তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়ন থেকে প্রায় পাঁচ মাইল উত্তর দিকে ভদ্রেশ্বর গ্রামে ভদ্রেশ্বর শিব মন্দিরটি অবস্থিত। বহু প্রাচিনকাল থেকে ভদ্রেশ্বর শিব মন্দিরে পালিত হয়ে আসছে শিব আরাধনায় শ্রেষ্ট তিথি মহা শিবরাত্রি ও শিব চতুর্দশী পূজা। হিন্দু পুন্যার্থীগন ফাল্গুন মাসের অমাবস্যায় কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে মন্দিরে সমবেত হন দূর-দূরান্ত থেকে। তিথি নহ্মত্র অনুসারে নিয়ম মেনে উপোস করে স্রান সেরে পূজো দেন ভক্তরা। সকাল থেকে মন্দিরে ভক্তরা নিষ্টা সহকারে শিবলিঙ্গের মাথায় জলঢেলে জগতের মঙ্গল কামনা করেন।
মহাশিবরাত্রি হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব ‘শিবের মহা রাত্রি’। অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত পালিত হয়। অগণিত ভক্ত এইদিন শিবলিঙ্গে গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা, ফুল দিয়ে পূজা করে থাকে। শিব আরাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ তিথি। পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী এদিনই নিরাকার থেকে সাকার রূপে অবতরিত হয়েছিলেন দেবাদিদেব। তাই ধূমধামের সঙ্গে এই তিথি পালিত হয়।
শিবরাত্রি বা শিব চতুর্দশী পূজা উপলক্ষে প্রতিবছরে ভক্তের ঢল নামে ভদ্রেশ্বর মন্দিরে। পূজায় আগত পূণ্যার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ে নারী পূণ্যার্থীদের উপস্থিতি থাকে বেশী। পূজাকে কেন্দ্র করে মন্দিরের আশপাশে নানান পরশার দোকান বসে মেলায় পরিণত হয়। মেলায় হিন্দু- মুসলিম ধর্ম বর্ণ ভুলে সকল ধর্মের মানুষের ব্যাপক সমাগম ঘটে। দেশ বিভক্তির আগে আশপাশে প্রায় শত কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই মন্দিরে জমায়েত হয়ে জমকালো আয়োজনে উৎসবটি পালন করা হলেও, দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তান আমলে এই স্থানে উৎসব পালনে নানান প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ভদ্রেশ্বর মন্দিরে ছোট পরিসরে প্রতি বছর মানুষের সমাগম বাড়ছে। পঞ্চগড় জেলার বাইরে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভক্তরা এই পূজায় উপস্থিত হোন।
অবস্থানঃ তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়ন থেকে প্রায় পাঁচ মাইল উত্তর দিকে ভদ্রেশ্বর গ্রামে ভদ্রেশ্বর শিব মন্দিরটি অবস্থিত।
জনশ্রুতি আছে, ভারতবর্ষে তিনটি শ্রেষ্ঠ শিব মন্দির আছে। ভারতে অবস্থিত জালেশ্বর মন্দির ও তারকেশ্বর মন্দির আর বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ার ভজনপুরের এই ভদ্রেশ্বর মন্দির। কালের আবর্তে এবং সংরক্ষণের অভাবে ভদ্রেশ্বর মন্দির ধ্বংস প্রায়। মন্দিরে থাকা কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গটিও চুরি হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতেএই মন্দিরটি প্রগতিহাসিক কালে নির্মিত হলেও বর্তমান কাঠামোটি সাম্প্রতিককালে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। পৌনেক অভিধানে ভদ্রেশ্বর (ভদ্রা) নামে একটি উপ পিঠের নাম পাওয়া যায়। ভদ্রেশ্বর শিব মন্দিরটি সেই উপপিঠ কিনা এ ব্যাপারে সঠিক মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে মন্দিরটি যে অতি প্রাচীন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এই মন্দিরের বহিরঙ্গন ঘিরে অন্তত দুটি পাতা গৃহ নির্মিত হয়েছিল। জলপাইগুড়ির বিখ্যাত ‘জল্পেশ’ শিব মন্দিরের অনুরূপ ভদ্রেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহও ভূগর্ভে প্রথিত। এর গভীরতা সমতল ভূমি থেকে ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। মন্দিরের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি দরজা।
৮ স্তর বিশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে উভয় দরজার মাধ্যমে নিচে নামা যায়। গর্ভ গৃহে শিব লিঙ্গ স্থাপিত রয়েছে। পাশের দেয়ালে রয়েছে ছোট কুলুঙ্গি, প্রদীপ জ্বালানোর জন্য। ভূগর্ভস্থ ঘরটি প্রাচীন ইটের গাঁথুনিযুক্ত এবং বাঁধানো। অভ্যন্তরীণ গৃহটি সিঁড়ির স্থানদুটির পরিধি ব্যতীত ৫ x ৫ ফুট এর বেশি নয়। সেসব গৃহের ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটের মাপ ১০ x ৮ x ২ ইঞ্চি। মাটির নিচের গর্ভগৃহটি সুপ্রাচীন, উপরের কাঠামোটি সাম্প্রতিককালে নির্মিত। স্থানীয় জনগণের মতে, পূর্বে চতুর্দিকে ছিল খোলা বারান্দা যুক্ত কাঠের ঘর। বর্তমানে ইটের তৈরি কাঠামোর উপর স্থাপিত হয়েছে টিনের চৌচাল।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড় জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
তথ্যসূত্রঃ পঞ্চগড় : ইতিহাস ও লোকঐতিহ্য । ড. নাজমুল হক | এম এ বাসেত | তেঁতুলিয়ার ইতিহাস ও পর্যটন শিল্প
Last updated: 18 May 2024