মুহাম্মদ জমির উদ্দিন সরকার বাংলাদেশের একজন প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী জমির উদ্দিন সরকার ছিলেন ৫ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, সাবেক বিএনপি সরকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। জমির উদ্দিন সরকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি)’র প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বর্তমানে (২০২৩) খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি)’র প্রথম সারির নেতা। জমির উদ্দিন সরকার পেশায় আইনজীবি এবং রাজনীতিবীদ।
জমির উদ্দিন সরকার ১ ডিসেম্বর ১৯৩১ সালে পঞ্চগড় জেলার তেতুঁলিয়া থানার নয়াবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মৌলভী মুহম্মদ আজিজ বক্স এবং মাতা মরহুমা বেগম ফখরুন্নেছা। মুহম্মদ আজিজ বক্স একজন জোতদার ছিলেন।
১৯৪৫ সালে ৯ম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান এবং “পাকিস্তান ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হোক” এই অভিপ্রায় নিয়ে জনাব সরকারের রাজনৈতিক জীবন শুরু। পরবর্তীতে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের সমর্থক হয়ে ওঠেন।
১৯৫৮ এবং ১৯৫৮ সালে জনাব সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান নাম সার্জেন্ট জোহিরুল হক হল) -এর ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে জমির উদ্দিন সরকার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে সেরা তর্কিক। ২৭ মে ১৯৬০ সালে জমির উদ্দিন সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট থেকে সনদ নিয়ে আইন পেশা শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে সংবিধান, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। জমির উদ্দিন সরকার ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং মাওলানা ভাসানীর সহচর।
জমির উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এমএ এবং পরবর্তীতে এলএলবি পাশ করেন। ১৯৬১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর জনাব সরকার Inns of Court Pakistan Society, London -এর সভাপতি নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি ছিলেন London East Pakistar Society House -এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
জমির উদ্দিন সরকার লন্ডনের Honourable Society of Lincoln’s Inn. থেকে ব্যারিষ্টার-এট-ল পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধান, সিভিল এবং ক্রিমিনাল আইনের একজন প্রখ্যাত ব্যারিস্টার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জমির উদ্দিন সরকার ছিলেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)-এর ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সারির সদস্য। পরবর্তীতে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর স্থায়ী কমিটির সদস্য হন।
- ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক সংসদ নির্বাচনে জমির উদ্দিন সরকার পঞ্চগড় জেলা অন্তর্ভুক্ত একটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
- ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমির উদ্দিন সরকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
- ১৯৭১ সালে হাইকোর্টে আইনজীবীদের যে গ্রুপটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে জমিরউদ্দিন সরকার ছিলেন তাঁদের একজন।
- ১৯৭৫ পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশী জাতীয়বাদী রাজনৈতিক ধারার অন্যতম প্রবর্তক ছিলেন।
- আইন পেশায় সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাকে পাঁচবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান। দল গঠনের প্রথম পর্যায়ে জিয়াউর রহমান জাগদল গঠন করলে তিনি তাতে যোগ দেন।
- জমির উদ্দিন সরকার ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন দিনাজপুর-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
- ৬ এপ্রিল ১৯৮১ থেকে ২৭ নভেম্বর ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জমিরউদ্দিন সরকার জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়কালে জমিরউদ্দিন সরকার বর্তমান সংসদ ভবনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন।
- ২৭ নভেম্বর ১৯৮১ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় জমিরউদ্দিন সরকার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- ১৯৮৮ সালে গঠিত International Committee for Palestinian Human Rights (ICPHR) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন জনাব জমির উদ্দিন সরকার।
- ২০ মার্চ ১৯৯১ থেকে ২৮ আগস্ট ১৯৯১ পর্যন্ত পঞ্চম জমিরউদ্দিন সরকার পঞ্চম জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রীসভায় ভূমিপ্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন।
- ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ থেকে ১৯ মার্চ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জমিরউদ্দিন সরকার ভূমি, শিক্ষা এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঞ্চগড়-১ আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
- ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে গঠিত স্বল্পকালীন বিএনপি সরকারের মন্ত্রীসভায় তিনি ১৯ মার্চ ১৯৯৬ থেকে ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঞ্চগড় ১ আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
- ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঞ্চগড় ১ আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
- ২৮ অক্টোবর ২০০১ থেকে ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ সাল পর্যন্ত জমির উদ্দিন সরকার অষ্টম জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- জমিরউদ্দিন সরকার বিএনপি সরকারের আমলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগ করার পর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত ২১ জুন ২০০২ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক স্পিকার হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। জমির উদ্দিন সরকার আওয়ামী লীগের মজাহারুল হক প্রধানের কাছে পরাজিত হন।
- ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদের বগুড়া ৬ আসনের উপ-নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
- ২০১৪ সালে পঞ্চগড় ১ আসনে মনোনয়ন পেলেও জমির উদ্দিন সরকারকে শেষ মুহূর্তে জাতীয় পার্টি (জাপা)’কে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়।
- ২০১৮ সালে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের আইনজীবী ছিলেন।
গত চার দশকে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার সহ বহু দেশ সফর করে ২৫টিরও বেশি আন্তর্জাতিক আইন সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে তিনি সভাপতিত্ব করেন।
ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমির উদ্দিন সরকার -এর লেখা উল্লেখযোগ্য বইঃ
- গণতন্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
- পাল রাজ থেকে পলাশী এবং বৃটিশ রাজ থেকে বঙ্গভবন
- গ্লিমপেসেস অব ইন্টারন্যাশনাল ল
- স্ট্রংগার ইউনাইটেড ন্যাশনস ফর পিসফুল ওয়েলফেয়ার ওয়াল্ড
- অষ্টম সংসদে স্পীকার
- দি ল অব দি সি
- ল অব দি ইন্টান্যাশনাল রিভারস এ্যান্ড আদার ওয়াটারকোর্রস
- লন্ডনে বন্ধু-বান্ধব
- লন্ডনে শিক্ষা জীবন
- লন্ডনে ছাত্র আন্দোলন
- বাংলাদেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ ও ডিগবাজি
জমির উদ্দিন সরকার দিনাজপুরের সুপরিচিত হাজী জলিলউদ্দিনের কন্যা নূর আক্তার সরকারকে বিয়ে করেন। তিনি এক মেয়ে ও দুই ছেলের জনক। মেয়ে নিলুফার জমির ঢাকা এবং মিশিগানার অ্যান আর্বার থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন। ছেলে নওশাদ জমির ঢাকা থেকে এলএলবি এবং হার্ভার্ড থেকে এলএলএম করেন। তিনি একজন ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল এবং বর্তমানে (২০২৩) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে নওফল জমির ঢাকা ও লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন। নওফল জমিরও একজন ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল। জমির উদ্দিন সরকারের স্ত্রী বেগম নুর আক্তার সরকার ২ মে ২০২৩ সালে, ৮২ বছর বয়সে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
২৮ ডিসেম্বর ২০১০ সালে “জমিরউদ্দিন সরকার স্পিকার থাকাকালীন সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অবৈধ উপায়ে সরকারি অর্থ নগদে তুলে আত্মসাত করেন। পাশাপাশি তিনি সরকারি বাসভবনের আসবাবপত্র কেনার জন্যও অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাত করেন” – এই অভিযোগে দুদকের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান খান ও উপ-সহকারী পরিচালক এস এম খবির উদ্দিন শেরে-বাংলা নগর থানায় জমিরউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেন।
জনাব জমিরউদ্দিন সরকার উক্ত মামলাগুলোর বাতিল চেয়ে হাই কোর্টে আবেদন করলে, হাই কোর্ট মামলাগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করে। কিন্তু সেই রুলের শুনানি শেষে ১৯ মে ২০১৬ সালে হাই কোর্ট বিভক্ত আদেশ দেয়। পরে হাই কোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ এসব মামলা চলার পক্ষে আদেশ দেয়। জমিরউদ্দিন সরকার হাই কোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবারো আবেদন করলে সর্বোচ্চ আদালত মামলাগুলো বাতিলের আদেশ দেয়। তবে একইসঙ্গে চিকিৎসা ভাতা হিসেবে নেওয়া টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বলা হয় জনাব জমিরউদ্দিনকে।
জনাব জমিরউদ্দিন সরকার ১৪ মার্চ ২০২৩ সালে ঢাকা সুপ্রিম কোর্ট এলাকার সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এই অর্থ জমা দিয়ে মামলাগুলো থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি পান। টাকার পরিমাণ ছিলঃ ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬৪ টাকা।
Last updated: 26 November 2023