ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির সদস্য ও একসময়ের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কালো পতাকা উত্তোলনকারী শিক্ষার্থী। ১৯৫২ সালের মাঝ রাতে যে এগারোজন ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি তাঁদের একজন। ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও সৃজনশীল প্রকাশনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ১৯৫৩ সালের মার্চে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারির’ প্রকাশক। বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ত্ব।
মোহাম্মদ সুলতান ২৪ ডিসেম্বর ১৯২৬ সালে পঞ্চগড় জেলার (তৎকালীন দিনাজপুর জেলা) বোদা উপজেলার অন্তর্গত মাঝ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার মোহাম্মদ শমসের আলী এবং মা গুলজান্নেসা। জনাব মোহাম্মদ শমসের আলী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পুলিশ বিভাগের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ। সুলতান ছিলেন বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে পঞ্চম। সুলতানের মা গুলজাননেসা যখন মারা যান, তখন সুলতান ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আট ভাইবোনের মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন পঞ্চম এবং ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ। তিন বোনই ছিলেন সুলতানের ছোট। ফলে সন্তানদের কথা ভেবে তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন।
সুলতানের বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় পড়াশোনা করতে হয়েছে তাঁকে। স্কুলজীবনে তিনি একজন একনিষ্ঠ বয় স্কাউট ছিলেন। শৈশবের সেই নিয়মানুবর্তিতাই পরবর্তী জীবনে তাঁকে যুক্তিবাদী ও নিয়মানুবর্তী করে তুলেছিল।
১৯৪২ সালে মোহাম্মদ সুলতান যশোর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা পাসের পর সুলতান যশোরে মাইকেল মধুসূদন কলেজে ভর্তি হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু এবং বাবার কর্মস্থল বদলির কারণে সুলতানের পড়াশোনায় সাময়িক বিঘ্ন ঘটে। অনিবার্য কারণে কলকাতার কাছেই কালীপুর এআরপিতে পোস্ট ওয়ার্ডেনের চাকরি নেন সুলতান। এরপর সেই চাকরি ছেড়ে খড়দেহে সার্কিন এয়ার ডিপার্টমেন্টে স্টোর কিপারের চাকরি করেন। চাকরির সঞ্চয় দিয়ে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে আইএ পরীক্ষা দেন। সে সময় থেকেই সুলতান অল্প বয়সেই ভারত ছাড় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। রাজশাহীর অন্যতম ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং ১৯৪৬ সালে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে সামিল হন।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যুবনেতাদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন গঠিত হয়। রাজশাহীতেও ১৯৪৮ সালের ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি একটি যুব সম্মেলনের আহ্বান করা হয়। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর শোচনীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২ ফেব্রুয়ারি একদিনেই সম্মেলনের কাজ শেষ হয়। সম্মেলনের অধিবেশন হয় ভুবনমোহান পার্কে। ভিয়েতনাম থেকে মাই-থি চাউ প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। সভার সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ সুলতান।
১৯৪৮ সালে রাজশাহী ভাষা আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণাকালে মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র। জিন্নাহ’র ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে, মোহাম্মদ সুলতান সহ অন্যান্যদের অগ্রণী ভূমিকায় ১১ মার্চ রাজশাহীতে মিছিল, সভা ও ধর্মঘট পালন করা হয়। যদিও তখনো মোহাম্মদ সুলতান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে তাঁর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি দুর্বলতা ছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজশাহীতে এলে তাকে কালো পতাকা দেখানো হয় এবং স্লোগান তোলা হয়, ‘গো ব্যাক লিয়াকত আলী’।
১৯৪৯ সালে সুলতান ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ও খাদ্যের দাবিতে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শেষে ছিল ভুখা মিছিল। সে ভুখা মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল। তাতে শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ১২ অক্টোবর ভুখা মিছিল করার অপরাধে ভাসানী, শেখ মুজিব ও শামসুল হককে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে মোহাম্মদ সুলতানের ঢাকা আগমন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে শিক্ষাগ্রহণ শুরু। তিনি ভর্তি হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।
মোহাম্মদ সুলতান ভেবেছিলেন, নিরিবিলি কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা শেষ করবেন দুবছরের মধ্যে, এরপর করবেন অধ্যাপনা। কিন্তু তা আর হলো না। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা নূর উল ইসলাম হলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রার্থী। অলি আহাদ, কেজি মুস্তাফা এবং অন্য প্রগতিশীল ছাত্রদের অনুরোধে মোহাম্মদ সুলতান সক্রিয় সমর্থন দিলেন মুস্তাফা নূর উল ইসলামকে। আর এভাবেই সুলতান আবারও ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এলেন।
১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় ও পরোক্ষ সমর্থনে এই দাঙ্গা সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাতে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ছাত্রদের দাঙ্গাবিরোধী মিছিল বের হয়। ইকবাল হল থেকে যে ছাত্র মিছিল বেরিয়ে আসে, তার নেতৃত্বে ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান ও মোহাম্মদ সুলতান। মিছিলটি আকারে ছিল ছোট, কিন্তু তার গুরুত্ব ছিল বেশি। কারণ সেদিন ওই একটি মিছিলই পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনে গিয়ে দাঙ্গার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে আসে। নূরুল আমীন দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এই প্রতিশ্রুতি আদায় করেই মিছিলটি হলে ফেরে।
১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নামে প্রগতিশীল একটি সংগঠনের জন্ম হলে মোহাম্মদ সুলতান হন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। ভাষা আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে এই সংগঠনটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির গভীর রাতে ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে ১১ জন ছাত্রের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১১ জন ছাত্রের মধ্যে গাজীউল হক, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল ও মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন অন্যতম। ২১ ফেব্রুয়ারি সুলতান ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের নাম লিখে রাখার দায়িত্ব পালন করেন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করে সভা প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কালো পতাকা উত্তোলনকারী শিক্ষার্থী।
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হলে মোহাম্মদ সুলতান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক কাজে গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে ঘুরেছেন। প্রগতিশীল ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করেছেন। এ জন্য বহুদিন মোহাম্মদ সুলতানকে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে। একই সময়ে তিনি যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
১৯৫২ সালে মোহাম্মদ সুলতান তাঁর পড়াশুনা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। বহু ছাত্রকে প্রগতিশীল আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অমায়িক ব্যবহার ও বন্ধু বাৎসল্য আদর্শপ্রাণতা ও নীতিপরায়ণতা, সত্যপ্রীতি, আত্মত্যাগ—এসবই ছিল তাঁর শিক্ষা প্রদানের বৈশিষ্ট্য।
রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সুলতান বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং আন্দোলনের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করে রাখার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯৫২ সালে মোহাম্মদ সুলতান এবং এম আর আখতার মুকুল মিলে শুরু করেন পুঁথিপত্র নামে একটি বইয়ের দোকান। ছোট্ট এই দোকানটি আগে ছিল মার্কসবাদী বইয়ের দোকান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই দেখে দোকানটির নাম দেওয়া হয় পুঁথিপত্র। কিছুদিনের মধ্যেই পরামর্শদাতা হিসেবে তাতে যোগ দেন হাসান হাফিজুর রহমান। তবে এম আর আখতার মুকুল বেশিদিন যুক্ত ছিলেন না প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে।
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়েছিল ২৭/৬ বকশীবাজারের পুঁথিপত্রের এই ঘরেই।
মোহাম্মদ সুলতান ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৩ সালে মার্চ মাসে পুঁথিপত্র থেকে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করেন। এই বইয়ের প্রকাশক ছিলেন সুলতান এবং এই বই প্রকাশের মধ্য দিয়েই ‘পুঁথিপত্র’ হয়ে ওঠে প্রকাশনী।
একুশে ফেব্রুয়ারি বইয়ের লেখাগুলো মোহাম্মদ সুলতানকে সাথে নিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান জোগাড় করেছিলেন প্রায় একক প্রচেষ্টায়। এ সংকলনে যাঁদের লেখা ছাপা হয়েছিল, তাঁরা হলেন আলী আশরাফ, শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আতোয়ার রহমান, মুর্তজা বশীর, সালেহ আহমদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন, কবিরউদ্দিন আহমদ।
সংকলনটির প্রিন্টার্স লাইনে লেখা ছিল, পুঁথিপত্র প্রকাশনীর পক্ষ থেকে মোহাম্মদ সুলতান এটি প্রকাশ করেছেন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমিনুল ইসলাম। রেখাঙ্কন করেছেন মুর্তজা বশীর ও অন্যান্য। পাইওনিয়ার প্রেসের পক্ষে ছেপেছেন এম এ মুকিত। ব্লক তৈরি করেছে এইচম্যান কোম্পানী, বাদামতলী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৫৩। বইটি ছিল ক্রাউন সাইজে। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৮৩। দাম দুই টাকা আট আনা।
সংকলনটির ব্যয়ভার বহন করা হয়েছিল হাসান হাফিজুর রহমানের বাড়ির জমি বিক্রি করে। বইটির উৎসর্গপত্রে রয়েছে, ‘যে অমর দেশবাসীর মধ্যে থেকে জন্ম নিয়েছেন একুশের শহীদেরা, যে অমর দেশবাসীর মধ্যে অটুট হয়ে রয়েছে একুশের প্রতিজ্ঞা—তাদের উদ্দেশ্যে’। সেটা ছিল আনিসুজ্জামানের হাতের লেখায়। ‘পুঁথিপত্র’ লোগোটিও তৈরি করেছিলেন মুর্তজা বশীর।
বইটি প্রকাশের সাথে সাথে বাজেয়াপ্ত করে সরকার ও মোহাম্মদ সুলতানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এই সময়ে আত্মগোপনে চলে যেতে হয় মোহাম্মদ সুলতানকে। আইয়ূব খানের স্বৈরশাসনের পুরো দশকটিতে আত্মগোপনে থাকতে হয় তাঁকে। এ সময় বাংলাবাজারের নর্থব্রুক হল রোডে শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের বাড়িটি ছিলো তাঁর নিরাপদ আশ্রয়। ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা তৈরি করে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। বিনা বিচারে এক বছর জেলে থাকতে হয় সুলতানকে। পরে ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৫৬ সালে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ইমাদুল্লাহ লোকান্তরের পর মোহাম্মদ সুলতান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপে) জন্মলগ্নেই ন্যাপ প্রাদেশিক কমিটির যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মোহাম্মদ সুলতান।
১৯৫৮ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তাঁর স্কুলে চাকরির সমাপ্তি ঘটে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে বিনা বিচারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী হিসেবে চার বছর আটক রাখা হয়। মোহাম্মদ সুলতান ১৯৬২ সালে কারামুক্ত হয়ে প্রায় ৪ বছর টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ সময় তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক জনতা পত্রিকায় বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন, সেখানে সুলতান ছিলেন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। মোহাম্মদ সুলতান ঢাকায় ন্যাপের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে জড়ান।
মোহাম্মদ সুলতান ৩৭ বছর বয়সে, ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর বগুড়ার সুলতানগঞ্জ পাড়ার নুরজাহান সুলতান নোরা’কে বিয়ে করেন। তাঁদের ৪ সন্তান; দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে।
১৯৬৬ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হলে তিনি ভাসানীর প্রতি আস্থা রাখেন এবং ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্তির পর তিনি মাওলানা ভাসানীর অংশের প্রাদেশিক কমিটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ সুলতানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কয়েকজন বন্ধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করলে তিনি তাঁদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোহাম্মদ সুলতান আর রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি।
প্রগতিশীল পুস্তক প্রকাশনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে মোহাম্মদ সুলতান ১৯৭০ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে প্রকাশনার কাজে যুক্ত হন এবং পুস্তক প্রকাশকদের সংগঠিত করে দেশে সৃজনশীল ও প্রগতিশীল সাহিত্য পুস্তক প্রকাশনার জন্য এক গঠনমূলক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
মোহাম্মদ সুলতান তাঁর শেষ সম্বলটুকু দিয়ে প্রগতিশীল পুস্তক প্রকাশনার চেষ্টা করেছেন। পেশাগতভাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বই প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান। মোহাম্মদ সুলতান বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতির সহ-সভাপতি এবং বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য ছিলেন।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান যাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, তাদের অনেকেই মোহাম্মদ সুলতানের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। নির্ভার জীবন ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পাবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ সুলতান নতজানু হননি বরং শৈশবে রাজনৈতিক ভাবনায় যে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই ভাবনাকেই পুঁজি করে কাটিয়ে গেছেন তাঁর সারাটা জীবন।
মোহাম্মদ সুলতান ‘গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন – ‘গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা’ দুটি ভিন্ন স্রোত নয়। একটি অপরটিকে রক্ষা করে, একটি অপরটিকে লালন করে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিয়োজিত হয়। এ দুটি ধারাতেই ক্যানসারের কীট অনুপ্রবেশ করেছে। পুনরায় আজ ১৯৫০,৫২, ৬৯ বা একাত্তরের সাংবাদিক হতে হবে আমাদের সাংবাদিকদের। সংবাদ, আজাদ ও ইত্তেফাকের টেবিলে শুয়ে থাকা সাংবাদিক বন্ধুদের দেখেছি সেই আমলে। তাঁদের কলম থেকে যে শোণিত ধারা প্রবাহিত হয়েছে, আজ তা নিস্তেজ। সেই বহমান ও বেগবান ধারার উৎসমুখ জনগণের পক্ষে মুক্ত হতেই হবে। তবেই গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া চালু হওয়া সম্ভব। সংলাপে বা রাজপ্রাসাদের চক্রান্তে জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় না, প্রাসাদ ও সুদৃশ্য প্রেস ক্লাবের সৌন্দর্য বিভাসিত বা সোফাসেটের আড়ম্বরে সাংবাদিকতা নয়, শোষিত নিপীড়িত নয় কোটি বাঙালির ক্ষেতে খামারে, কলকারখানায় জনগণের মাঝে সফল সাংবাদিকতার জন্ম, উৎস ও বিস্তার। সাংবাদিকদের সেই আদি পথের দিকেই নজর ফেরাতে হবে।’ এখানেই গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা তথা যে দর্শন তিনি মানতেন, তা পুরোপুরি ফুটে উঠেছে।
প্রগতিশীল প্রকাশক হিসেবে মোহাম্মদ সুলতানের অবদান অসামান্য। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মূলত বিপ্লবী প্রগতিশীল আদর্শের বই প্রকাশের প্রতিই আগ্রহী ছিলেন। সুলতানের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই সমূহঃ সত্যেন সেনের ‘রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ’, ‘অভিশপ্ত নগরী’, মাওলানা ভাসানীর ‘মাও সেতুংয়ের দেশে’, অজয় ভট্টাচার্যের ‘নীড়’, ‘নানকার বিদ্রোহ’, আবদুল হকের ‘ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্র’, ফজলে লোহানীর ‘মহীরূহের প্রান্তর’, সাদেকুর রহমান সম্পাদিত ‘যত রক্ত তত ডলার’।
সুলতানের সকল সৃষ্টিশীল কাজে নীরবে তিলেতিলে সাহায্য করে গেছেন তার স্ত্রী নুরজাহান সুলতান নোরা। ১৯৭৮ সালে স্ত্রী নোরার মৃত্যুর পর সুলতানের সহিষ্ণুতা-ধৈর্যের পাহাড়ে ফাটল ধরে। সুলতান শারীরিকভাবে দুর্বল হতে থাকেন। এতদসত্বেও মোহাম্মদ সুলতান রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রকাশনার দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩নং ওয়ার্ডের করিডোরে মৃত্যুবরণ করেন।
ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান’কে ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। স্ত্রী নূরজাহান সুলতান নোরার কবরের পাশেই তিনি শায়িত হন চিরনিদ্রায়। কিন্তু সেই কবরের জায়গা কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা ছিল না পরিবারের সদস্যদের কাছে। জুরাইন কবরস্থানে তাঁর সাড়ে তিন হাত শেষ আশ্রয়ের টাকাটাও জোগাড় করতে হয়েছিলো সুলতানের এক ছাত্রের কাছ থেকে। সুলতানের মৃত্যু কালীন সময়ে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, এক মেয়ে ও দুই ছেলে তখনো ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক।
মোহাম্মদ সুলতান পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন প্রগতিশীল সমাজের স্বপ্ন দেখে, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন গণমানুষের পক্ষে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মহান এই অকুতোভয় ভাষা সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল চরম অনাদর-অবহেলায়।
২২ ফেবব্রুয়ারী ২০২১ সালে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের বড় মেয়ে সুষ্মিতা সুলতানা শম্পা করোনায় মৃত্যুবরণ করেন।
সম্মাননাঃ ভাষা আন্দোলনের মূল রূপকারদের একজন মোহাম্মদ সুলতানের পুরো জীবন কেটেছে সংগ্রামে সংগ্রামে। প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে তিনি ব্যক্তিগত জীবনকেও উপেক্ষা করেছেন। প্রায় সাত দশক অতিবাহিত হলেও ভাষা আন্দোলনের নায়ক মোহাম্মদ সুলতান এখনো জাতীয় স্বীকৃতি পাননি।
১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনী গ্রন্থমালা মোহাম্মদ সুলতান। লেখকঃ গাজীউল হক, প্রচ্ছদঃ কাইয়ুম চৌধুরী। এই গবেষণাধর্মী বইটি ১৯৫২’র সকল ভাষা শহীদদের প্রতি উৎসর্গকৃত।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা শহরের কেন্দ্রে ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কটি ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক নামকরণ করা হয় এবং ২০১১ সালে বোদা উপজেলার বোদা-মাড়েয়া সড়ক ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান নামকরণ করা হয়।
২০১১ সালে মৃত্যুর ২৮ বছর পর অসাম্প্রদায়িক ও বিপ্লবী এ ভাষা সৈনিককে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয় । তৎকালীন জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের তার দুই মেয়ে সুস্মিতা সুলতানা শম্পা ও চন্দনা সুলতানার হাতে এ সম্মাননা স্মারকটি তুলে দেন।
২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর ২১শে ফ্রেবুয়ারিতে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পঞ্চগড় সরকারি অডিটোরিয়াম চত্বরে ভাষা সৈনিক সুলতান বই মেলার আয়োজন করা হয়।
২০১৩ সালর ২৯ জানুয়ারী থেকে ৪ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার ময়নামতির চরে অনুষ্ঠিত ১০তম রোভার মুট ও কমেডেকা প্রদর্শনী পল্লীর নামকরণ ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের নামে করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্রঃ জাহীদ রেজা নূর | রাজিউর রহমান রাজু | Dhaka Tribune | সৌমিত্র দেব
Last updated: 24 November 2023