ফিরোজ আল সাবাহ – Firoz Al Sabah

পঞ্চগড়ের স্বনামধন্য পেশাদার তরুণ আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ। তিনি ছবি তুলেন পঞ্চগড়ের ভূ-প্রকৃতি, গ্রামীণ সৌন্দর্য ও বন্যজীবনের। বর্তমানে IUCN ও বন বিভাগ-এ বন্যপাখি সংরক্ষণ নিয়ে কর্মরত ফিরোজ আল সাবাহ দেশ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একজন গুণী ফটোগ্রাফ কন্ট্রিবিউটর। ফিরোজ আল সাবাহা’র তোলা ছবি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা সহ দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত প্রকাশ পায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃষ্টিনন্দন ফটোগ্রাফির মাধ্যমে পঞ্চগড়ের পর্যটিন শিল্পকে তুলে ধরার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ফটোগ্রাফির পাশাপাশি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও সংরক্ষণে মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছেন ফিরোজ আল সাবাহ।

ফটোগ্রাফির নেশা ও পেশায় দেশ-বিদেশ চষে বেড়ালেও ফিরোজ আল সাবাহা’র জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে প্রিয় জন্মস্থান পঞ্চগড়ে। চিতাবাঘ, অতিকায় পাখি চিতিঠোঁট গগনবেড়া, মদনটাক, বার্মিজ অজগর, মহা বিপন্ন পাখি ছাড়াও আরও বিভিন্ন দুর্লভ বন্যপ্রাণী ও প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখির ছবি ক্যামেরাবন্দী করেছেন তিনি। পেশাদার ছবি তোলার তাগিদে ঘুরেছেন দেশের ৪০ জেলা। সামনাসামনি বন্য লেপার্ড বা চিতাবাঘের ছবি তোলার ব্যাপারটা বাংলাদেশে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফিতে বিরল হলেও, তা ধারণ করেছেন তিনি। নিজ জেলা পঞ্চগড় থেকে ভারতের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার বিষয়টি সামনে আনার পেছনে নিরলস কাজ করেছেন ফিরোজ আল সাবাহ। ২০০৯-১০ সাল থেকে স্বদেশে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলেছেন।

ফিরোজ আল সাবাহা'র তোলা মাছরাঙার বিখ্যাত ছবি।
২০১৫ সালে ৭ মাস অধ্যবসায়ের পড়ে ফিরোজ আল সাবাহা’র তোলা মাছরাঙার বিখ্যাত ছবি।

ফিরোজ আল সাবাহা’র জন্ম ১৯৯০ সালে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাতকামার গ্রামে। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন ব্যাংকার। তিন ভাইয়ের মধ্যে ফিরোজ ছিলেন মেজো। ছোটবেলা থেকেই ফিরোজের ছিল প্রকৃতির প্রতি টান, শৈশবে স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বন বনাঞ্চলে। ২০০৬ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় ফটোগ্রাফির হাতে খড়ি হয় তার মামার একটি ইয়াশিকা ক্যামেরা দিয়ে। সেই ইয়াশিকা ফ্লিম ক্যামেরায় সূর্য, কাঁশফুল, নদীর ছবি তুলে নিজের পকেট মানি দিয়ে ঠাকুরগাঁ যেতেন প্রিন্ট করতে। ২০০৭ সালে নোকিয়ার N73 স্মার্টফোনেটি কিনেন ফিরোজ। সেই ফোন দিয়ে ক্লোজ আপ মুড আর Bukeh (ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার) ছবি তোলা যেত। কিশোর ফিরোজ আরো আগ্রহী হয়ে পরে ফুল, পাখি, প্রজাপতির ছবি তোলায়। এই সময় বুঝতে শেখেন ক্যামেরা ও লেন্সের ধরন, আগ্রহী হয়ে পড়েন ডিজিটাল ফোটোগ্রাফিতে। ২০০৮ সালে বোদা পাইলট মডেল স্কুল ও কলেজে এসএসসিতে পড়া অবস্থায় ভালো ছবি তুলতে ক্যামেরা কেনার ঝোঁক চেপে বসে মাথায়। এসএসসি’র পর ভর্তি হোন পলি টেকনিক্যালে, বিষয় ছিল কম্পিউটার সাইন্স।

২০১১ সালে ঘর থেকে ল্যাপটপ কেনার জন্য টাকা দিলে তা দিয়ে ঢাকা থেকে প্যানাসনিক লুমিক্স-এর একটি ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে ফেলেন ফিরোজ আল সাবাহ। নতুন ক্যামেরা হাতে আসায় প্রথমে চাঁদের ছবি বারবার তুলতে থাকেন। তাতে বোরিং লাগলে বাসায় থাকা পাখির ছবি তুলতে শুরু করেন। ২০০৯-১০ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে পাখির ছবি তুলতে থাকেন আল সাবাহ। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ’র বেশি প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন তিনি, হয়ে ওঠেন পাখি বিশারদ। পাখিদের প্রতি ভালোবাসা থেকে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির মাধ্যমে শখের ফটোগ্রাফি থেকে পেশাদার ফটোগ্রাফার হয়ে উঠেছেন ফিরোজ আল সাবাহ।

ফিরোজ আল সাবাহ ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিতে গিয়ে বাঁধায় পড়েন বহুবার। ২০১৪ সালে ব্যাংকার বাবার সহায়তায় ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে তাঁর ভাগ্য। এর মাঝে বাবাকে হারিয়ে আয়ের তেমন কোনো পথ না থাকায় পারিবারিক ব্যবসা ও সরকারি সিনেমাটোগ্রাফি প্রোগ্রাম থেকে কিছু আয়ে পরিবারের হাল ধরেন তিনি। ফোটোগ্রাফিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও নিজের প্রজ্ঞা, প্রচেষ্টা আর অধ্যবসায়ে তোলা নিখুঁত ছবির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিশ্বের দরবারে দেশ ও পঞ্চগড়ের সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করছেন তিনি। বর্তমানে (২০২৪) ফিরোজ আল সাবাহ IUCN ও বন বিভাগ-এ বন্যপাখি সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন।

ফিরোজ আল সাবাহা’র তোলা অসাধারণ সব ছবি এখন পর্যন্ত (২০২৪) প্রায় পনেরটি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। ৬ বার তাঁর ছবি প্রকাশিত হয়েছে National Geographic Birdwatch Magazine-এ। ফটোগ্রাফিতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারসহ আরও বেশ কিছু পুরস্কার। DUPS National Photography Festival-এ প্রথম পুরষ্কার পান ফিরোজ আল সাবাহ। ছবির জন্য সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য ফেডারেশন থেকে শ্রেষ্ঠ ওয়াইল্ডলাইফ আলোকচিত্রীর। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিজিটিএন-এ প্রকাশিত ফিরোজ আল সাবাহা’র ছবি তুমুলভাবে সাড়া জাগায়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অবদানে ফিরোজ পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, স্বীকৃতি হিসেবে বন বিভাগ থেকে পেয়েছেন পরিবেশ সংরক্ষণে সম্মাননা ২০১৬। ফিরোজ আল সাবাহ লেখালেখি করেন বাংলার পাখি ম্যগাজিনে। শেখ ফরিদ নামের বিলুপ্তপ্রায় পাখি রক্ষার্থে নিভৃতে কাজ করেছেন, পাখি ভালোবেসে নিজের বাড়িতে পুষেছেন শকুন, প্রশাসনের সহায়তায় রক্ষা করেছেন মদনটাক।

২০১৮ সালে পঞ্চগড় ব্র্যান্ডিং & পর্যটন শিল্পের বিকাশে নিমিত্তে ফিরোজ আল সাবাহ তৈরী করেন দেশের সর্ব প্রথম এরিয়াল ডকুমেন্টারি পাখির চোখে পঞ্চগড়। পঞ্চগড়ের ভূ-প্রকৃতি, জীব বৈচিত্র্য, গ্রামীণ ও বন্যজীবনের সৌন্দর্যময় প্রকৃতিকে ছবির মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের মাঝে উপস্থাপন করতে ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত পর্যটন নগরী তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরের ডাকবাংলোয় মহানন্দা নদীর তীরে অপরূপা পঞ্চগড় নামে একক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন ফিরোজ আল সাবাহ। পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর ক্যামেরায় তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি, জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, চা বাগানের সবুজে ঘেরা পরিবেশ, আটককৃত ভারতীয় বাঘ, মহানন্দার বুকে পাথর ও বালু উত্তোলনের ছবি সহ প্রকৃতি ও পরিবেশের ২৩ টি ছবি প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মৌসুমে (অক্টোবর থেকে নভেম্বর) আগত পর্যটকদের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ আলোকচিত্র প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ


ছবিঃ ফিরোজ আল সাবাহ
Last updated: 6 June 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn