কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ – Comrade Mohammad Forhad

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সংসদ সদস্য ও মেহেনতি মানুষের নেতা। কমরেড ফরহাদ ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ এর পাকিস্তান গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ৭১-পরবর্তী গণতন্ত্র আন্দোলন সহ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলনে সম্মুখ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬০ হতে ১৯৮০ দশক পর্যন্ত মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু। ১৯৬৯ এর ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের তিনি ছিলেন নেপথ্যর কারিগর এবং প্রকৃত পরামর্শদাতা।

জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন কমরেড ফরহাদ

আকন্ঠ বিপ্লব পিয়াসী কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বৃহত্তর সামাজিক রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তিনি পথ হেঁটেছেন বিপ্লবের পথে। ফরহাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, পেশাদার বিপ্লবী চরিত্র, অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা, নীতিতে অবিচল থেকে কৌশলে নমনীয়তা কমরেড ফরহাদকে ক্রমেই জাতীয় পর্যায়ে একজন স্বীকৃত সংগঠক ও জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আদর্শ, নিষ্ঠা, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, সমাজতন্ত্র ও মানবমুক্তির সংকল্পে অবিচল কমরেড ফরহাদ ছিলেন একজন নির্লোভ, প্রতিশ্রুতিশীল এবং কৌশলী সেনাপতি।

ষাটের দশক থেকে তিন দশকেরও বেশি সময়জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ফরহাদ দেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের পুরোভাগে থেকেছেন। অনেক সময়জুড়ে আত্মগোপন অবস্থায় নেপথ্যে থেকে কাজ করার জন্য এই কিংবদন্তিতুল্য নেতার ভূমিকা থেকেছে অপ্রকাশিত।

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন একজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচিত। দৈহিক গড়নে ছোটখাটো ছিলেন বলে পাকিস্তান আমলের নিষিদ্ধ রাজনীতির দিনগুলিতে তাঁকে সহকর্মীরা ছোট লোক বা  লিটলম্যান বলে সম্বোধন করতেন। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই ছোটলোকটি তদানিন্তন ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ গেরিলা বাহিনীর প্রধান সংগঠক ও অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

কমরেড ফরহাদ একটি বৈরী পরিবেশে ১৯৭৩ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরে পার্টিকে গণমানুষের পার্টি হিসেবে মূলধারার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আশির দশকের স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এই ছোট লোকটাই অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আশির দশকে সিপিবিকেই মনে করা হতো, বাংলাদেশের অত্যন্ত সুশৃংঙ্খল, সংঘবদ্ধ এবং দ্রুত বিকাশমান দল। সে সময়ের ক্ষেতমজুর আন্দোলন, যুব আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, নারী আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই সমাজতন্ত্র অভিমুখীন একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা দ্রুত বিকশিত করেছিলেন কমরেড ফরহাদ।

কমরেড ফরহাদ ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার জমাদারপাড়া গ্রামে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। বর্ষণমুখর বৃষ্টির দিনে রাতের বেলায় তার জন্ম হয়েছিল বলে নাম রাখা হয়েছিল বাদল। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুমহলে বাদল নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর বাবা স্কুলের ভর্তির খাতায় নাম দিয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ মোহাম্মদ ফরহাদ। তবে শেষ পর্যন্ত গণমানুষের কাছে পরিচিত হন মোহাম্মদ ফরহাদ নামেই। কমরেড ফরহাদের রাজনৈতিক ছদ্ম নাম ছিল কবির। তাঁকে বলা হত বাংলার লেনিন

কমরেড ফরহাদ এর পূর্বপুরুষ পীরে কামেল কদম আলী শাহ্ জলপাইগুড়ি থেকে পঞ্চগড়ের অত্র এলাকায় আগমন করেন। উনার পিতা আহমেদ সাদাকাতুল বারী এবং মাতা তোয়াবুন্নেসা। অতি সৎ চরিত্রের একজন অসাধারণ মানুষ আহমেদ সাদাকাতুল বারী ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তিনি ছিলেন ওই সময়ের গ্রাজুয়েট। এজন্য সমস্ত এলাকা জুড়ে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। তিনি সরকারী চাকুরীতে না গিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। তিনি বহু ছাত্রছাত্রীকে বিনা পয়সায় পাঠদান করতেন। ছাত্রছাত্রীদের সন্তানতুল্য ভালোবাসতেন। অভাব-অনটনের মধ্যে থেকেও তিনি কখনো আদর্শচ্যুত হননি। মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন বাবার মতাদর্শে অনুপ্রাণিত।

আহমেদ সাদাকাতুল বারী’র ১১ সন্তানের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ৬ সন্তান বেঁচে ছিলেন। ফরহাদ ছিলেন পঞ্চম সন্তান।

মোহাম্মদ ফরহাদ তৎকালীন ছাত্রী আন্দোলনের নেত্রী রাশেদা খানম রীনার (রীনা ফরহাদ) সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কমরেড ফরহাদ ছিলেন দুই সন্তানের জনক।

মোহাম্মদ ফরহাদের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। শিশুকাল শৈশব কৈশর কেটেছে দিনাজপুরে। চল্লিশের দশকের শুরুতে দিনাজপুর জিলা স্কুল সংলগ্ন একটি প্রাইমারী স্কুলে মোহাম্মদ ফরহাদ এর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ সময় তিনি তার বাবার কাছ থেকে যুদ্ধের বিবরণ শুনে নানা প্রশ্ন করতেন। যুদ্ধ কারা করে, কেন করে, কেন মানুষ মারে আরও কত কি? এভাবেই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।

ফরহাদ খেলাধুলায় তেমন পারদর্শী ছিলেন না, তবে ভাল আবৃতি করতেন। স্কুলে নাটকও করেছেন বেশ কয়েকবার। মাছধরা, পাখি শিকার ও ঘুরে বেড়ানো তার ছিল স্বাভাবিক নেশা। ছোটবেলায় তিনি নানাভাবে মানুষকে হাঁসাতে পছন্দ করতে। কান নাচানোর অভিনয় দেখিয়ে অন্যদের আনন্দ দিতেন। সময় করে বই পড়তেন নিয়মিত। বেশী পড়তেন ডিটেকটিভ বই। যৌবনে তিনি ছিলেন একজন আবৃতিকার এবং নাট্যাভিনেতা। একরোখা স্বভাবের এই মানুষটি যা সিদ্বান্ত নিতেন, তা করে ছাড়তেন।

তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি ও প্রশংসিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দিনাজপুরের তদানিন্তন একমাত্র কলেজ দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন। দিনাজপুরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়নকালে মোহাম্মদ ফরহাদ সাহিত্যপাঠ ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ছাত্র সংসদ থেকে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে আই.এ. পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে বি.এ. পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

১৯৬১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি এম.এ পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান লাভ করেন। ১৯৬২ সালে আইন অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ুব খান ফরহাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। ক্রমেই তিনি পরিণত হন পাকিস্তানের স্বৈরশাসনবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণ-পুরুষে।

ছোটবেলাতে জেলে যাওয়ার আগেই জেলে যাওয়ার রিহার্সাল শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। মোহাম্মদ ফরহাদ: জীবন ও সংগ্রাম গ্রন্থে গবেষক নিতাই দাস লিখেছেন —”মো. ফরহাদ শুনেছিলেন যে জেলে গেলে খালি মেঝেতে ঘুমাতে হয় এবং বিছানা-মশারী কিছুই দেওয়া হয় না। ওই কষ্টের জীবনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনিও তক্তপোষ থেকে বিছানা-মশারি গুটিয়ে নেন। এভাবে খালি তক্তপোষে মশার দংশন সহ্য করে তাঁর অনেক রজনী অতিবাহিত হয়েছিল। একদিন অবশ্য তিনি এই অবস্থায় বাবার কাছে ধরা পড়ে যান।”

অসাধারণ বাগ্মী আর প্রজ্ঞার অধিকারি কমরেড ফরহাদের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদামাটা। মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতার। নির্লোভ, নিরহঙ্কার মানুষ ছিলেন কমরেড ফরহাদ। সাদা পজামা-পাঞ্জাবী পরতেন। এত শান্ত-ধীর-স্থির নেতা বাংলাদেশে খুব কমই জন্মগ্রহণ করেছেন। বিশ্বাস-আদর্শে, কথায়-কর্মে-আচরণে এমন আশ্চর্য মিল খুব কম মানুষের মধ্যেই থাকে। প্রিয় খাবার ছিল সাদাভাত, আলু আর টাকি মাছের ভর্তা। কথা বলতেন আস্তে আস্তে, অত্যন্ত সাজিয়ে-গুছিয়ে, যুক্তি দিয়ে।

মোহাম্মদ ফরহাদ মহান ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে প্রথম সারির নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহুবার জেল, জুলুম, হুলিয়া, নির্যাতন ভোগ করেন। ৩৫ বছরের ঘটনা বহুল রাজনৈতিক জীবনে তিনি পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়া-এরশাদের আমলে কারাবরণসহ দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর আত্মগোপন বা কারান্তরালে ছিলেন। একরোখা স্বভাবের কমরেড ফরহাদ যা সিদ্বান্ত নিতেন, তা-ই করে ছাড়তেন।

 

  • ১৯৪০ সাল থেকে ভারতবর্ষে কমিউনিষ্ট নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। তেভাগা আন্দোলনে ৬০ লক্ষ কৃষক জড়ো হয়েছিল। এই লড়াই-সংগ্রামের কথা  শিশু ফরহাদের চেতনায় রেখাপাত করেছিল।
  • ১৯৪৭ সালে তিনি সপ্তম শেণীর ছাত্র। তিনি ছাত্র হিসেবে খুব তুখোড় ছিলেন। তখন তিনি মুকুল ফৌজ নামে একটি শিশু-কিশোর সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। এই সংগঠনটি ছিল মুসলিমলীগের দৈনিক মুখপত্র আজাদ পত্রিকার। পত্রিকার শিশু-কিশোর পাতায় তিনি অনেক লেখা লিখেছেন। ওই সংগঠনে কাজ করে এক পর্যায়ে তিনি সংগঠনের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন।
  • ১৯৪৮-৪৯ সালে স্কুলের মিলিশিয়াতে যুক্ত হন। এই মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ্যতা অর্জন করে তিনি লিডার নির্বাচিত হয়েছিলেন।
  • ১৯৫০-৫১ সালে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের একটি পাঠাগার থেকে রাজনৈতিক বই নিয়ে পড়তেন। তাঁর বাবার কাছে কমিউনিষ্টরা সমাজের সবচেয়ে ত্যাগী মানুষ এর গল্প বহুবার তিনি শুনেছেন। কমিউনিষ্টদের নিয়ে বন্ধু-বান্ধবের কাছে গল্প করতেন। খাতায় কাস্তে-হাতুড়ি একে রাখতেন। এভাবেই ফরহাদের শৈশব চেতনা গড়ে উঠে।
  • ১৯৫১ সালে কিশোর মোহাম্মদ ফরহাদ দিনাজপুরের কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতৃবর্গের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মির্জা নুরুল হুদা কাদের বক্স (ছোটি), অনিল রায়, দীপেন রায়, আসলেউদ্দিন, গুরুদাস তালুকদার, কম্পরাম সিং, ইন্দ্রমোহন, মির্জা আব্দুস সামাদ প্রমুখ।
  • ১৯৫২ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পরপরই এদেশের ছাত্র সমাজের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ ঢাকায় গঠিত হলে দিনাজপুর জেলায় ঐ সংগঠনের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
  • ১৯৫৩ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশুনার সময় তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন।
  • ১৯৫৩-৫৪ সালে বোদা-পঞ্চগড় প্রভৃতি এলাকায় তিনি প্রথম ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলেন
  • ১৯৫৪ সালে ১০ জুন পাকিস্তানের কুখ্যাত নিরাপত্তা আইন ৯২-ক ধারায় গ্রেফতার হয়ে বিনা বিচারে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকেন।
  • ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
  • ১৯৫৫ সালে ১৭ বছর বয়সে মোহাম্মদ ফরহাদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করে। এই সময়কালে কমরেড মণি সিংহের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে।
  • ১৯৫৬ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন দিনাজপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
  • ১৯৫৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য (কোষাধ্যক্ষ) নির্বাচিত হন। কমরেড ফরহাদ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পার্টির নির্দেশে কোষাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। কেননা পার্টি মনে করেছিল একেবারে উপরের পদে গেলে পার্টির গোপন কাজ করতে অসুবিধা হবে।
  • ১৯৫৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় কমরেড ফরহাদ গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন।
  • ১৯৬১ সালে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের জন্য গঠিত হয় ৫ সদস্য বিশিষ্ট ছাত্র কমিটি। এই কমিটির মূল নেতা ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
  • ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে যে জঙ্গি ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন সেই আন্দোলনের মূল নেতা। তাকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করা হয়।
  • ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব-শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকার রাজপথে মিলিটারি ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে প্রথম যে মিছিল বের হয়, সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ ফরহাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি রফীকুল হক এ বীরত্বপূর্ণ অভ্যুত্থান পরিচালনা করলেও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমেদ এবং ছাত্রলীগের আদর্শগত পরিচালক সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
  • ১৯৬৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক নির্বাচিত হন।
  • ১৯৬৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
  • ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে মোহাম্মদ ফরহাদ কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। পার্টির নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন, নারী আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম প্রসারে তাঁর ছিল মুখ্য ভূমিকা। প্রবীণ প্রজন্মের ত্যাগী নেতা এবং নতুন প্রজন্মের নবীন কর্মীদের মধ্যকার সেতুবন্ধন ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
  • ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনে কমরেড ফরহাদ ছিলেন নেপথ্য নায়ক।
  • ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি রাজনীতিকদের নিরঙ্কুশ বিজয়ে অনন্য ভূমিকা রাখেন কমরেড ফরহাদ।
  • ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর তিনি সংগঠক, নেতা ও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনে তার অবদান চিরস্মরণীয়।
  • ১৯৭২ সালে ৩০ জানুয়ারি কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলা বাহিনীর অস্ত্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিকট সমর্পণ করেন।

    মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে আনুষ্ঠানিক অস্ত্র সমর্পণ করছেন কমরেড ফরহাদ
  • ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ পায় এবং মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৩৫ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
  • ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন এবং তাকে ঐ সংগঠনের দলীয় রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
  • ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রথম মিছিল সংগঠিত করা- সব ক্ষেত্রেই ফরহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের জন্য, শ্রমিক কৃষক জনগণের স্বার্থে লড়াই করতে গিয়ে কমিউনিস্টরা বারবার দমন-পীড়নের শিকার হন। কমরেড ফরহাদকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে ফরহাদ একাধিকবার কারাবরণ করেন।
  • ১৯৭৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে এবং বিনাবিচারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখে।
  • ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করলে সরকারের বিরুদ্ধে হাই কোর্টের বিচারপতিগণ রায় দেন যে, সরকার বেআইনিভাবে তাকে বিনাবিচারে আটক রেখেছে। তিনি মুক্তি লাভ করেন।
  • ১৯৭৮ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ১৫ দল ও ৭ দলের যুগপৎ কর্মসূচি প্রণয়ন ও আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ ফরহাদের ছিল বিশেষ ভূমিকা।
  • ১৯৭৯ সালে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
  • ১৯৮০ সালের মার্চে নিম্ন বেতনভুক সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা শুরু করে। ১৯৮১ সালের আগস্টে সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশবলে তিনি মুক্তি পান।
  • ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর সামরিক শাসনবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য তথা ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন; জাতীয় দাবি ৫ দফা প্রণয়ন ও যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বলিষ্ঠ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
  • ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে গ্রেফতার করে ১৪ দিন বন্দি করে রাখা হয়।
  • ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্বৈরাচার এরশাদকে পরাস্ত করার কৌশল হিসেবে তিনি দিয়েছিলেন দুই নেত্রীর ১৫০-১৫০ আসনে নির্বাচন করার ফর্মূলা। সেদিন ভীত হয়ে স্বৈরাচারএরশাদ অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন যে কোন প্রার্থী ৫টির বেশি আসনে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারবেন না। অনেকে তাকে ‘এরশাদের যম’ বলে অভিহিত করেছিল।
  • ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ বছর জাতীয় সংসদ অধিবেশনের বাজেট বক্তৃতায় তিনি সরকারের গণবিরোধী চরিত্রের ওপর যে বক্তব্য রাখেন, তা ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় অবদান রচনার পথে যাত্রা শুরু করে।
  • ১৯৮৭ সালে চতুর্থ কংগ্রেসে পুনরায় কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন।

 

রাজপথে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে কমরেড ফরহাদ

জাতীয় রাজনীতি, ছাত্র, শ্রমিক, নারী আন্দোলন, যুব, ক্ষেতমজুর, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা কর্মকাণ্ড এবং সিভিল সোসাইটির তৎপরতার পেছনেও ছিল মোহাম্মদ ফরহাদের অবদান। ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আন্দোলনে এবং সংগঠন গড়ে তোলার পেছনেও তিনি অনুঘটকের নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন। এছাড়াও দেশের সবচেয়ে অবহেলিত নির্যাতিত ক্ষেতমজুরকেও তিনি সংগঠিত করেছেন। এ সংগঠনেরও তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই জননেতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক নিবন্ধে লেখেন – “আমার দৃষ্টিতে মোহাম্মদ ফরহাদ হলেন সেই প্রজন্মের প্রতিভূ, যাদের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্জন্ম লাভ করে। ১৯৪৭-এর প্রাক্কালে এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বে হিন্দু পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিদেরই প্রাধান্য ছিল। সে সময় বিকাশমান নব্য মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং তাদের দ্রুত নেতৃত্বে নিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ নিজ গুণে এই উত্তরণকালীন-প্রক্রিয়ার মূল ধারক ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ স্নাতকোত্তর এর পরবর্তীতে কিছুকাল মোহাম্মদ ফরহাদ দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় খেলাঘর পাতার সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সাংবাদিকতা পেশায় তিনি স্থিত হতে পারেননি। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ তাঁর জীবদ্দশায় রাজনৈতিক বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। পার্টির মুখপত্র, তাত্ত্বিক পত্রিকা ও কোনো কোনো সময় জাতীয় দৈনিকেও তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। মোহাম্মদ ফরহাদ স্বনামের চাইতে বেনামিতেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছেন।

কমরেড ফরহাদ সংবাদ-পত্র পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, “কাসা বা পিতলের ঘটি-বাটি-থালাকে যেমন কি না প্রতিনিয়ত ঘষামাজা না করলে তা তার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে, ঠিক তেমনি জ্ঞানেরও প্রাত্যহিক চর্চা ও ঘষামাজা করতে হয়। না হলে জ্ঞানে মরিচা ধরে। একদিন তা অচল হয়ে যায়। প্রতিদিন খুব ভাল করে ‘সংবাদ’ পড়বেন, খুটিয়ে খুটিয়ে। কোন খবরটির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটিও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সমস্ত পত্রিকাটি পড়া শেষ হয়ে গেলে ভাবতে হবে আগামীকাল ‘সংবাদ’-এর সম্পাদকীয় কী হতে পারে। কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটি নিয়েই সম্পাদকীয় লেখা হবে। এটা মাথায় রেখে নিজেকে সেই সম্পাদকীয়র বিষয়বস্তু ও মূল পয়েন্টগুলো লিখতে হবে। তারপর অপেক্ষা করতে হবে আগামীকালের ‘সংবাদ’-এর জন্য। পরদিন পত্রিকা হাতে পেয়েই প্রথমে দেখতে হবে সম্পাদকীয়টি কী বিষয়ে লেখা হয়েছে। যদি দেখেন যে, ভাবনার সঙ্গে মিলে গেছে তাহলে দু’টি লেখার মধ্যে তুলনামূলক বিচার করে নিজের ঘাটতিটুকু পূরণ করতে হবে। সংবাদপত্র নিছক কোনো তথ্য সংগ্রহের ব্যাপার মাত্র নয়, এটা রাজনৈতিক চর্চা এবং মতাদর্শিক আত্মগঠনেরও বড় হাতিয়ার।”

তিনি কোনো বই রচনা করে যেতে পারেননি। তবে মৃত্যুর পর তাঁর লেখা একটি পর্যালোচনা খুঁজে পাওয়া গেলে তা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। দীর্ঘদিন পর তাঁর সহধর্মিণী রিনা খানের সংগ্রহে থাকা সাপ্তাহিক একতাসহ পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধ মোহাম্মদ ফরহাদের একগুচ্ছ প্রবন্ধ বাংলাদেশ সময়কাল নামে ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ ফরহাদের জীবনী নিয়ে লেখা অনন্য আরেকটি বই মোহাম্মদ ফরহাদ, ক্ষণজন্মা এক বিপ্লবীর অসামান্য জীবন

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ বিভিন্ন সময়ে সিপিবির মুখপত্র সাপ্তাহিক একতায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ ‘বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং কমিউনিস্ট পার্টি’ এই শিরোনামে লেখায় মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্টির নেতৃত্বের চিন্তা তুলে ধরেছেন এভাবে “…আমাদের পার্টির মূলকথাগুলো ছিল খুবই সঠিক। (ক) পাকিস্তান একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র, (খ) অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, (গ) পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ বিচ্ছিন্নতা একটি ন্যায্য দাবি এবং পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কাছে এটাই আমাদের শেষ কথা, (ঘ) ভারতের সাথে মৈত্রী আমাদের সংগ্রামের বিজয়ের একটি পূর্বশর্ত, (ঙ) সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের জনগণের দুশমন এবং উল্টো দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির আমাদের প্রকৃত বন্ধু, (চ) চীনের মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে যে নীতি অনুসরণ করছেন তা আসলে জাতীয় মুক্তি ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক।”

একই প্রবন্ধে তিনি তিনটি করণীয়ের কথা উল্লেখ করেছেন – “প্রথমত, সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ; দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতরে সংগ্রামী শক্তিসমূহকে ঐক্যবদ্ধকরণ; তৃতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির, কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির শিবিরকে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে টেনে আনা।”

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৮৭ সালের ১০ জানুয়ারী হার্টের রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৮৭ সালের ১০ আগস্ট চিকিৎসার জন্য মস্কো যান। ৬ অক্টোবর হাসপাতাল ত্যাগ করে হোটেলে অবস্থান নেন। হোটেলে অবস্থানকালে ৯ অক্টোবর ১৯৮৭  বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তাঁর কর্মবহুল জীবনের অবসান ঘটে।

৯ অক্টোবর, একাধারে ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবী নেতা কমরেড চে গুয়েভারা এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী পুরোধা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুবার্ষিকী।

কমরেড ফরহাদের আকস্মিক মৃত্যুতে দেশের রাজনীতির সচেতন মহলে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তার অকাল প্রয়াণ বাংলাদেশের বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্ট করে। মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। অনেকেই আজও মনে করেন, তাঁর অকাল মৃত্যু না হলে এই মানুষটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে এক নতুন ধরণের মুক্তি সংগ্রামের ধারায় বিকশিত করতেন। গরিব-মেহনতি মানুষের সরকার, ক্ষেতমজুরের সরকার, ছাত্রদের সরকার, নারী ও শিশুবান্ধব এবং একটি সাম্য ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক সরকার এই মানুষটির বিচক্ষণ রাজনৈতিক কৌশলে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো।

সেই সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ৮ দলীয় জোটনেত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে সিপিবি অফিসে উপস্থিত হয়ে শোকবইয়ে লিখে এসেছিলেন “তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির অগ্রদূত। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদকে বাদ দিয়ে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব, অসম্ভব স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণতন্ত্রের সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করা। তাঁর মৃত্যুর ক্ষতি যে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। “

হেলিকপ্টারযোগে মোহাম্মদ ফরহাদের লাশ আনা হয়েছিল বোদা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। লাখো জনতার ঢল নেমেছিল সেদিন প্রিয় এই মানুষটিকে এক নজর দেখার জন্য। তাঁর জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছিল যে তিনি মানুষের কাছে কতো প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। মোহাম্মদ ফরহাদকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সম্মাননা, স্মৃতিবিজড়িত সংগঠন এবং উদ্যোগ সমূহঃ

  • মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুর পর দেশের প্রধান সারির কবিরা কবিতা লিখে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।

শামসুর রাহমান তার কবিতায় লিখেছিলেনঃ

“অকস্মাৎ এ কেমন নিস্তব্ধতা এলো দেশে?
এ কেমন সূর্যাস্তের ছটা
বিলাপের মতো
আকাশে ছড়িয়ে পড়ে? বেদনার্ত পাখি নীড়ে ফেরা
ভুলে যায়, ফুল
উন্মীলনে পায় না উৎসাহ,
নদীতে জোয়ারভাটা থেমে যায়; মনে হয়, পঞ্চাশ হাজার
বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি কী ভীষণ বাষ্পাকুল।
না তোমাকে মানায় না এ রকম কাফনের শাদা
মোড়কে সাজানো শুয়ে থাকা
মাটির গভীরে, না তোমাকে মানায় না;
এ গহন স্তব্ধতায় মিশে থাকা সাজে না তোমাকে।”

সৈয়দ শামসুল হক লিখেন অমর পংক্তিমালাঃ

“তাহলে বিদায়, বন্ধু, তাহলে বিদায়;
এভাবে, এ অবেলায়,
সূর্যের অস্তের আগে আমাদের কন্ঠে তুলে নিতে হচ্ছে সূর্যাস্তের গান,
সবচেয়ে প্রয়োজন যখন আপনাকে,
আমাদের বলতে হচ্ছে ‘বিদায়’।
তাহলে বিদায়, বন্ধু, একই জলহাওয়ায় বর্ধিত,
আঞ্চলিক একই ভাষা দুজনেরই বলে আমি ঈষৎ গর্বিত,
ভাষা আজ ভাষাহীন,
বুদ্ধি আজ সাময়িকভাবে স্তম্ভিত; হ্যা, সাময়িক অবশ্যই বটে;
আপনার জীবন ছিল ক্রমশ বৃদ্ধির–
অকস্মাৎ, হে বন্ধু বিদায়।”

নির্মলেন্দু গুণের বিশাল কবিতার কয়েক লাইনঃ

“যাক বাবা, বাঁচা গেলো, আল্লাহর কাছে হাজার শোকর
মণি সিংহের চেলাডা মরেছে।
ব্যাটা গোকূলে কৃষ্ণের মতো ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল
এই ধর্মপ্রাণ বঙ্গভূমিতে আফগান স্টাইল বিপ্লব করবে বলে।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি সময় বুঝে তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন।
ব্যাটা ছিল ঝানু পলিটিশিয়ান, মানতেই হবে।
উইকেটের চারপাশে ব্যাট চালাচ্ছিল, রিচার্ডসের মতো,
ব্যাট তো নয়, যেন ঈশা খাঁর ক্ষিপ্র তরবারি –
এখন আশা করি বিপ্লবের রান-রেটটা একটু ফল করবে।
কিছুদিন শান্তিতে থাকতে পারবো।”

  • কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ মৃত্যুবাষির্কী উদযাপন পরিষদ
  • মণি সিং ফরহাদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট

  • কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ কমিউনিস্ট হাসপাতালঃ কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ র সহধর্মিনী মিসেস রীনা ফরহাদ, তাঁর প্রিয়জনেরা, রাজনৈতিক জীবনের বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী এবং সর্বোপরি এলাকার গণমানুষ এই বিপ্লবীর স্মরণে তাঁর নিজ এলাকায় ‘কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ কমিউনিটি হাসপাতাল’ নামে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তুলে মানুষকে প্রায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন। লেখক ও সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার ‘৯৬ সালে এই উদ্যোগের সূচনা করেছিলেন। নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের ঐকান্তিক সহযোগিতায় ২০০৮ সাল থেকে নতুন করে এই কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি যাত্রা শুরু করে। কমরেড মণিসিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাষ্ট, সামিট গ্রুপ, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এবং ফরহাদ সাহেবের বন্ধু শুভানুধ্যায়ীরা এই উদ্যোগে সার্বিক সহযোগিতা করছেন।

 


তথ্যসূত্রঃ এম এম আকাশ | মমতাজ আকসাদ | নেহাল আদেল | মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম | বিভুরঞ্জন সরকার | রুস্তম আলী খোকন | শেখ রফিক | বিপ্লবীদের কথা | রাজীব রায়হান | নতুন সময় টেলিভিশন
Last updated: 22 November 2023

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ
(১৯৩৮-১৯৮৭)

  • বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক
  • সংসদ সদস্য
  • ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সংগঠক, নেতা ও অধিনায়ক
  • ছাত্র ইউনিয়ন দিনাজপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক
  • ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক