খামির উদ্দীন প্রধান – Khamir Uddin Prodhan

পঞ্চগড় জেলার শ্রেষ্ঠ দানবীর, শিক্ষানুরাগী, বিশিষ্ট সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব খামির উদ্দীন প্রধানের রয়েছে জেলা ব্যাপী কৃতিত্ব। এলাকার মানব ও সামাজিক উন্নয়নে তাঁর অবদান নিঃসন্দেহে কিংবদন্তি তুল্য। পঞ্চগড়ের স্থানীয় মানুষকে জ্ঞান ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে তিনি সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জনাব খামির উদ্দীন প্রধান কখনো ব্যক্তি রাজনীতির প্লাটফর্মে নিজেকে দাঁড় না করিয়ে সমাজসেবী হিসেবেই নিজেকে পরিচিত করেছিলেন। শুধুমাত্র নিজ জমি থেকে কৃষিকাজ করে সঞ্চিত অর্থে এলাকার শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে এতো ব্যাপক অবদান দেশের ইতিহাসে বিরল। পঞ্চগড় জেলার সর্বজনবিদিত দানবীর খামির উদ্দীন প্রধানকে কেউ কেউ পঞ্চগড়ের হাজী মহসীন হিসেবে অভিহিত করেন। রাজনীতির পরিমণ্ডলেও তাঁর বিচরণ ছিল ব্যাপক আলোচিত।

খামির উদ্দীন প্রধান পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী বীরপাড়া গ্রামের জমিদার পরিবারে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ সালে (বাংলা ১৩২৯ সাল) জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল জমিদার কবাদ আলী প্রধান। খামির উদ্দীন ছিলেন পিতা মাতার একমাত্র সন্তান। খামির উদ্দীন প্রধান-এর ৩ বছর বয়সে নিজ বাড়ীতে ডাকাতের আক্রমনে তাঁর পিতা কবাদ আলী প্রধান মৃত্যু বরণ করেন। পিতার অকাল মৃত্যুতে জমিদারির বেহাল দশা হলে শিশু খামিরউদ্দীন প্রধান সহ জমিদারির দেখাশোনার ভার নেন তাঁর চাচাতো ভাই তমিজ উদ্দীন প্রধান। পিতার আদর বঞ্চিত হলেও চাচাত বড় ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যদের আদর-স্নেহে আর অবহেলায় ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন শিশু খামির উদ্দীন প্রধান।

তৎকালীন সময়ে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে খামির উদ্দীন প্রধান প্রতিনিয়ত পায়ে হেঁটে ৮ কিঃমিঃ দূরে ভারতের হলদিবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য যাতায়াত করতেন। সে সময় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন থাকলেও বাঘের ভয়ে ঘোড়া বুনো পথে যেত না। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় চাচাত ভাই তমিজ উদ্দিন প্রধানের মৃত্যু হলে, জমিদারীর গুরুদায়িত্ব হাতে নিয়েই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িত হতে খামির উদ্দীন প্রধান মুসলিম লীগে যোগ দেন। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জমিদারি সামলে উঠতে না উঠতেই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়। তদানিন্তন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পরে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও অদমনীয় খামির উদ্দীন প্রধান তাঁর এলাকায় চাকলাহাট ও কামাত কাজলদিঘী একত্রিত ইউনিয়ন পরিষদএর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। সততা আর একনিষ্ঠ মনোভাবের কারণে জনগণের একান্ত ভালোবাসা পাওয়ায় প্রত্যক্ষ নির্বাচনে ২ বার ও পরবর্তীতে কামাত কাজলদিঘী ইউনিয়ন আলাদা হলে চাকলাহাট ইউনিয়ন পরিষদে টানা ৫ বার নির্বাচনে জয়ী হয়ে মোট ৩০ বছর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে ১৯৭৯ সালে পঞ্চগড় সদর থানা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে বিজয়ী হয়ে সুনামের সঙ্গে প্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তীতে খামির উদ্দীন প্রধান বিএনপি’র রাজনীতিতে যোগদান করে দেশের উন্নয়নে শরিক হন। জীবদ্দশায় তিনি বেশ কয়েক বার পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দলের কর্মী ও নেতারা তাকে একাধিকবার জেলা বিএনপি’র সভাপতির আসনে অধিষ্ঠিত করতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। রাজনৈতিক জীবনে তৎকালীন পাকিস্তানের স্পীকার গমিরউদ্দীন প্রধান এবং সাবেক স্পীকার মির্জা গোলাম হাফিজ ও সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী, স্পীকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি জমিরউদ্দীন সরকার তাঁর ঘনিষ্ঠ ও কাছের বন্ধু ছিলেন।

খামির উদ্দীন প্রধান সামাজিক কল্যাণ ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন সময়ে পঞ্চগড় জেলা জুড়ে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ অর্থে প্রতিষ্ঠিত করেন। এগুলো যথাক্রমে ১৯৫৮ সালে চাকলাহাট বগুলাডাঙ্গি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিজ অর্থ জমিসহ সার্বিক প্রচেষ্টার গড়ে তোলেন। ১৯৬৮ সালে ১১ বিঘা জমির ওপর চাকলাহাট কে,পি (খামিরউদ্দীন প্রধান) দ্বি-মূখী উচ্চ বিদ্যালয় ও ১টি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৫ সালে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে প্রায় কোটি টাকার জমি দান করেন এবং কলেজটি সরকারিকরণে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন।

হাজী খামির উদ্দীন প্রধান দাখিল মাদ্রাসা

পরর্বতিতে তিনি আরো ১৪ শতক জমি সরকারি মহিলা কলেজে ছাত্রীদের হোষ্টেলের জন্য দান করলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর নামে ‘হাজী খামির উদ্দীন প্রধান’ একটি বহুতল হোষ্টেল নির্মান করেন। এছাড়াও পঞ্চগড় সরকারি মকবুলার রহমান কলেজের উন্নয়নে আর্থিক সহযোগিতা করেন। ১৯৯১ সালে টুনিরহাট শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজ নিজ অর্থে ১১ বিঘা জমি ক্রয় করে কলেজের নামে দান করেন। ইতিমধ্যে কলেজ প্রতিষ্ঠা পেতে বিঘ্ন হলে আরো প্রায় ৩ লক্ষাধিক টাকা নগদ দান করেন। ১৯৯৬ সালে নিজ অর্থে ক্রয়কৃত ৯ বিঘা জমির ও নগদ অর্থ দানে হাজী খামির উদ্দীন প্রধান দাখিল ও আলিম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৯ সালে নিজ জমি ও নগদ অর্থে নিজ পিতা কবাদ আলী প্রধানের নামে এতিমখানা, হাফেজিয়া মাদ্রাসাসহ মসজিদ নির্মাণ করেন। ২০০৪ সালে পঞ্চগড় শহরতলী প্রায় ৬ লাখ টাকায় এক বিঘা জমি ক্রয় করে এবং নগদ অর্থ দান করে পঞ্চগড় হোমিওপ্যাথিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৪ সালে নিজ অর্থে ক্রয়কৃত জমিতে চাকলাহাট বি এম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চগড় ডায়বেটিস হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অর্থ ও শ্রম দেন। এ ছাড়াও চাকলাহাট জামে মসজিদ, বীরপাড়া জামে মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা ব্যাপক অর্থ দান করেন। তিনি জেলার অসংখ্য শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থ দান করে গেছেন।

জনাব খামির উদ্দীন প্রধান যৌবনে একজন দক্ষ শিকারী ছিলেন। তৎকালীন সময়ে এলাকার মানুষকে বন্য বাঘ আক্রমণ করতো আর বুনো শুকর, হরিণ, নীল গাই কৃষকের ফসল বিনষ্ট করতো। জীবদ্দশায় তিনি দোনলা বন্দুক দিয়ে অর্ধ শতাধিক রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কয়েক শতাধিক বুনো শুকর, হরিণ, নীলগাই শিকার করেন। এসব বুনো জন্তু অকাতরে শিকারের কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, সে সময়ে এসব অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলে আবৃত। বর্তমানের মতো এতো লোকালয়ও ছিল না। সামান্য কিছু আবাদি জমি ও গৃহ পালিত পশু ছিল মানুষের চাষাবাদ ও বেঁচে থাকার সম্বল। বাঘের ভয়ে মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজে যেতে এবং ভয়ে পথ চলতে পারতো না, অন্যদিকে বুনো শূকর, হরিন ও নীলগাইয়ের অত্যাচারে কৃষকরা আবাদ করতে পারতো না। এলাকার মানুষের জীবন ও ফসল রক্ষার্থে তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে শিকার করতেন।

তাঁর শিকারী জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা থেকে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী তেলধারের জঙ্গলের সন্নিকটে বাঘ এক গরিব চাষীর হালের বলদ নিয়ে যায়। খবর পেয়ে তিনি সেই বাঘ মারতে গিয়ে সারারাত মাচা বেঁধে বাঘের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ভোর রাতে প্রচণ্ড কুয়াশায় বাঘের দেখা পেয়ে গুলি করেন। প্রচন্ড কুয়াশার কারণে গুলি বাঘের শরীরের সঠিক স্থানে না লেগে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও আহত বাঘ লাফ দিয়ে এক বিশাল কাঁটা ঝোপে গা ঢাকা দেয়। এরপর মাচা থেকে নেমে তিনি বাঘের খোঁজ করতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে মাত্র ৩০০ গজ দূরে ঝোঁপের কাছে আসা মাত্র বাঘ হুংকার দিয়ে প্রধান সাহেবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, হাতে থাকা দোনলা বন্দুক নিয়ে বাঘের আক্রম ঠেকাতে চেষ্টা করেন। এতে বাঘের আক্রমণ ঠেকানো গেলেও হাতের বন্দুক বাঘের থাবার আঘাতে দু টুকরো হয়ে যায়। বাঘের উপর্যুপরি আক্রমনে বাম হাত ও কাঁধে মারাত্মক জখম হলেও তিনি ছেড়ে দেবার পাত্র নন। যতোক্ষণ জ্ঞান ছিল, ডান হাতে থাকা বন্ধুকের ভাংগা অর্ধেক অংশে বাঘকে আঘাত ও অন্য হাতে বাঘের চোয়ালে স্বজোরে ঘুষি মারতে মারতে বাঘটিকে ধরাশায়ী করেন।

ইতিমধ্যে লোকজন এসে দেখে, একদিকে বিশাল আকার রয়েল বেঙ্গল টাইগার অন্যদিকে প্রধান সাহেব মৃতের মতো পড়ে আছেন। লোকজন পরীক্ষা করে দেখে প্রধান সাহেব জীবিত থাকলেও বাঘটি মরে গেছে। পরে দেখা যায় বাঘের পেছনের উরুতে একটি গুলির চিহ্ন। দীর্ঘ দিন প্রথমে জলপাইগুড়ি ও পরে কোলকাতা হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে প্রধান সাহেব সুস্থ হয়ে উঠেন। এ সময় তিনি মৃত বাঘটিকে স্মৃতি হিসেবে কোলকাতা হতে শুকনো মমি করে রেখে দেন। যা আজও (২০২৫) তাঁর শোকেসে রক্ষিত আছে।

২০০৫ সালে ১৬ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকাল ৫ টা ৩০ মিনিটে ৮৫ বছর বয়স্ক এ সমাজসেবী শিক্ষানুরাগী দানবীর ব্যক্তিত্ব, ডায়বেটিস ও কিডনী বিকলজনিত রোগে শয্যাশায়িত অবস্থায় তাঁর গ্রামের বাড়ি চাকলাহাটে মৃত্যুবরণ করেন

খামির উদ্দীন প্রধান-এর সন্তানদের মাঝে জসিয়ার রহমান প্রধান, চাকলা হাট খামির উদ্দীন প্রধান বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। আনিস প্রধান, শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রী কলেজে বর্তমান উপাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, পঞ্চগড় জেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সভাপতি চাকলাহাট সরকারি বগুলাডাংগী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খামির উদ্দীন প্রধান জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান, অ্যাডভোকেট, পঞ্চগড় জেলা জজ কোর্ট (এপিপি)। আসাদুজ্জামান প্রধান জুয়েল প্রভাষক (সমাজবিজ্ঞান) শহিদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রী কলেজ, পঞ্চগড়। রেজিয়া ইসলাম মনো সাবেক জাতীয় সংসদ-এর সংরক্ষিত সাংসদ, সভাপতি পঞ্চগড় জেলা মহিলা লীগ। হাসিনা প্রধান ছিলেন ফেমেলি প্লানিং মাঠ কর্মকর্তা, বর্তমানে (২০২৫) অবসরে। অ্যাডভোকেট রিনা প্রধান, সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য (বিএনপি)। শাহিদা রুমি প্রধান বুলা, এয়ার হোষ্টেস ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ বিমান। শাহনাজ প্রধান মনি (ডেপুটি রেজিষ্টার, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা)। আনজুমান আরা প্রধান মায়া (সরকারি শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়)। আফরোজা প্রধান ছায়া (সরকারি শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়)। শামসুন নাহার প্রধান (সহকারি শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়)। হাফিজা প্রধান মুক্তা (সহকারী শিক্ষক, হাজী ছবির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ)। তাঁর অন্যান্য সন্তানেরা কৃষি ও ব্যাবসার সাথে জড়িত।

জনাব খামির উদ্দীন প্রধান কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করেছেন। পঞ্চগড়ের ইতিহাসে কীর্তিমান এই পুরুষের মৃত্যু নেই। তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পঞ্চগড় জেলার মানুষ খামির উদ্দীন প্রধান-এর নাম ততো দিন মনে রাখবে, যতো দিন জেলার মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে থাকবে।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ


তথ্য সূত্রঃ আনিস প্রধান
ছবিঃ আতাবুল ইসলাম
Last updated: 29 March 2025

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

খামির উদ্দীন প্রধান
(১৯২১ - ২০০৫)

  • শ্রেষ্ঠ দানবীর
  • শিক্ষানুরাগী
  • বিশিষ্ট সমাজসেবী
  • রাজনীতিবিদ
  • ৩০ বছর যাবৎ চেয়ারম্যান, চাকলাহাট ইউনিয়ন পরিষদ