বীর বিক্রম সকিম উদ্দিন – Bir Bikrom Sakim Uddin

শহীদ সকিম উদ্দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তৎকালীন সেনাবাহিনীতে কর্মরত হাবিলদার সকিম উদ্দিনের জন্মস্থান ছিল পঞ্চগড় এবং তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরের সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে।

সকিম উদ্দিন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সেই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লার ময়নামতী সেনানিবাসে। তখন সকিম উদ্দিন-এর পদবি ছিল হাবিলদার। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে ছুটিতে বাড়িতে থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সকিম উদ্দিন ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ সকিম উদ্দিনকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৬।

শহীদ সকিম উদ্দিনের পৈতৃক বাড়ি পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের মাগুরমারী গ্রামে। ছোটবেলায় তাঁর বাবা মারা যান। স্বাধীনতার পর থেকে তাঁর মা একই ইউনিয়নের ভজনপুর নিজবাড়ি গ্রামে বাস করতেন। তাঁর মা ১৯৯২ সালে মারা গেছেন। সকিম উদ্দিনেরা এক ভাই, এক বোন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম হিরিম উদ্দিন, মা সকিনা বেগম। বোন হালিমা খাতুন বেঁচে আছেন (২০২১)। বীর বিক্রম শহীদ সকিম উদ্দিনের ছবি পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগড় জেলার অন্তর্গত অমরখানা ও জগদলহাট ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। এরমধ্যে অমরখানার অবস্থান ছিল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অমরখানা ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসলে পাকিস্তানিরা পেছনে হটে জগদলহাটে অবস্থান নেয়। অমরখানা দখলের পর একটি উপদলের (প্লাটুন) দলনেতা সকিম উদ্দিন একদল মুক্তিযোদ্ধাসহ দ্রুত সমবেত হন জগদলহাটে,তাঁর সঙ্গে ছিল মিত্র বাহিনীও।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে আর্টিলারির গোলাবর্ষণ শুরু করে। সকিম উদ্দিনসহ নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সামনের ফ্রন্ট লাইনে। বেশুমার কামানের গোলা এসে পড়ে তাঁদের পেছনে ও আশপাশে। মাটি কাঁপিয়ে বিকট শব্দে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। সমানে ফাটতে থাকে। নিমেষে জায়গাটা পরিণত হয় নরকে। পোড়া বারুদের গন্ধ আর ধোঁয়ায় বাতাস ভারী হয়ে পড়ে চারিদিক। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই গোলন্দাজ আক্রমণ। এরপর শুরু হয় স্থল আক্রমণ। সামনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে সকিম উদ্দিন ও তাঁর সহযোদ্ধারা প্রস্তুতই ছিলেন। তাঁরা বিক্রমের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রের সামনের ফ্রন্ট প্রচণ্ড গোলাগুলিতে গর্জে ওঠে।

অগ্রবর্তী ঘাঁটি অমরখানা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানিরা ছিল উন্মত্ত। বেপরোয়া হয়ে তারা আক্রমণ শুরু করে। প্রতিটা পাকিস্তানি সেনা ছিল সুইসাইড স্কোয়াডের মতো। ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে। এতে সকিম উদ্দিন ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিচলিত হননি। সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ প্রতিহত করেন। সকিম উদ্দিন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বীরত্বে থেমে যায় পাকিস্তানিদের এগিয়ে আসার প্রচেষ্টা। তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধের একপর্যায়ে অসীম সাহসী সকিম উদ্দিন ঝড়ো গতিতে গুলি করতে করতে এগিয়ে যান। জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানিদের ওপর। এ সময় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হন সকিম উদ্দিন। তাঁর বুকসহ হাত-পায়ে গুলি লাগে। মাটিতে ঢলে পড়েন তিঁনি। নিভে যায় শহীদ সকিম উদ্দিনের জীবন প্রদীপ।

সেদিন যুদ্ধ চলাবস্থায় সকিম উদ্দিনের সহযোদ্ধারা চেষ্টা করেন তাঁর মরদেহ উদ্ধারের। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক গোলাগুলির মুখে তাঁরা মরদেহ উদ্ধারে ব্যর্থ হন। এতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহতও হন। পরে যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়। শহীদ সকিম উদ্দিনের মরদেহ উদ্ধার করে  জগদল হাটে সমাহিত করা হয়। পঞ্চগড়ের জগদল হাটের বায়তুল আমান মসজিদের সামনে বীর বিক্রম শহীদ সকিম উদ্দিনের সমাধি সংরক্ষিত রয়েছে।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের তালিকাভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাপঞ্চগড়ের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাপঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি ও গণকবর


তথ্যসূত্রঃ শহীদুল ইসলাম | মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান (বীর প্রতীক) | গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে | মাহবুব আলম | রাশেদুর রহমান
Last updated: 17 December 2023

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

সকিম উদ্দিন (বীর বিক্রম)
(জন্মঃ অজানা - মৃত্যুঃ ১৯৭১)

  • বীর বিক্রম
  • শহীদ মুক্তিযোদ্ধা
  • মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্লাটুন দলনেতা
  • হাবিলদার