বাংলাদেশ ও ভারতের ১৬২টি ছিটমহলের দেশহীন, নাগরিকত্বহীন, আনুষ্ঠানিক পরিচয়হীন, অমানবিক জীবন জীবিকা ও বিপন্ন মানবতার ইতি ঘটে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ছিটমহল বিনিময়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তে। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট-এর সূচনালগ্ন অর্থাৎ ৩১ জুলাই দিবাগত রাত ১২.০১ মিনিটে ছিটমহলে স্ব স্ব দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় ছিটমহল বিনিময়। পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত ৩৬ টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
পঞ্চগড়ের ছিটমহলের তালিকাঃ
জেএল ৭৫ নম্বর গারাতি | ৭৬ নম্বর গারাতি |
৭৭ নম্বর গারাতি | ৭৮ নম্বর গারাতি |
৭৯ নম্বর গারাতি | ৮০ নম্বর গারাতি |
৭৩ নম্বর সিঙ্গিমারী (অংশ-১) | ৬০ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৫৮ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৫৭ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৫৯ নম্বর পুটিমারী | ৫৬ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৫৪ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৫৩ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৫২ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৫১ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৫০ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৪২ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৪৯ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৫৫ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৪৮ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৪৬ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৪৭ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৪৫ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৪৪ নম্বর নাজিরগঞ্জ | ৪১ নম্বর নাজিরগঞ্জ |
৩৮ নম্বর দইখাতা | ৩৭ নম্বর শালবাড়ি |
৩৬ নম্বর কাজলদীঘি | ৩২ নম্বর নাটকটোকা |
৩৩ নম্বর নাটকটোকা | ৩৪ নম্বর বেহুলাডাঙ্গা (২ টুকরো) |
৩৫ নম্বর বেহুলাডাঙ্গা | ৩ নম্বর বালাপাড়া খাগড়াবাড়ি |
২ নম্বর কোটভাজনী (৪ টুকরো) | ১ নম্বর দহলা খাগড়াবাড়ি (৬ টুকরো) |
ছিটমহলের প্রকৃত ইতিহাসঃ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ছিটমহলের সূত্রপাত বেশ পুরনো। ছিটমহল সমস্যার সূচনা হয় সপ্তদশ শতকে মোগল সম্রাট শাহজাহনের শাসন আমলে। কোচবিহারের রাজা প্রাণ নারায়ণ মোগল সাম্রাজ্যের কিছু জায়গা দখল করে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। অপরদিকে, মোগল সুবেদার কোচবিহার রাজ্যের কিছু অংশ দখল করেন, যা পরবর্তীতে রংপুরের মহারাজার রাজ্যভুক্ত হয়। তবে দুই রাজ্যের মধ্যে থাকা এসব অঞ্চলের মানুষের জনজীবনে এই দখল-প্রতিদখলে তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য পাসকৃত আইন। এ আইনে করদ রাজ্যের রাজা/মহারাজা/নবাব/ নিজামগণকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। অবিভক্ত ভারতে তখন করদ রাজ্য, যা পিন্সলি স্টেট নামে পরিচিত, সংখ্যা ছিল ৫৮৪টি। আইনে সুযোগ রাখা হয়, এসব করদ রাজ্য ইচ্ছে করলে ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে। এমনকি তারা চাইলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেও থাকতে পারবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগকালে অধিকাংশ করদ রাজ্য যোগ দেয় ভারত ও পাকিস্তানে। বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল সম্পর্কিত কোচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজা ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার সময় কোনো রাজ্যে যোগ দেননি। কোচবিহারের রাজা ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহার রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার চুক্তি করেন, যা পরের বছর পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। রংপুরের মহারাজা পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চুক্তি করেন ১৯৫২ সালে। ছিটমহলে অমানবিক জনজীবনের রাস্তা শুরু তখন থেকেই।
ব্রিটিশ রাজ ১৯৪৮ সালে দ্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স অ্যাক্ট নামক আইন পাসের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। এ সময় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করার প্রয়োজনে সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার সিরিল রেডক্লিফ। কমিশনের অন্য সদস্য ছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কয়েকজন দক্ষ ভূগোলবিদ ও ৪ আইনজ্ঞ।
সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়ে রেডক্লিফ ৮ জুলাই ভারতে আসেন। দুটি রাজ্য ভাগ করে সীমানা নির্ধারণের জন্য সময় দেওয়া হয় মাত্র ৬ সপ্তাহ। যাতে এটুকু সময়ের মধ্যে একজন বিদেশী আইনজীবীর নেতৃত্বে ২টি প্রদেশের সীমানা ভাগ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তিনি রেডক্লিফ লাইন নামক জোড়াতালির এক সীমানা নির্ধারণ করেন, যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই অনেক ক্ষেত্রেই। সে কারণে র্যাডক্লিফের সীমানা নির্ধারণী কার্যক্রমে কমিশনের সদস্যবৃন্দ একমত পোষণ করেননি। তা সত্ত্বেও সিরিল রেডক্লিফ ১৩ আগস্ট ১৯৪৭ সালে রেডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড নামে পরিচিত সীমানা নির্ধারণের প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ প্রতিবেদন ১৬ আগস্ট ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় জনসমক্ষে। রেডক্লিফ অ্যাওয়ার্ডই ছিটমহল সমস্যার সূচনা বলে গণ্য করা হয়। রেডক্লিফের সীমানা নির্ধারণী ম্যাপে গোলযোগ ছিল অনেক। যেমনঃ কোনো ব্যক্তির বসতঘর ও রান্নাঘরের মাঝখান থেকেও সীমানা ভাগ হয়েছিল, কোনো কোনো জায়গায় সীমারেখা টানা যায়নি বলে থেকেছে অমীমাংসিত, থেকেছে এক দেশের মধ্যে অন্য দেশের অনেক এলাকা ও জনগণ। জীবন ও জীবিকার চরম অচল অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে ছিটমহল।
১৯৫৮ সালে সই হওয়া নেহেরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩ সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালতের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত করা হয় ছিটমহল বিনিময়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৪ সালে পুনরায় স্থল সীমানা নির্ধারণ চুক্তি করেন। ছিটমহলের তালিকা ১৯৯৭ সালে দুই দেশ দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। ২০০১ সালে ছিটমহলের তথ্য বিস্তারিত জানার জন্য দুটি যৌথ সীমানা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। ২০০৭ সালের মে মাসে একটি যৌথ আদমশুমারি সম্পন্ন করা হয়। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য একটি অতিরিক্ত প্রোটোকল স্বাক্ষর করে ১৬২টি ছিটমহল অদলবদল করার অভিপ্রায় ঘোষণা করে।
ছিটমহল বিনিময় কার্যকরের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী‘র উদ্যোগে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনা শুরুর উদ্দেশ্যে গঠিত করা হয় জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ। তাঁদের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৭ মে ভারতের সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী পাস হয় এবং ২০১৫ সালের ৬ জুন স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক স্থল সীমানা নির্ধারণ চুক্তি। উভয় দেশ ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই হতে ২০১৬ সালের ৩০ জুন মধ্যে পর্যায়ক্রমে ছিটমহল বিনিময় বাস্তবায়ন করার জন্য সম্মত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ছিটমহল বিনিময় কার্যকর করা হয়।
২০১৫ সালের ১ আগস্ট সকালে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহলের মফিজার রহমান কলেজ মাঠে সকাল থেকে দলে দলে আসতে থাকে মানুষ। অনুষ্ঠান শুরু হয় শেষ দুপুরে। অস্থায়ী মঞ্চে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে সুরের ধারার শিল্পীরা ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা গানটি পরিবেশন করেন। সুরের ধারার শিল্পীরা এ সময় নৃত্য পরিবেশন করেন। সুরের ধারার শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান পঞ্চগড়ের বিপি উচ্চবিদ্যালয় ও বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন পঞ্চগড়-১ আসনের সাংসদ নাজমুল হক প্রধান ও পঞ্চগড়-২ আসনের সাংসদ নুরুল ইসলাম সুজন। এর আগে গ্রামীণফোনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর স্বাগত বক্তব্য দেন।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের ঘোষণা দিতেই দর্শক-শ্রোতাসহ সবাই শ্রদ্ধাভরে দাঁড়িয়ে যায়। জাতীয় সংগীতে সবাই কণ্ঠ মেলায়। প্রথম বিজয় উৎসবের আনন্দে আবেগাপ্লুত হয় বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ছিল গ্রামীণফোন। সহযোগিতায় ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও চ্যানেল আই। চ্যানেল আই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে। জাতীয় সংগীত পরিবেশন শেষে মঞ্চে আসেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তিনি গ্রামীণফোনের থ্রিজি নেটওয়ার্ক টাওয়ার উদ্বোধন করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘এত দিন আপনাদের দেশ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই আজ ছিটমহলের মানুষ অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হয়েছে।’
এরপর সুরের ধারার শিল্পীরা একে একে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘ও আমার দেশের মাটি’—এ গানগুলো পরিবেশন করেন। সংগীতের ফাঁকে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ‘আমার পরিচয়’ আবৃত্তি করেন আসাদুজ্জামান নূর। পরে ‘নোঙ্গর তোল তোল; সময় যে হলো হলো’ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।
সকল ছিটমহল বাসিন্দাদের স্থানান্তর ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর সম্পন্ন হয়ে যায়, অবসান ঘটে যুগ যুগ ধরে চলা মানুষের অমানবিক জীবন ও জীবিকার। বাংলাদেশে ছিটমহল বিনিময় পরবর্তীতে স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক, রাস্তা, বিদ্যুৎ, পরিচয়পত্র সহ সকল সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
ভারত যেতে ইচ্ছুক সর্বশেষ দলটির ১০৫ জনের কাগজপত্র দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ গোলাম আযম ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব রমাকান্ত গুপ্তার হাতে তুলে দেন। প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষে দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ শফিকুল ইসলাম সহ ৩টি বাস ও ৫টি ট্রাকে ভারতীয় এসব নাগরিক ও তাঁদের মালামাল নিয়ে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে রওনা দেন । বিদায়কালে কলেজ মাঠে জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া এই লোকজনকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানান স্বজনেরা। অনেকের বুকফাটা কান্নায় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সূচনা হয়।
ছিটমহলের পরিসংখ্যানঃ বাংলাদেশে ১৭,১৬০ একর পরিমান এলাকা নিয়ে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে ৩৭,৩৩৪ জন মানুষ বসবাস করতো। অপরদিকে, ভারতের মধ্যে ৭,১১০ একর এলাকা নিয়ে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে ১৪,২১৫ জন মানুষ বসবাস করতো। বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, নীলফামারী জেলায় ৪টি। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মধ্যে ৪৭টি কোচবিহার এবং ৪টি জলপাইগুড়ি জেলায়।
ছিটমহল বিনিময় চুক্তির আওতায় ভারত ভারতের মূল ভূখণ্ডে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল ৭,১১০ একর (২,৮৮০ হেক্টর) পরিমান জায়গা লাভ করে, অন্যদিকে বাংলাদেশ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল ১৭,১৬০ একর (৬,৯৪০ হেক্টর) পরিমান জায়গা লাভ করে। ছিটমহল বিনিময় সমাপ্তের পর ভারত বাংলাদেশের কাছে প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার (১৫ বর্গ মাইল) পরিমান জায়গা হারায়। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলোর মাত্র ৭৪৩ জন নাগরিক ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারতে যেতে চান; বাকি প্রায় ১৪,০০০ মানুষ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে থাকতে চান। অন্যদিকে ভারতে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর ৩৭,০০০ জন মানুষের কেউই বাংলাদেশের নাগরিক থাকতে চাননি, সবাই ভারতের নাগরিকত্ব নিতে চান।
পঞ্চগড়ে ছিটমহল বিনিময় কার্যকরের লক্ষ্যে প্রত্যেক ছিটমহলে ওয়ার্ড ভিত্তিক ৩ জন করে মোট ৯ জন কর্মী নিয়ে জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়। ছিটমহল বিনিময় পূর্ববর্তী জরিপ অনুযায়ী পঞ্চগড় সদর, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার ভেতরে মোট ৩৬টি ছিটমহলের ১১,৯৩২.৮০ একর জমিতে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৯,০৪৩ জন। পঞ্চগড়ের ছিটমহলের অধিকাংশ মানুষ ছিল দিনমজুর, প্রধানত কৃষি শ্রমিক। রাস্তা, স্কুল-কলেজ, প্রাথমিক চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ১৮ বছর বয়সের আগে ৯২% মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো। যৌতুকের প্রচলন ছিল শতকরা ৮৮ ভাগ বিবাহের ক্ষেত্রে। সেচ ব্যবস্থা, কৃষির উপকরণ, প্রশিক্ষণের অভাবে কৃষি উৎপাদনও ছিল অনেক কম। কৃষি ফসল বিক্রিতেও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি হতো না।
২০১১ সালের জনগণনায় পঞ্চগড়ে ৩৬টি ছিটমহলে জনসংখ্যা ছিল ১৮,৮৩৪ জন। ২০১৫ সালের ৬ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত গণনায় দেখা যায়, নতুন করে জন্ম নিয়েছে ১,৫০২ জন। এ ছাড়া বৈবাহিক সূত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৫২৩ জন। তবে ২০১১ সালের মোট জনসংখ্যার ৬০১ জনকে ২০১৫ সালের গণনায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৮৭ জন মারা গেছেন। সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সর্বমোট জনসংখ্যা ছিল ২০,০৭১ জন। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, যাঁরা ভারতে যেতে চান, তাঁদের ২০১৫ সালের ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে আবেদন করতে হবে।
পঞ্চগড় জেলার মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত ৩৬টি ভারতীয় ছিটমহল ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত (রাত ১২টার পর) থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পঞ্চগড় জেলার ৩৬টি বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে পাঁচ দফায় ৬০৭ জন স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যান। ৭ জন ভারতে স্থায়ীভাবে যাওয়ার ব্যাপারে নাম লেখালেও পরবর্তীতে তাঁরা আর যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।
…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য ঘটনা প্রবাহ
তথ্যসূত্রঃ ড. মিহির কান্তি মজুমদার
Last update: 14 February 2024