পঞ্চগড় নৌকাডুবি – Panchagarh Boat Capsize

২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর (রবিবার) পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলায় অবস্থিত করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে এক ভয়াবহ নৌকাডুবির দুর্ঘটনা ঘটে। নৌকাডুবির এ ঘটনায় ৭১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাঁরা করতোয়া নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে আয়োজিত ধর্মসভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।

২৫ সেপ্টেম্বর রবিবার, করতোয়া নদীর অপরপাড়ে বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে এক বিশাল ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। ধর্মসভায় যোগ দিতে বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকজন শ্যালো মেশিনচালিত একটি নৌকাযোগে মন্দিরে তীর্থযাত্রা করছিলেন। দুপুরের দিকে নদীর মাঝপথে অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নৌকাটি উল্টে যায়। অল্প কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অধিকাংশ মানুষ নদীতে নিখোঁজ হন। নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। ৩ অক্টোবর ভোর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা ১২টি দলে বিভক্ত হয়ে উদ্ধার অভিযান চালান। উদ্ধারকাজে মোট ৭০ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট থেকে দিনাজপুরের আত্রাই নদ পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিঃমিঃ এলাকাজুড়ে এ উদ্ধার অভিযান চলেছিল। নৌকাডুবির ঘটনার ৮ দিন পর, ৩ অক্টোবর ভোরে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ করে নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে যান।

নৌকাডুবির ঘটনার চতুর্থ দিন পর্যন্ত উদ্ধারকৃত ৬৯ জনের মরদেহের মধ্যে ছিলেন বোদা উপজেলার ৪৬, দেবীগঞ্জ উপজেলার ১৭, আটোয়ারী উপজেলার ২, পঞ্চগড় সদরের ১ এবং ঠাকুরগাঁও সদরের ৩ জন। মৃতদের মধ্যে ছিলেন পুরুষ ১৮, নারী ৩০ এবং শিশু ২১ জন। এছাড়া ৩ জন নিখোঁজ থাকেন যাদের সন্ধান তখনও পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে নৌকাডুবির দেড় মাসের মাথায়, ৯ নভেম্বর নৌকাডুবির স্থান থেকে প্রায় ৫০ গজ দক্ষিণে নদীর বালুর নিচ থেকে ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) নামে নিখোঁজ এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪৭ দিনের মাথায় ১১ ই নভেম্বর, কাছাকাছি স্থানে বালুর নিচ থেকে জয়া রানী (৪) নামের এক শিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। যাতে সর্বমোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১।

নৌকাডুবিতে বোদা উপজেলার সাকোয়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকার সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৫) নামের এক বৃদ্ধ নিখোঁজ রয়েছেন। মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাই, বেয়াইসহ ছয় স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ। নৌকায় গাদাগাদি করে মানুষ ওঠায় সাতজনই ছিলেন খুব কাছাকাছি। মাঝনদীতে নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা। এ সময় বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামে তাঁদের এক স্বজন সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যান অন্যরা। এরপর উদ্ধার অভিযানে বেয়াই, দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাইসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) নিখোঁজ রয়েছেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) ৫০ জন ধারণক্ষমতার নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির এক সপ্তাহ পর তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার চারটি কারণ উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হলো – ঘাটের ইজারাদারের গাফিলতি, নৌকার মাঝির অদক্ষতা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে ভেবে যাত্রীদের নিষেধ না করা এবং যাত্রীদের অসচেতনতা। পাশাপাশি ভৌগোলিক পরিস্থিতি ও নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবন-জীবিকার কথা উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পাঁচ দফা সুপাারিশ করে কমিটি।

দুর্ঘটনার পর তৎকালীন রেলমন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম সুজন-এর উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার উক্ত স্থানে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ২ বছর পরে ২০২৪ সালে আউলিয়া ঘাট কালীগঞ্জ রুটে ৩৪৫ দশমিক ৪ মিটার এবং বড়শশী রুটে ৫৪৫ দশমিক ৬ মিটার দীর্ঘ দুটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মাড়েয়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় সেতু দুটির সংযোগ সড়কে ওয়াই আকৃতি যুক্ত হবে। দুটি সেতুর মধ্যে একটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে চপড়ামারী এলাকা এবং অপরটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে নিশানডোবা-বোদেশ্বরীর সঙ্গে যুক্ত হবে। দুটি সেতু নির্মাণে মোট ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা উল্লেখ করা হয়। ২০২৫ সাল নাগাদ সেতু দুটির নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষমাত্রা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে উভয় সেতু নির্মাণ কাজ ধীরগতিতে চলছে।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহ


তথ্যসূত্রঃ সোহাগ হায়দার | রাজিউর রহমান
Last updated: 25 September 2025

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

Place: Awolia Ghat, Boda, Panchagarh

Date: 2022-09-25