী শাসন করেছিলেন। ৬ষ্ঠ শতকের শেষার্ধে সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় পৃথু রাজার অভ্যুদয় ঘটে। পৃথু রাজা কামরূপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড় এলাকায় আগমন করেন, নির্মাণ করেন গড় এবং স্থাপন করেন রাজ্য। পৃথু রাজার নবগঠিত এই রাজ্য বৈকুন্ঠপুর পরগণার অর্ধেক ও বোদা চাকলার অর্ধেক অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। (খ) ইতিহাসে এটাও উল্লেখিত রয়েছে যে, নবম শতকের রাজা জল্পেশ ও পৃথু রাজা ছিলেন অভিন্ন ব্যক্তি। তাঁর রাজধানী ছিল ভিতরগড়। নবম বা দশম শতাব্দীতে কম্বোজ বা তিব্বতীয়দের আক্রমণ থেকে উত্তরবঙ্গ রক্ষার জন্য পাল বংশীয় রাজাগণ ভিতরগড় দুর্গটি নির্মাণ করেন।
ইতিহাসবিদগণ আরও সংযোজন করেন, ১২৫৭ সালে সুলতান মুঘিসউদ্দীন কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করলে এটি সুলতানী শাসনে চলে আসে। ১৪৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভিতরগড় অঞ্চলটি কামরূপ রাজ্যের হোসেন শাহ শাসন করেছেন। এছাড়াও এ অঞ্চলটি একসময় গৌড় ও প্রাগজ্যোতিষপুরের অংশ ছিলো বলে মনে করা হয়। খনন কাজের সময় ভিতরগড় দুর্গ এলাকায় দুটি প্রাচীন মন্দির আবিষ্কৃত হয়। উল্লেখিত ইতিহাস বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, ভিতরগড়ের প্রাথমিক কাঠামো পৃথু রাজা কর্তৃক আনুমানিক ষষ্ঠ শতকেই নির্মিত হয়েছিল। অতঃপর ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের মাঝামাঝি পর্যায়ে পাল বংশীয় এবং পরবর্তী রাজাদের দ্বারা এই অঞ্চল অধিকৃত ও শাসিত হওয়ার কালে গড়ের সংযোজন ঘটেছে।
কাঠামো ও নির্মাণশৈলীঃ ভিতরগড় দুর্গনগরী প্রায় ২৫ বর্গ কিমি ব্যাপ্ত এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। ভিতরগড় নগর ৪টি স্তরের সমন্বয়ে গঠিত। স্তরগুলো ছিল একটি অপরটি দ্বারা পরিবেষ্টিত। সমর জ্ঞানের স্বল্পতা এবং যুদ্ধ অভিজ্ঞতার অর্জনের পূর্বেই ভিতরগড় দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল, কেননা ভিতরগড়ের অন্যান্য স্তরের তুলনায় সম্মুখ স্তর প্রতিরক্ষামূলক ছিল না। সর্ব অভ্যন্তরীণ স্তর ছিল অত্যন্ত সুসংহত এবং মজবুত ভাবে নির্মিত। ভিতরগড় দুর্গ নগরুটি মূলত একটি সামান্তরিক ক্ষেত্র।
সবচেয়ে বাইরের নগরীতে নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা বসবাস করতেন এবং এই নগরীর নাম ছিল হরির ঘর। বাহিরের এই নগরীগুলো উঁচু প্রাচীর এবং পরিখা দিয়ে ঘেরা। প্রাচীর ছিল মাটি ও ইটের মিশ্রণে তৈরি আর পরীখা ছিল প্রায় ৫০ ফুট প্রশস্ত এবং ১০/১৫ ফুট গভীর। সবচেয়ে বাহিরের নগরটি ছিল উত্তর দক্ষিণে প্রায় ৪ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমের প্রায় ৩ মাইল প্রশস্ত। ভিতরগড় দুর্গের প্রতিটি প্রাচীরের পরিখায় পার্শ্ববর্তী তালমা নদী থেকে পানির প্রবাহ নিয়ে আসা হয়. উত্তর দিকের প্রাচীর স্থাপন করা হয় একটি বাঁধ। বাঁধের মাধ্যমে তালমা নদীর প্রবাহকে বিকল্প পথে নিয়ে আসা হয় দুর্গের ভেতরে। বাঁধের নাম রাখা হয় বীর বাঁধ।
মধ্যবর্তী নগরটি ছিল পূর্ব পশ্চিমে ৩৫৩০ গজ এবং উত্তর দক্ষিণে ৬৩৫০ গজ লম্বা। এই দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী দুর্গের প্রাচীর অধিকাংশ ইট দ্বারা নির্মিত। মধ্যবর্তী দুর্গের উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে ছিল দুটি সুপরিসর তোরণ। উত্তর দিকের তোরণের নাম ছিল ‘কাল দুয়ার’ আর দক্ষিণে ‘যম দুয়ার’। তোরণ সংযুক্ত ইটের গাঁথুনির প্রাচীর এখনো রয়েছে অক্ষুন্ন।
সবচেয়ে ভেতরের স্তরে ছিল রাজার প্রাসাদ। প্রাসাদ পরিবেষ্টিত ছিল সুদৃঢ় দুর্গ নগরী দ্বারা। এই নগরী ছিল সম্পূর্ণ ইটের তৈরি ১৮ ফুট উঁচু এবং ৭ ফুট প্রশস্ত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। রাজপ্রাসাদের সন্নিকটে ছিল বর্তমানের মহারাজার দিঘী। রাজপ্রাসাদ এবং মহারাজা দিঘী পরিবেষ্টিত নগরটি ছিল পূর্ব-পশ্চিমে ১৯৩০ গজ দীর্ঘ এবং উত্তর দক্ষিণে ৩৪৫ গজ প্রশস্ত। মহারাজার দিঘী একটি বিশালায়তন জলাশয়। ৮০০ x ৪০০ গজের এই দীঘির পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২০ ফিট। ঐতিহাসিক এই দীঘির পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ। এখনো (২০২৪) দীঘির চারিদিকে রয়েছে ১০টি বাঁধানো ঘাট। সময়ের ব্যবধানে পৃথু রাজা কিচক নামের অসাধু ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হলে নিজ পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় পরিবার পরিজন ও ধনরত্ন সহ মহারাজার দিঘীতে আত্মহত্যা করেন। রাজার রক্ষীবাহিনীও তাঁকে অনুসরণ করে। সেই সাথে অবসান ঘটে পৃথু রাজার রাজত্বের। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ভিতরগড় দুর্গ নগরী জরিপকালে স্থানীয়রা রবার্ট মন্টগোমারি মার্টিন এই গল্পটি বলেছিলেন।
মহারাজার দিঘী থেকে প্রায় ৪০০ গজ দূরে ইটের প্রাচীর ঘেরা নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাজবাড়ী ছিল বলে ধারণা করা হয়। উক্ত স্থানটি বৃত্তাকার এবং সমতল ভূমি থেকে উচু। এখানে রাজকীয় প্রাসাদ বা স্থাপত্য নিদর্শনের তেমন কোন চিহ্ন না থাকলেও এখানে রয়েছে কয়েকটি ইমারত এবং একটি কূপের ভগ্নাংশ ও ধ্বংসস্তূপ। রাজবাড়ি থেকে কিছুটা উত্তরে রয়েছে একটি প্রাচীন পুকুর। পুকুরের উত্তর দক্ষিণে রয়েছে প্রাচীরের ইটে পরিপূর্ণ দুটি ছোট ঢিবি। জনশ্রুতি আছে, উত্তরের ঢিবিটি ছিল মন্দির এবং দক্ষিণের ঢিবিটি ছিল রাজ দরবার। দক্ষিণের ঢিবির ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গেছে বেশ কিছু পাথরের স্ল্যাব।
দুর্গ নগরী একাধিক ক্ষুদ্র নগরীর সমন্বয়ে গঠিত ছিল। প্রথম ও মধ্যস্তরের দুর্গ নগর প্রাচীরের মাঝে অর্ধগোলাকার পার্শ্ব বুরুজ নির্মাণ করা হয়েছিল। পার্শ্ব বুরুজ ব্যবহার করা হতো সেনা প্রহরার কাজে। ভিতরগড়ের সবচেয়ে বাহিরের নগরে আবিষ্কৃত ইটের স্তুপ দেখে ধারণা করা হয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এখানে ছিল একটি পর্যবেক্ষক টাওয়ার (মিনার)। এর পার্শ্ববর্তী বর্তমান সিপাহীপাড়া নামক স্থানে ছিল ভিতরগড় দুর্গের বহির্গমন পথ। উল্লেখিত ৪ টি গড় ব্যতীত ভিতরগড় দুর্গ নগর সীমা বহির্ভূত এলাকায় আরো কিছু গড়ের অবস্থান খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে ধুমগড় উল্লেখযোগ্য। কিছু গড় শত্রু পক্ষের দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।
ড. শাহনাজ হুসনে জাহান তাঁর গবেষণায় ভিতরগড় দুর্গ নগরীর নিম্নোল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করেছেনঃ
(ক) ভিতরগড় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সুরক্ষিত দুর্গ নগরী। প্রায় ২৫ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
(খ) ভিতরগড় নগর ছিল প্রাচীর এবং পরিখা সম্বলিত চারটি চতুর্ভুজ স্তর বিশিষ্ট। স্তরগুলো ছিল একটি অপরটি দ্বারা পরিবেষ্টিত।
(গ) সুদক্ষ পরিকল্পনায় গড়া ভিতরগড় দুর্গ নগর একটি অনন্য স্থাপত্যের নিদর্শন।
(ঘ) ইটের দশটি পাকা ঘাট এবং উঁচু বাঁধ সম্বলিত বিস্তৃত জলাশয়ের মহারাজার দীঘি ভিতরগড়কে বিরল দূর্গে পরিণত করে তুলেছিল।
(ঙ) ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়েকালে ভিতরগড় একটি স্বাধীন নগর-রাজ্য হিসেবে সার্বভৌম প্রশাসনিক ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল।
(চ) ভিতরগড়ের অভ্যন্তরীণ কৃষি এবং সেচ ব্যবস্থা ও নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাথরের বাঁধ ছিল উদ্ভাবনীশৈল ও উন্নততর।
(ছ) সড়ক ও নদীপথের ওপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল।
(জ) অবস্থানগত ও কৌশলগত ভাবে করতোয়া ও তিস্তা নদী প্রাচীন এই নগর-রাষ্ট্রের বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো।
(ঝ) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ইকো-ট্যুরিজমের জন্য ভিতরগড় একটি বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান।
ইউল্যাবের গবেষকরা দুটি মন্দিরসদৃশ স্থাপনার সন্ধান পান। ধারণা করা হচ্ছে, এসব স্থাপনা অষ্টম শতকে ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্র অনুসরণ করে নির্মিত। এযাবৎ আবিষ্কৃত আটটি স্থাপনার ভিত্তি কাঠামো থেকে লাল ও ধূসর রঙের নকশাখচিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে আছে থালা, বাটি, হাঁড়ি ও মাটির প্রদীপ।
অবস্থানঃ পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে ১৬ কিমি উত্তরে পঞ্চগড় জেলা সদরের অমরখানা ইউনিয়নে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর অবস্থিত। দুর্গ নগরটি ২৬°২৪´৫৯.৩৩ থেকে ২৬°২৮´১৭.৬৪ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৩৫´২২.৯৯ থেকে ৮৮°৩৮´০৮.৮৪ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এলাকায় অবস্থিত। বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃদেশীয় বিভাজনের কারণে ভিতরগড় দুর্গ নগরীর উত্তর-পশ্চিম, উত্তর এবং উত্তর-পূর্বে এর বাইরের ঘেরের কিছু অংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় পড়েছে।
বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য অন্নেষনে ভিতরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রাচীন শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ মানব ও প্রাকৃতিক কার্যকলাপের কারণে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই পঞ্চগড় জেলার ভিতরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যবাহী স্থানটিকে পুরাকীর্তি আইনের আওতায় এনে অবিলম্বে রক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব সুহেল আহমেদ চৌধুরী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এন. এম. হাবিবুল্লাহ এবং ড.শাহনাজের নেতৃত্বে ভিতরগড় সংরক্ষণ সমিতি (Bhitargarh Promotional Society) গঠিত করা হয়। এই সমিতি ভিতরগড়ে উৎখনন, প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনের সংরক্ষণ এবং ভিতরগড় দুর্গ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। স্থানীয় অধিবাসী, স্যালিলান টি এস্টেট, এসিআই গোদরেজ পোলট্রি ফার্মসহ কয়েকটি কম্পানির হাত থেকে ভিতরগড়কে রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর পক্ষে ২০১১ সালের ১৪ জুন উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন আইনজীবী মঞ্জিল মোরশেদ। একই সঙ্গে ভিতরগড় প্রত্নসীমার ২৫ বর্গকিলোমিটারজুড়ে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়াতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে টোকাপাড়া বিজিবি ক্যাম্প, স্যালিলান টি এস্টেটসহ প্রত্নসম্পদ ধ্বংসকারী একাধিক চা-বাগান, মাজার, দোকানপাট ইত্যাদি।
ইউল্যাবের অধ্যাপক ও ভিতরগড় খননকাজের উদ্যোক্তা ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, ‘অপার সম্ভাবনাময় ভিতরগড় দুর্গনগরী শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজনীয় উৎস সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে। পর্যটনশিল্পের জন্য ভিতরগড় হতে পারে বাংলাদেশের প্রত্ন নিদর্শনের এক বিশাল ভাণ্ডার। অথচ ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই প্রত্নস্থল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশ।’ তিনি অবিলম্বে ভিতরগড় এলাকায় যারা শক্ত স্থাপনা তুলছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ভিতরগড়কে ‘ঐতিহ্য স্থান’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান। ভিতরগড় রক্ষার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় স্থানীয়দের সংশ্লিষ্ট করে পরিবেশ বান্ধব পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা, যাদুঘর প্রতিষ্ঠা, হেরিটেজ মেলা ও স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলা আয়োজন করা জরুরি। ড. শাহনাজ হুসনে জাহান শালমারা ভিতরগড় হাই স্কুলে ভিতরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে একটি জাদুঘর নির্মাণের প্রকল্পনা করছেন। ইতিমধ্যে ড. শাহনাজ ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা প্রায় ৪০০ বই, প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত পোস্টের শালমার ভিতরগড় স্কুলে প্রদান করেছেন।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড় জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ | পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
তথ্যসূত্রঃ ড. শাহনাজ হুসনে জাহান | ড. নাজমুল হক | সুহেল এ. চৌধুরী | শরীফ উদ্দিন আহমেদ | Bhitargarh Promotional Society | মোঃ লুৎফর রহমান
ছবিঃ এস.এ. সেলিম | ড. শাহনাজ হুসনে জাহান
Last updated: 6 May 2024