অবহেলিত পঞ্চগড় জনপদের উন্নয়নের স্বপ্নচারী, পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও সমতলে ক্ষুদ্র চা চাষ প্রকল্প সম্প্রসারণ, পঞ্চগড় সমিতি, পঞ্চগড়ের সার্বিক উন্নয়নের পথপ্রদর্শক, বহুমাত্রিক প্রতিভার পঞ্চগড়ের সন্তান জনাব এম. দেলোয়ার হোসেন। দেশ বরেণ্য বাম ধারার রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী কেন্দ্র -এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জনাব এম. দেলওয়ার হোসেন একই সাথে একজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। পঞ্চগড়ের চেম্বার ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার ধারণাটি তাঁর।
পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এম. দেলওয়ার হুসাইন। পঞ্চগড়ের পরে তার সুপারিশেই ঠাকুরগাঁও চেম্বার প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকায় ব্যবসা বাণিজ্য করলেও উন্নত পঞ্চগড়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। গঠন করেছিলেন পঞ্চগড় উন্নয়ন পরিষদ। এম. দেলওয়ার হোসেন সমতল ভূমিতে চা চাষের তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। সর্বশেষে তিনি পঞ্চগড়ে বনায়নের নামে বন বিভাগ কর্তৃক দখলকৃত ভূমি উদ্ধারের আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ইস্ট পাকিস্তান প্রাইভেট ফরেস্ট অর্ডিন্যান্স বাতিল করে হাজারো ভূমি মালিকদের জমি ফেরতের জন্য আন্দোলন করেছেন তিনি।
দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশ-চয়না মৈত্রী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দু’দেশের সরকারের সম্পর্ক উন্নোয়নে ভূমিকা রেখে আসছিলেন। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ক্ষণস্থায়ী -এই ধারণার বাহক, দেশ-ভাগ প্রশ্নে যোগেন মন্ডলদের অনুসারী, বাংলাদেশে বর্ণাশ্রমবিরোধী/ব্রাক্ষণ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃস্থানীয় চরিত্র, বি. আর. আম্বেদকার সোসাইটি প্রতিষ্ঠাতা এম. দেলওয়ার হোসেন।
দেশবরেণ্য এম. দেলোয়ার হোসেন ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৫১ সালে পঞ্চগড় জেলার মীরগড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ডা. নাজিবউদ্দীন আহমেদ এবং মাতা জেবুন্নেসা। তাঁর পিতামহ কবিরাজ শরিফ উদ্দীন আহমেদ ইয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রের বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ভারতের জলপাইগুড়িতে শরিফ ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঔষধ বাজারজাত করতেন। ৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় পঞ্চগড় পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার সাথে যুক্ত হলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভারতের অধিনে চলে যায়। পরে রায়টের সময় সব ছেড়ে পরিবারটি মীরগড়ে চলে আসে এবং প্রাথমিকভাবে অর্থসংকটের মুখোমুখি হতে হয়।
এম. দেলোয়ার হোসেন অর্থ সংকটের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেন। তিনি নৈশ কলেজে পড়ার পাশাপাশি মার্কসীয় রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৬৮ সালে এম. দেলোয়ার হোসেন সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ, রেজওয়ানুল হক ইদু চৌধুরী ও রাজনারায়ন সিংহের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৬৮-৬৯ সালের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন দেলোয়ার। ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া থেকে স্বাধীন বাংলা নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। ইমদাদুল হক সম্পাদিত ঐ পত্রিকায় এম. দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন এম. দেলোয়ার হোসেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ঢাকার মর্নিং নিউজ ও সংবাদ সংস্থা বিপিআই’তে কাজ করা শুরু করেন দেলওয়ার। ১৯৭৮ সালে দৈনিক করতোয়া ঢাকা অফিসে ব্যুরো প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে তার সম্পাদনায় ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক উত্তরণ নামে পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ঢাকায় ইনাম প্রিন্টার্স নামক একটি প্রেস ব্যবসা ছিলো তাঁর।
১৯৮৩ সাল থেকে এম. দেলওয়ার হোসেন ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা ফিলিং স্টেশন নামে পঞ্চগড় জেলার প্রথম পেট্রোল পাম্প ও টঙ্গীতে জিআই তার উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালে পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে এফবিসিসিআই’র পরিচালক এবং ২০০১ সালে সার্ক চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময় পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠা ও সমতলের চা চাষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্যতম ভূমিকা রাখেন দেলওয়ার। তিনি পিছিয়ে পড়া পঞ্চগড়কে এগিয়ে নিয়ে পঞ্চগড়ের সুশীল সমাজকে নিয়ে গঠন করেন পঞ্চগড় উন্নয়ন পরিষদ। ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করে চীন মৈত্রীর কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও ২০১৪ সালে সভাপতি/প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন।
ভাসানী ন্যাপ থেকে বিএনপি যোগদান করা দেলওয়ার নব্বইয়ের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ২০০৬ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠিত হলে তিনি এলডিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) গঠিত হলে পিডিপি’তে যোগদান করেন। ২০০৮ সালে তিনি পিডিপি’র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এম. দেলোয়ার হোসেন পঞ্চগড় ১ আসনে পিডিপি’র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। বাংলাদেশ গণশক্তি দল নামের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অভিপ্রায় ছিল।
২০১৬ সালেই তিনি অহিংস ও জাতভেদ বিরোধী মতাদর্শের আলোকে ড. ভি আর আম্বেদকর সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
তিনি ভাবতেন সাধারণ মানুষের কথা, মানুষের মুক্তির কথা, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথা। রাজনীতির পাশাপাশি লিখেছেন বই। অদম্য দেং নামক দেং শিয়াও পিং’র জীবন অবলম্বনে জীবনী গ্রন্থ লিখেছেন। ড. ভি আর আম্বেদকরের বিখ্যাত গ্রন্থ The annihilation of Caste এর বাংলা অনুবাদ জাত প্রথা নিপাত যাক গ্রন্থের মুখবন্ধ মানবমুক্তির বংশীবাদক ভি আর আম্বেদকর শীর্ষক প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি কমরেড মতিনের চোখে দেং’র সংস্কার বইয়ের ভূমিকা লিখেন। চীনা জনগণের ইতিহাস তার লেখা পূর্ণাঙ্গ বই।
২৯ নভেম্বর ২০২০ সালে ৬৯ বছর বয়সে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এম. দেলোয়ার হোসেন পঞ্চগড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এম. দেলোয়ার হোসেন চীন বিষয়ক লেখালেখির জন্য বাংলাদেশে অবস্থিত চীনা দূতাবাস ও বাংলাভিশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে চীনা দূতাবাস প্রদত্ত সম্মাননা লাভ করেন।
পঞ্চগড় জেলার প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে এম.দেলোয়ার হোসেন এর নাম জড়িয়ে আছে। এখানকার স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা স্ব প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি -প্রত্যেকেই দেলোয়ার হোসেনের চিন্তাধারা বা কার্যক্রমের কাছে ৠণী। এম.দেলোয়ার হোসেন পঞ্চগড়ের উন্নয়নের ইতিহাসে একটি নক্ষত্রের নাম।
তথ্যসূত্রঃ হোসেন সাজ্জাদ | আসাদ্দুজ্জামান মিলন | BCFC
Last updated: 4 December 2023