পঞ্চগড়ের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম। তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবার অনুপ্রেরণা ও বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। রোকেয়া বেগমের মেজো ভাই নাসিদুল ইসলাম তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে নিখোঁজ হন এবং লোকমুখে ভাইয়ের যুদ্ধে শহীদ হবার খবর আসলে শোকে কাতর হয়ে পড়ে রোকেয়া বেগমের পুরো পরিবার। ভাইকে হারিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার স্বপ্ন জাগে রোকেয়ার মনে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৬ নং সেক্টরের কমান্ডার এম কে বাশার, ৬ নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও ডা.আতিয়ার রহমান-এর অধীনে থেকে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও-এ সেবিকা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন রোকেয়া বেগম। মুক্তিযুদ্ধকালে একজন সেবিকা হয়ে যুদ্ধাহত, আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, মুক্তিকামী মানুষের সেবা, মুক্তিবাহিনীর খাবারের যোগান দেয়া, মিত্রবাহিনীর ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমের সদস্য হিসেবে সেবা দেয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করেছেন তিঁনি।
নারী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম ১ জানুয়ারি ১৯৫৫ সালে তেতুলিয়া উপজেলার শালবাহান এলাকার শংকরপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আব্দুর রহিম ছিলেন পেশায় একজন দর্জি, আর মা শমিরন নেছা ছিলেন গৃহিণী। পরিবারে ৫ সন্তানের মধ্যে রোকেয়া বেগম ছিলেন তৃতীয় আর বোনদের মধ্যে বড়। রোকেয়া বেগম শালবাহান প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শালবাহান হাইস্কুল হতে লেখাপড়া করেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। রেডিওতে শোনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ রোকেয়া বেগমকে উদ্বেলিত করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে গ্রামের ছেলেরা মিটিং-মিছিল করে, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শুরু হলে রোকেয়া বেগমের মেজো ভাই নাসিদুল ইসলাম সহ গ্রামের অনেকেই যুদ্ধে চলে যায়। এরপর ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ খবর আসে ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। ছেলে হারানোর শোকে রোকেয়া বেগমের মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
অনিশ্চিত নিরাপত্তা এবং স্থানীয় সকলে নিকটবর্তী ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলে প্রাথমিকভাবে রোকেয়া বেগম ভারতের ভুষপিটা ক্যাম্পের শরণার্থী শিবিরে যান। সেখানে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া ছোট ছোট শিশুদের তিনি পাঠদান করাতেন । শরণার্থী শিবিরে ডায়রিয়া, খোস-পাঁচড়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে রোকেয়া বেগম হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীতে তিনি ভুষপিটা থেকে কান্তায়ভিটা ক্যাম্পেও অবস্থান করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবার মাঝে অসুস্থ মাকে দেখতে আসেন। বাড়ি থেকে ভারতে শরণার্থী শিবিরে ফেরার পথে পঞ্চগড়ে অস্থায়ী ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে সেবিকা নিয়োগের খবর পেয়ে তেঁতুলিয়ায় ছুটে আসেন রোকেয়া বেগম। তিনি বয়স কম হওয়ার কারণে প্রাথমিকভাবে বাদ পড়লেও পরে যুদ্ধাহতদের সেবিকা হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯৭১ সালে নবম শ্রেণির ছাত্রী রোকেয়া বেগমের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান সহজ ছিলোনা। তাঁর বাবা আব্দুর রহিম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তাঁকে উৎসাহিত করেন। যুদ্ধে যাবার জন্য মনস্থির করে, প্রস্তুতি শেষে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেবার কালে রোকেয়া বেগম আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সামাজিকভাবে বাধার সম্মুখীন হন। নিজ গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি রোকেয়া বেগম । অনেকেই নানাভাবে কটূক্তি করেন। এক মুহূর্তের জন্যও পিছু পা না হয়ে, ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল বড় ভাই আব্বাস আলীর সহযোগিতায় রোকেয়া বেগম বাড়ির আঙিনা ছেড়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে চলে যান রণাঙ্গনে।
রোকেয়া বেগম তেঁতুলিয়ায় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের সেবিকার দায়িত্ব পালনের কিছুদিন পর পঞ্চগড়ে চলে আসেন। এরপর ঠাকুরগাঁও টিবি হাসপাতাল ও ইপিআই হেডকোয়ার্টার হাসপাতালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিদের সেবাদানের পাশাপাশি জীবনবাজি রেখে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ক্যাম্প এবং হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদান, মুক্তিবাহিনীকে রান্না করে খাওয়ানো সহ সবসময় মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় থেকেছেন, স্বাধীনতা পাগল মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম কাছ থেকে দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা, নির্মমতা আর লোমহর্ষক বেদনা।
সাক্ষাৎকার এবং video credit: শামীম আরা।
২৯ নভেম্বর ১৯৭১ -এ পঞ্চগড় হানাদারমুক্ত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম বাড়িতে ফিরে আসেন। যে ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর কাঁদিয়েছিল ছিল রোকেয়ার পরিবারকে, সেই মেজো ভাই নাসিদুল ইসলামও দেশ স্বাধীনের পর বাড়িতে ফিরে আসেন। সেদিন পুরো পরিবার হতবাক আর বিস্ময় হয়ে পড়েছিল নাসিদুলের ফিরে আসায়। মুক্তিযোদ্ধা নাসিদুল ইসলাম পঞ্চগড় সুগার মিলে কিছু দিন চাকরির পর ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
অমায়িক ব্যবহার, অল্প ভাষী, ধৈর্যশীল রোকেয়া বেগম জীবন সংগ্রামে একজন সফল নারী। তিনি ১৯৭৩ সাল হতে পঞ্চগড় চিনিকলে মেডিক্যাল বিভাগে দীর্ঘ ৪০ বছর চাকুরী করে অবশেষে ২০১৪ সালে অবসর নেন। বর্তমানে (২০২৩) ৬৭ বছর বয়সী রোকেয়া বেগম চাকুরী শেষ করে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি স্বামী এবং একমাত্র সন্তান রুবিনা খাতুন সহ পঞ্চগড় জেলা শহরের মিলগেট এলাকায় বসবাস করেন। সেবা ব্রতী এই মহীয়সী নারী চিকিৎসা সেবায় এখনো মানুষের দ্বারগোরে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। স্থানীয়ভাবে সিস্টার খালাম্মা খ্যাত পঞ্চগড়ের এ প্রজন্ম অনেক সন্তান তাঁর ধাত্রীবিদ্যার উপকারভোগী।
মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন স্কুলে নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন, নিজ খরচে জাতীয় পতাকা ও ব্যাজ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের উপহার দেন, শিশুদের শোনান মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় দিনের কথা। অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম তাঁর অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২২ সালে রোকেয়া বেগমকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশপ্রেমসহ সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানের কারণে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা | পঞ্চগড়ের অন্যান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ
তথ্যসূত্রঃ রনি মিয়াজী | আজিম পাটোয়ারী | শামীম আরা
Last updated: 18 December 2023