বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান – Bir Protik Abdul Mannan

বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস তথা ইপিআর-এ চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল মান্নানের বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। চাকরির সুবাদে তিনি ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও ৯ উইংয়ের (বর্তমান ঠাকুরগাঁও ব্যাটেলিয়ান) পঞ্চগড় কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে সিপাহি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চের কয়েকদিন আগে তাঁকে চোপড়ামারী ক্যাম্পে বদলি করা হয়। ঐ ক্যাম্পের অবস্থান ছিল বোদা উপজেলার বড়শশীতে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। চোপড়ামারী ক্যাম্পে পাঠান, পাঞ্জাবি ও বিহারি সহ পাকিস্তানি ছিল চারজন এবং বাঙালি পাঁচ জন সৈনিক ছিলেন।

আব্দুল মান্নানের ছিল একটা ব্যক্তিগত রেডিও। ১৯৭১ সালের ২৪ অথবা ২৫ মার্চ চোপড়ামারী ক্যাম্পে সীমান্ত সেকশনের ভেতরে একটি বাঁশের মাচার ওপর বসে রেডিওতে খবর শুনছিলেন মান্নানসহ কয়েকজন সৈনিক। এই দৃশ্য দেখে সেকশন কমান্ডার হাবিলদার মোঘলবাজ রেডিও বন্ধ করার নির্দেশ দেন। খবর শুনতে না দেওয়ায় এক পর্যায়ে রাগে ক্ষোভে তার মুখের ওপর রেডিও ছুঁড়ে মারেন মান্নান, ভেঙে যায় আব্দুল মান্নানের প্রিয় রেডিওটি। এ সময় দুজনেই মারমুখী হলে সহকর্মীরা তাদের সরিয়ে নেন। পরে হাবিলদার মোঘলবাজ বিষয়টি পঞ্চগড় কোম্পানি কমান্ডারকে অবহিত করেন। রাতেও তাদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। ফলে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার বিষয়টি আব্দুল মান্নান স্পষ্ট করে জানতে পারেন না।

২৬ মার্চ সকালে ফলিং করছিলেন সৈনিকেরা। সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন হাবিলদার মোঘলবাজ। পাশে আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন মান্নান। মান্নানের নজর ক্যাম্পের পাশের রাস্তার দিকে। বাইসাইকেল নিয়ে সেকশনের দিকে এগিয়ে আসছিলেন ডানাকাটা প্লাটুন কমান্ডার মতিয়ার রহমান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি কিছু একটা ইশারা করলেন।

তাতে মান্নান বুঝলেন রাতে ভয়ানক কিছু হয়েছে, প্লাটুন কমান্ডার মতিয়ার রহমান সকল সৈনিককে অস্ত্র বের করতে বললেন। অস্ত্র পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে কৌশলে মান্নানকে কাছে ডেকে নিয়ে ওই সেকশনে থাকা সব সৈনিককে হত্যা করার নির্দেশ দেন তিনি। অস্ত্র গুছিয়ে রাখার এক পর্যায়ে দুটি রাইফেলে গুলি ভরে করে আলাদা করে রেখে দেয় মান্নান। প্লাটুন কমান্ডার চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সুযোগ বুঝে ন্যান্স নায়েক শারাফাত ও মান্নান দুটি রাইফেল দিয়ে এক এক করে সব পাক সেনাদের গুলি করে হত্যা করেন। একজন পাক সেনা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয়রা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় ক্যাম্প ঘিরে স্থানীয়রা জয় বাংলা বলে স্লোগান দিতে থাকে। ক্যাম্পেই নিহত পাক সেনাদের সমাহিত করা হয়।

এই অপারেশনের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের লড়াই শুরু করেন আব্দুল মান্নান। ওই ঘটনার পর প্রতিটি সীমান্ত থেকে বাঙালি জওয়ানদের একত্র করে ঠাকুরগাঁও দিনাজপুর জেলার মধ্যবর্তী দশমাইল নামক এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক সকালে পাকিস্তানি সেনাদের বড়সড় দল ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্র নিয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে দিনাজপুরের দিকে আসতে থাকে। অচিরেই দশমাইল এলাকায় পড়তে থাকে তাদের ছোড়া গোলা।

এই অবস্থায় ভারী অস্ত্রহীন অল্পসংখ্যক বাঙালি সেনা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। হাজারো সাধারণ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে পালাতে থাকে। পিছু হটতে হটতে কান্তনগর এলাকায় (বর্তমানে কান্তজিউ মন্দির) পৌঁছার পর আব্দুল মান্নানের উপলব্ধি হয় এভাবে পিছু হটলে কেউই বাঁচতে পারবে না। তিনি যা অস্ত্র আছে তা নিয়েই পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।

সবশেষে পালাতে থাকা সেনাবাহিনীর গাড়ি চালক আব্দুস সাত্তার ও ইপিআর সৈনিক রহমানকে থামার অনুরোধ জানান মান্নান। কিন্তু তারা কথা না শুনায় তিনি রাইফেল তাক করে গুলি করার হুমকি দিলে তারা থামতে বাধ্য হন। পরে তাদের মান্নান বোঝাতে সক্ষম হন যে কোনোভাবেই বাঁচা সম্ভব নয়। তারচেয়ে উচিত হবে পাকিস্তানিদের যে কোনোভাবে থামানো।

বাঙালি সৈনিকদের রেখে যাওয়া কিছু অস্ত্র ও গুলি নিয়ে দিনাজপুরের কান্তনগর এলাকায় কান্তা ফার্মের সামনে বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নেন তাঁরা। কোনো বাধা না পাওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা নিশ্চিন্তে সামনে এগিয়ে আসে। তারা এলএমজির পাল্লার মধ্যে ঢুকতেই গুলি শুরু করেন মান্নান। ধরাশায়ী হতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। রহমান আর সাত্তার দুজন গুলি ভরে অস্ত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছেন আর মান্নান একাই গুলি করে চলেছেন। সন্ধ্যার দিকে গুলি ফুরিয়ে যায় মান্নানের। গুলি আনতে বাংকার থেকে বের হওয়ামাত্রই পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় সাত্তারের শরীর। এরপর তাঁদের ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। জবানবন্দি নেওয়ার জন্য মান্নান ও রহমানকে জীবিত আটক করে তারা। সেখানে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে কৌশল খাটিয়ে মান্নান তাদের জানান যে, ‘আমরা মনে করেছি পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এরা ভারতীয় সৈন্য ভেবে আমি গুলি করেছি।’

সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সৈয়দপুর সেনানিবাসে দিনের বেলায় জিজ্ঞাসাবাদ ও রাতে নির্যাতন চলত। দুই মাস পর তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় রংপুর সেনানিবাসে। সেখানে আরো কিছুদিন নির্যাতন চলে। এক দিন তাঁদের হত্যা করার জন্য হাত ও চোখ বেঁধে রংপুর উপশহরের ঘাঘট নদীসংলগ্ন এক পুকুর পারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মান্নান, রহমান সহ ২০ থেকে ২২ জন ছিলেন। একজন পাকিস্তানি সেনা এক এক করে গুলি করে হত্যা করছিল তাঁদের। এক পর্যায়ে মান্নানের পাশে থাকা রহমানকে গুলি করা হয়। এরপর মান্নানকে গুলি করার সময় তিনি বাঁচার জন্য একটু নিচু হলে গুলি পিঠ ভেদ করে কাধের নিচ দিয়ে বেড়িয়ে যায়।

রহমান সহ আব্দুল মান্নানের সহযোদ্ধারা ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুলি লাগার পর আব্দুল মান্নান লাশের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে যান। লাশের স্তূপের ওপর দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকেন। এ সময় পানির পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন তিনি। তখন হঠাৎ নামে রহমতের বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টির কয়েক ফোটা পানি তাঁর মুখে পড়ে। এর কিচ্ছুক্ষণ পর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। মধ্যরাতে জ্ঞান ফেরে দেখেন সেই লাশের ওপরেই পড়ে আছেন তিনি। পরে আহত অবস্থায় লাশের স্তুপ থেকে তিনি কোনরকমে পার্শ্ববর্তী পাইলছড়া গ্রামে যান। বুদ্ধিমত্তা আর নির্ভিক সাহসিকতার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আব্দুল মান্নান।

পাইলছড়া গ্রামের রুস্তম আলী নামের একজন মাওলানা স্থানীয়ভাবে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি আব্দুল মান্নানকে গ্রামেই লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু রুস্তম আলীর চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হননি, তাঁর ক্ষতস্থানে পচন ধরে। সেই সময়ে তাঁর হাঁটাচলা করার মত শক্তিও ছিল না। দুই মাস পর গ্রামের লোকজন আব্দুল মান্নানকে ভারতের তরঙ্গপুর ট্রেনিং সেন্টারে মেজর রউফের কাছে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁকে গাড়িতে করে তেতুলিয়ায় পাঠালে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তাঁরা সবাই মনে করেছিলেন আব্দুল মান্নান বেঁচে নেই। সহযোদ্ধারা তাঁকে তেঁতুলিয়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে সুবেদার মেজর রউফ তেঁতুলিয়ায় থাকা সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনকে বিষয়টি অবহিত করেন। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর কাজিম উদ্দিন আব্দুল মান্নানকে ভারতের কল্যাণী হাসপাতালে পাঠান।

এর পরবর্তীতে আব্দুল মান্নানকে বাগডোগরা সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হলে, সেখানেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে ভারতের লখনৌ হাসপাতালে উন্নততর চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। লখনৌ হাসপাতালে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পান বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান।

দেশে ফিরে আব্দুল মান্নান যোগ দেন বাংলাদেশ রাইফেলসে (বর্তমানে বিজিবি)। সেদিন তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলায় বেঁচে যায় হাজারো সাধারণ মানুষ। হতাহত হয় শতাধিক পাকিস্তানি সেনা। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মেজর জেনারেল আতিকুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ল্যান্সনায়েক আব্দুল মান্নানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্ব নম্বর ২৫৪। আব্দুল মান্নান ২০০৩ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস থেকে ল্যান্সনায়েক হিসেবে অবসর নেন।

বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান তাঁর পৈত্রিক বাড়ি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদনগর গ্রামে ৪ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ শফিউল্লাহ, মাতার নাম ফয়জুন্নেসা। আব্দুল মান্নান ১৯৬৭ সালে ইপিআর-এ যোগ দেন।

বর্তমানে (২০২২) জাতির সূর্য সন্তান বীরপ্রতীক আব্দুল মান্নান পঞ্চগড়ে অবসর জীবন যাপন করছেন। তিনি সস্ত্রীক তেঁতুলিয়া উপজেলার মমিনপাড়া গ্রামে পুরাতন বাজারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন । তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ে-এর জনক।


সাক্ষাৎকার প্রথমআলো’র সৌজন্যে।

বীর প্রতীক আব্দুল মান্নানের কাধ ও বাম হাতের কনুইতে গুলির আঘাতের চিহ্ন এখনও রয়েছে। যুদ্ধের সময়কার অনেক ছবি তিনি বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করেছেন। তাঁর পাওয়া বিভিন্ন ক্রেস্ট, সনদ, সম্মাননা ও স্মৃতি তিনি সংরক্ষণ করেছেন তাঁর বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে। মাঝে মাঝে মনে পড়ে ‘পাই’ নামের প্রিয় রেডিওটির কথা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে বীরপ্রতীক আবদুল মান্নানের স্বপ্ন, বাংলাদেশ একদিন দুর্নীতিমুক্ত হবে। তাঁর চাওয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেন কেউ বিকৃত না করে। আবদুল মান্নান বলেন, ‘অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানুক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করুক, এটাই আমার কামনা।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা | পঞ্চগড়ের অন্যান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ


তথ্যসূত্রঃ এম এ বাসেত । তেঁতুলিয়ার ইতিহাস ও পর্যটন শিল্প | লুৎফর রহমান | রাজিউর রহমান
ছবিঃ রনি মিয়াজী
Last updated: 23 December 2023

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান

  • বীর প্রতীক
  • মুক্তিযোদ্ধা
  • ল্যান্সনায়েক