কাজলদীঘি পঞ্চগড় জেলার অন্যতম প্রাচীন একটি দীঘি। পাড় সহ ১৭ একর জমির উপর অবস্থিত কাজলদীঘি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা হলেও আয়তনে প্রায় বর্গকার। কাজলদীঘির দৈর্ঘ্য ২৫০মিঃ এবং প্রস্থ ২০০মিঃ। পাকিস্তান আমলে দিঘির পাড়ে ভূমিহীনদের আশ্রয় দেওয়া হয়। বর্তমানে দীঘি ঘিরে রয়েছে প্রায় অর্ধশত পরিবারের বাসস্থান। দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছুটা জুড়ে হাট-বাজার ও কিছু অংশ কবরস্থান, চারধারেই রয়েছে অনেক রকম ফল আর কাঠগাছ। লেবুগাছ, বাঁশ বাগানও আছে অনেকটা জায়গাজুড়ে। দীঘির কোল ঘেঁষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কাজলদীঘি কবে কে খনন করেছিলেন তা জানা যায় না। তবে দীঘি সম্পর্কে প্রচলিত আছে এক সুদীর্ঘ কিংবদন্তী কাহিনী। প্রাচীনকালে এই পুকুরের দক্ষিন পাড়ে বাস করতেন এক রাজা। রাজার সাতজন রাণী ছিলেন, কিন্ত রাজা ছিলেন নিঃসন্তান। অনেক চেষ্টা করেও রাজা সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। একদিন হঠাৎ বিমর্ষ রাজার দরবারে এসে উপস্থিত হলেন এক সৌম্যদর্শন সন্ন্যাষী। তিনি ছোট রাণীকে খাওয়ার জন্য তিনটি ফল দিলেন এবং বললেন, এই ফল খেলে রাণী সন্তানের মা হবেন। কিন্ত অন্য রাণীদের ষড়যন্ত্রে ছোট রাণী ফল খেতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে তিনি ফলের পরিত্যক্ত খোসাগুলোই ভক্ষন করলেন ভক্তিসহকারে। ছয় রাণীর সন্তান হলো না, কিন্ত ঈশ্বরের কৃপায় একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম দিলেন ছোট রাণী। এই সংবাদে রাজ্যময় আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। রাজা মেয়ের নাম রাখলেন কাজলিনী।
আনন্দের মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল দিনগুলো। কিন্ত হঠাৎ করেই রাজ্যে দেখা দিলো অনাবৃষ্টি। অনাবৃষ্টি থেকে দূর্ভিক্ষ। সমগ্র রাজ্যে শুরু হলো পানির তীব্র অভাব। রাজা সন্ন্যাষীর পরামর্শে প্রজাদের জন্য খনন করলেন এক বিরাট দিঘি। কিন্ত একি! এমন সুগভীর দীঘি পানিশুন্য। রাজা আবার পরামর্শ চাইলেন সন্ন্যাসীর কাছে। সন্ন্যাসী বিমর্ষ মুখে জানালেন, পুজা দিয়ে জলদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। আর সে দায়িত্ব পালন করতে হবে বালিকা রাজকন্যা কাজলিনীকে। অজানা আশংকায় কেপে উঠলো রাজার পিতৃ হ্রদয়। রাজার কোন উপায় নেই কারণ প্রজাকুল তাকিয়ে রয়েছে রাজার দিকেই। প্রজাদের স্বার্থেই রাজা সম্মতি দিলেন, একদিন অসংখ্য প্রজার উপস্থিতিতে রাজকন্যা কাজলিনী স্বর্ণের থালায় পুজার সামগ্রী নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেল পুকুরের মাঝখানে। অর্ঘ্য প্রদান করলো জলদেবতার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের চারিদিক থেকে কল্ কল্ শব্দে উঠে এলে জলধারা। ভরে উঠলো গোটা পুকুর। ডুবিয়ে দিল রাজকন্যা কাজলিনিকেও। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করলো এই বেদনাবিধুর দৃশ্য। হাহাকার ও আর্তনাদে কেঁদে উঠলো গোটা রাজ্য, রাজা ও রাণী। অতঃপর রাজা কন্যার সম্রতি রক্ষার্থে পুকুরের নাম রাখলেন কাজলদিঘি। এখনো কোন পূর্ণিমা রাতে কাজল দীঘিতে শোনা যায় নারী কন্ঠের মৃদু কান্না। মাঝে মাঝে পুকুরের পানিতে ভেসে উঠে একটি ঝকঝকে রুপোর নৌকো। দীঘির টলটলে জল দেখলে, এপার থেকে ওপারে তাকালে প্রান জুড়িয়ে যায়। জনশ্রুতি আছে যে, যথীন্দ্র মোহন বাগচি কাজলাদিদি কবিতাটি এই পুকুর পাড়ে বসে লিখেছিলেন।
অবস্থানঃ পঞ্চগড় সদর থেকে মাত্র ১৩ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বোদা উপজেলায় কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নে কাজলদীঘি অবস্থিত। …Travel Tips | Accommodation | Tourist Spots
তথ্যসূত্রঃ পঞ্চগড় : ইতিহাস ও লোক ঐতিহ্য । ড. নাজমুল হক | এমরান আল আমিন
ছবিঃ সুমাইয়া তাবাসসুম
Last updated: 15 February 2024