সফিকুল আলম চৌধুরী – Shafiqul Alam Chowdhury

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে অকুতোভয় সফিকুল আলম চৌধুরীর রয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে পাকসেনারা তাঁকে বাঘের খাঁচায় ৬ দিন বন্দী করে রেখেছিলো। বন্দিশিবিরে বাঘের খাঁচায় দীর্ঘ সহাবস্থান এবং হানাদারদের যন্ত্রণাদায়ক ও বর্বর নির্যাতনের পরেও বাঘগুলো তাঁকে খায়নি, এমনকি তাঁকে আঁচড়ও দেয়নি। মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল আলম চৌধুরী অসীম সাহসিকতা সঙ্গে সেই পরিস্থিতি জয় করেন, অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।

কিংবদন্তির নায়ক সফিকুল আলম চৌধুরী ছিলেন একাধারে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কমিউনিষ্ট নেতা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা, পাঁচপীর ইউপি’র প্রথম চেয়ারম্যান ও পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। জনাব সফিকুল আলম চৌধুরী পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার গুয়াগ্রাম প্রধানপাড়া গ্রামের সন্তান।

অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী যুবক আলম ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন। বিশালদেহী সফিকুল আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই সক্রিয় রাজনীতি করতেন, ছাত্র জীবনে ছিলেন তুখোড় ছাত্র নেতা, বাঘের সঙ্গে লড়াই করার মতোই ছিল তাঁর দশাসই চেহারা। পরবর্তীকালে তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে যোগ দেন। একটি বৈষম্যহীন ও সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকায় তাঁর প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের ছিল ক্ষোভ।

দেশপ্রেমে উজ্জীবিত আলম চৌধুরী স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মার্চ মাসে তিনি বোদা এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে অস্ত্র-চালনার প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে বোদা উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে যে ক’জন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদেরই একজন সফিকুল আলম চৌধুরী। তিনি অসীম সাহস আর উত্তেজনা নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। জনাব চৌধুরী স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কাছে ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁকে ধরার জন্য ওই এলাকার রাজাকার ও শান্তিকমিটির নেতারা পুরস্কার ঘোষণা করে। এ পরিস্থিতিতে তিনি গোপনে লড়াই চালানোর প্রস্তুতি নেন।

অবশেষে একদিন মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল আলম চৌধুরী নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেশীয় রাজাকার কুখ্যাত আল বদর হবিবর কমান্ডরের সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে যান। সেদিনটি ছিল ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। পরের দিন তাকে বোদা থানায় নিয়ে গেলে সেখানে তিনি একটি চেয়ারে বসেন। তা দেখে একজন অবাঙালী পুলিশ এসে তাঁকে চেয়ার থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয় এবং বলে, ‘শালে কিঁউ কুরসি মে বইঠা হায়‘। বোদা থানা থেকে তাঁকে হাত-পা ও চোখ বেঁধে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। সেখানে একজন লোক পাঞ্জাবী সেনাদের জিজ্ঞেস করে ‘ইয়ে কোন হ্যায়?’ সেনাদের একজন জবাবে বলল, ‘ইয়ে মুক্তিকা কর্নেল হ্যায়‘। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তাঁর পেটে ভীষণ জোরে একটা লাথি মারে। সারাদিন সারারাত অভুক্ত থাকার কারণে সফিকুল আলম চৌধুরী অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

সফিকুল আলম চৌধুরী জ্ঞান ফিরলে তাকিয়ে দেখেন, একটি বাঘের খাঁচায় দুটি বড় এবং দুটি বাচ্চা বাঘের মাঝে তিনি শুয়ে আছেন। চোখ খোলার সাহস নেই। মনে মনে ভাবেন বাঘ দিয়েই তাঁকে হত্যা করা হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য বাঘ চারটি সরে গিয়ে খাঁচার পার্টিশন পার হয়ে একপাশে গিয়ে বসে থাকলো। একজন লোক এসে পার্টিশনের দরজা বন্ধ করে দিলো। বাঘের এহেন আচরণ দেখে সেনারাও খুব অবাক হলো। কিছুক্ষণ পর এক পাঞ্জাবী সেনা এসে একটি পোড়া রুটি বাঘের প্রস্রাবের উপর ছুঁড়ে মারে। ক্ষুধার জ্বালায় তিনি সেটিই খান। এরপর তাকে বাঘের প্রস্রাব মেশানো পানি খেতে দেওয়া হয়। সন্ধ্যায়ও তাঁকে পোড়া রুটি খেতে দেওয়া হয়। রুটি খেয়ে তিনি মেঝেতে বুক লাগিয়ে শুয়ে পড়েন। এমন সময় একটি বাঘের বাচ্চা এসে তার দু’পায়ের মাঝখানে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। নির্ঘুম সারা রাত তাঁর এভাবেই কেটে যায়। কিন্তু কি আশ্চর্য বাঘ তাঁকে কিছুই করে না।

সফিকুল আলম চৌধুরীকে সকালে বাঘের খাঁচা থেকে বের করে আনা হয় এবং যথারীতি একটি পোড়া রুটি খেতে দেওয়া হয়। তাঁর দু’হাত বেঁধে ফেলে এক পাঞ্জাবি সেনা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুম কোন পার্টি করতা হ্যায়?‘ তিনি জবাব দেন তিনি ওয়ালী খানের ন্যাপ পার্টি করেন। তখন সে লোকটি রেগে মেগে বলে, ‘বাইনচোত, তুম গাদ্দার হায়। ওয়ালী খান ভি গাদ্দার হায়‘ এর পর সে আরও জিজ্ঞেস করে, ‘আন্দার মে কেতনা মুক্তি হায়?‘ তিনি বলেন, তিনি জানেন না। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি তাঁকে বেত দিয়ে মারা শুরু করে। মারের চোটে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরলে দেখেন তিনি আবার বাঘের খাঁচায় এবং একটি বাঘ তাঁর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে একদিন দু’জন মেজর এসে বলে, ‘শের কো নাড়ো’। বাঘের গায়ে হাত দিতেই বাঘ সরে যায়। তারা আবার বললো, ‘তোমহারা শির শের কা মু কা পাছ লে যাও‘। সফিকুল আলম চৌধুরী মাথা বাঘের মুখের কাছে নিয়ে গেলে বাঘ চারটিই সরে গিয়ে খাঁচার এক কোণে বসে থাকতো। এ দৃশ্য দেখে হানাদার কর্মকর্তারা বিস্মিত হতো।

সফিকুল আলম চৌধুরীকে ধরা পড়ার পর দীর্ঘ ৬ দিন হানাদারদের বন্দিশালায় বাঘের সঙ্গে খাঁচায় অবস্থান করতে হয়েছিল। অবিশ্বাস্য যে, হিংস্র বাঘগুলো তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। নির্যাতনের লোমহর্ষক স্মৃতি বাকি জীবনের প্রতিমুহূর্ত তাকে আতঙ্কিত করে রেখেছিলো। সেই আতঙ্কিত ভয়াবহ স্মৃতির যন্ত্রণা নিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী অবস্থায় নিভৃতে জীবনযাপন করছেন তিনি। বাড়ির আড্ডাখানায় বসে স্মৃতিতে চোখ রেখে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে নির্যাতনের কাহিনী শুনিয়েছিলেন তিনি। বাঘের আক্রমণে নিরীহ নিরপরাধ বাঙালি সন্তানরা যখন চিৎকার করতো তখন তিনি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন নিরস্ত্র মানুষগুলোর দিকে। হিংস্র বাঘগুলো যখন ঝাঁপিয়ে পড়তো মুক্তিসেনাদের ওপর, তখন মনে হতো এ নির্মম দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার চেয়ে তার মৃত্যুও অনেক শ্রেয়। প্রায় প্রতিদিন নতুন লোকজনকে নিয়ে আসা হতো বাঘের হিংস্র আক্রমণের যন্ত্রণাকাতর শাস্তি ভোগের জন্য। কারও বুকের মাংস, কারও কান নাক চোখ উপড়ে যেতো আর তাজা রক্তে রঞ্জিত হতো বাঘের খাঁচা। রক্তাক্ত বাঘের খাঁচা না শুকাতেই গুলি করে হত্যা করা হতো এসব নিরীহ বাঙালি সন্তানকে।

যুবক সফিকুল আলম চৌধুরী

সফিকুল আলম চৌধুরী হিংস্র বাঘের আচরণ সম্পর্কে নিজ মুখে বর্ণনা করেছেন যে, খাঁচায় মোট ৪টি বাঘ ছিল। এর মধ্যে ৩টি বড় আর ১টি দুগ্ধপোষ্য। ছোট বাঘের ছানাটি তাঁর পায়ের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। বড় বাঘগুলো চৌধুরীর শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে চারদিকে ঘুরতো আর খাঁচার এক কোণে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। এভাবে দীর্ঘ ৬ দিন বাঘের খাঁচায় সহাবস্থান করতে হয়েছে বাঘদেরই স্বজন হয়ে। হানাদাররা হিংস্র বাঘের এ আচরণ দেখে মন্তব্য করত- ‘এ বড়ো শরিফ আদমি হ্যায়‘। ক’দিন বেশ নির্ঝঞ্ঝাট কাটতো। সেনা ছাউনির টিম বদল হলেই নতুনদের আগমন ঘটতো। আবার শুরু হতো পাশবিক নির্যাতন। সম্পূর্ণ উলঙ্গ করা হতো। বেত বেয়নেট ও রাইফেলের আঘাত হতো প্রতিদিনের নাস্তা আর রাতের ভোগ। বাঘের মলমূত্রের ওপর ফেলে দেয়া রুটি খেতে হতো কঠোর যন্ত্রণায়। নির্যাতনে অচেতন হয়ে পড়লে বাঘের মূত্র চোখে মুখে ছিটিয়ে সচেতন করার চেষ্টা চলতো। দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। জ্ঞান হারালে রাখা হতো বাঘের খাঁচায়। জ্ঞান ফিরলে দেখতেন ছোট বাঘটি শুয়ে আছে তাঁর উরুতে মাথা রেখে। সেই বীভৎস কাহিনী বর্ণনায় চোখ ছল ছল করে উঠছিল সফিকুল আলম চৌধুরীর, অথচ লম্বা গড়নের এ মানুষটির হুংকারে এক সময় কেঁপে উঠতো শোষক আর শাসকদের আসন।

পাক বাহিনী নিজেদের পতনের সময় ডিসেম্বর নাগাদ সফিকুল আলম চৌধুরীকে থানায় হস্তান্তর করলে তাকে ঠাকুরগাঁও মহকুমা হাকিমের কোর্টে হাজির করা হয়। মহকুমা হাকিম তাঁকে দু’বছরের কারাদণ্ড দেন। কিন্তু জজ কোর্টে সফিকুল আলম চৌধুরী জামিন পান। জামিন পেয়ে তিনি জেল থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিবেন এমন সময় একটা মিলিটারির গাড়ি এসে তাঁকে আবার ধরে ফেলে এবং একজন মেজর বলে, ‘শালা তুম ভাগনে কা কোশেশ করতা হ্যায়‘। তাঁকে আবার জেলে পুরে দেওয়া হয়। কয়েকদিন পর মুক্তি বাহিনী এবং মিত্র বাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করলে খান সেনারা পালিয়ে যায়। একজন বাঙালি পুলিশ অফিসার তাঁকে চাবি দিলে তিনি জেলখানার লকআপ খুলে বাইরে চলে আসেন, মুক্তি পান অদম্য পুরুষ, বীর মুক্তিসেনা সফিকুল আলম চৌধুরী।

সমাবেশে বক্তৃতা রাখছেন সফিকুল আলম চৌধুরী

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই সফিকুল আলম চৌধুরী নিজ এলাকায় পরিচিত পান আলম চৌধুরী নামে। তাঁর মহান আত্মত্যাগ এবং রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে গড়ে তোলে এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বে। জনসভার মঞ্চে তিনি রাগী রাগী চেহারায় যখন আবেগঘন বক্তৃতা দিতেন, তখন পুরো এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসত। সকলেই তাঁর গল্প শুনে শিহরিত হতেন। সফিকুল আলম চৌধুরী পাঁচপীর ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং তিনি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন বৈরাতী উচ্চ বিদ্যালয়।

কৃষক আন্দোলনের পুরোধা, সংগ্রামী মানুষে, বাম রাজনীতিকর তত্ত্বজ্ঞানে বলিষ্ঠ সাহসী এ পুরুষ নিভৃতে আপন ভুবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি নিয়ে তাঁর বাকি জীবন কাটিয়েছেন স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে। সফিকুল আলম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগেছিলেন। ২০১৮ সালের ১২ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনা সফিকুল আলম চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল আলম চৌধুরীকে পাঁচপীর গোয়াগ্রামে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

সফিকুল আলম চৌধুরী দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। তাঁর মেয়ে সুমনা ফেরদৌস চৌধুরী সিমি বাংলাদেশের সনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক।

 


তথ্যসূত্রঃ সুমনা ফেরদৌস চৌধুরী সিমি | স্টালিন চৌধুরী | আমজাদ কবির চৌধুরী | ফরহাদ আহাম্মেদ চৌধুরী রিংকু
Last updated: 26 March 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

সফিকুল আলম চৌধুরী

  • বীর মুক্তিযোদ্ধা
  • রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
  • কমিউনিষ্ট নেতা
  • ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা
  • পাঁচপীর ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান
  • সহ-সভাপতি, বোদা উপজেলা আওয়ামী লীগ