পঞ্চগড় জেলার অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ মন্দির, মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপ বাহাদুর এর মহতী স্থাপনা জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি দেবীগঞ্জের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। দেবীগঞ্জের পূজা-পার্বণ উদযাপনের কেন্দ্র ঐতিহ্যবাহী জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দিরটি ১৯১৪ সালে পঞ্চগড় ভারতবর্ষের কুচবিহারের অর্ন্তভুক্ত থাকাকালীন সময়ে কুচবিহারের মহারাজা নিপেদ্র নারায়ণ ভুপ বাহাদুর নির্মাণ করেন। জগবন্ধু ঠাকুরবাড়িতে প্রতিবছর সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা আর পঞ্চগড় জেলার সব থেকে বড় দূর্গা পূজার আয়োজন হয় এখানে। দুর্গাপূজার সময় মন্দির প্রাঙ্গনে সপ্তাহব্যাপী বসে মেলা, আয়োজন করা হয় মনোমুগ্ধকর আলোকসজ্জা। শত বছরের পুরানো এই মহতী স্থাপনা দেখতে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ভিড় করেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কোচবিহার মহারাজা নিপেদ্র নারায়ণ তাঁর চাকলাজাত এস্টেট বোদা, পাটগ্রাম এবং পূর্বভাগ চাকলার সদর কার্যালয় বোদার কুমারী কোট থেকে দেবীগঞ্জে সরিয়ে আনেন। অতঃপর বিংশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে মহারাজার ম্যানেজার ভজনপুর তহশীলে যাওয়ার সময় শালডাঙ্গার জঙ্গলে পৌঁছালে বাহক হাতি চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং এগিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। হাতির লাগাম ছেড়ে দেয়া হলে, হাতিটি একটি পোড়া ভস্মের কাছে এসে থামে। হাতিটি তাঁর শূঁড় দিয়ে সেই ভস্ম সরানো শুরু করলে তার ভেতরে দেখা যায় একটি পিতলের মূর্তি। মূর্তিটি ছিলো দশভুজা বা দুর্গার। মূর্তি উদ্ধারের পর হাতিটি ভজনপুরের দিকে অগ্রসর হতে না চাইলে, ম্যানেজার পুনরায় দেবীগঞ্জে ফিরে আসেন। মূর্তি লাভের খবর পাঠানো হয় মহারাজা নিপেদ্র নারায়ণ-এর নিকট। রাজা বলে পাঠান মূর্তিটি যেহেতু আংশিক ভাঙ্গা, সেহেতু সেটি কাশীতে পাঠিয়ে ভালোভাবে নির্মাণ করা হোক এবং দেবীগঞ্জে একটি মন্দির নির্মাণ করে তারপর মূর্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত করা হোক সেই মন্দিরে। ঠাকুরবাড়ির বর্তমান পূজারী ঠাকুর অভিমত ব্যক্ত করেন যে, শালডাঙ্গায় প্রাপ্ত উক্ত বিগ্রহটি সম্ভবত দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠকের আন্দোলনের সময় তাঁদেরই উপাসনার জন্য গভীর জঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের ইচ্ছা অনুযায়ী মূর্তিটিকে কাশীতে পাঠিয়ে অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি করে আনা হয়। ইতিমধ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় জগবন্ধু ঠাকুর বাড়ি। সেখানেই স্থাপন করা হয় দশভূজা দুর্গা মূর্তি। পরবর্তীতে কালক্রমে মন্দিরটির ক্ষয়ক্ষতি হলে ব্রিটিশ কোম্পানি আমলের অট্টালিকা রীতিতে ব্রিটিশ স্থাপত্যের সাথে মিল রেখে ইট, সুরকি, চুন, পাথর ও লোহার সমন্বয়ে জমিদার বাড়ির আদলে পুনর্নির্মাণ হয় জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি। সেই সময় (১৯০৬) কোচবিহার মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ দেবীগঞ্জে একটি ইংরাজি স্কুল যা নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি স্কুল নামে পরিচিত এবং একটি দাতব্যচিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন (১৯০২)। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে উক্ত দশভূজা দুর্গা মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়।
জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দিরের মূল ভবনে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি গোলাকৃতির প্রবেশদ্বার, যার উভয় পাশে উঁচু দুটি পিলার এবং বাম দিকে পুরোহিত প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি ছোট প্রবেশদ্বার। মন্দিরের ভিতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য গোলাকার আকৃতির ৮টি জানালা এবং মন্দিরের ভিতরে ৩টি কক্ষ রয়েছে। ডান পাশের কক্ষে দেবী কালীর প্রতিমা, মাঝের কক্ষে দেবী দূর্গার এবং বাম পাশের কক্ষে কৃষ্ণ ঠাকুরের প্রতিমা রয়েছে। মন্দিরের পিছনের অংশে রয়েছে পূজা অর্চনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত পুরোহিতের থাকার জায়গা ও মন্দির কমিটির কার্যালয়, মন্দিরের ডানে দূর্গা পূজার স্থায়ী মন্ডব, সামনে বিস্তৃর্ণ ফাঁকা মাঠ এবং চতুর্দিক ইটের সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ঐতিহাসিক জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দির।
প্রতিবছর বৃহৎ পরিসরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজার আয়োজন করা হয় জগবন্ধু ঠাকুরবাড়িতে। দুর্গাপূজার সময় মন্দির প্রাঙ্গনে বসে সপ্তাহব্যাপী মেলা। এছাড়া সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা সহ সনাতন ধর্মের অন্যনা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এখানে পালন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১১০ বছর ধরে নিয়মিত পূজা, অর্চনা চলছে। এছাড়া প্রতিদিন গীতা পাঠ এবং প্রতি শুক্রবার ও শনিবার ধর্মীয় আলোচনা হয়ে থাকে। শত বছরের পুরানো ঐতিহাসিক জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দির দেখতে দূরদূরান্ত থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ছুটে আসেন দেবীগঞ্জে। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ব্রিটিশ শাসন এবং পাকিস্তানি শাসন আমল পার করে স্বাধীন বাংলাদেশে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের ভুপ বাহাদুরের স্মৃতি জাগরুক করে ১১০ বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি।
অবস্থানঃ জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলা শহরের করতোয়া সেতু রোড তথা এশিয়ান মহাসড়ক সংলগ্ন মধ্য পাড়ায় ১ একর ৪ শতাংশ জমির উপর জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ির অবস্থান।
কিভাবে যাবেনঃ দেবীগঞ্জ উপজেলা শহরের যেকোনো স্থান থেকে, রিক্সা বা অটোভ্যান করে জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি পৌঁছাতে পারবেন। …আরো পড়ুন পঞ্চগড় জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানসমূহ | Travel Tips | Accommodation
তথ্যসূত্রঃ পঞ্চগড় জেলের ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি | ড. নাজমুল হক
ছবিঃ মোস্তাফিজ মাসুম | স্বপ্নচিত্র
Last updated: 8 October, 2024