অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান – Adv. Md. Azizur Rahman

বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম কারিগর, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অগ্রসৈনিক, বিপ্লবী জন নেতা অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান ছিলেন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় (বর্তমান দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা) সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, এম এন এ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য), মহান মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টর এবং ৬ নং সেক্টর (অর্ধেক এর) লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার, ফ্রিডম ফাইটার্স রিক্রুটিং ও লিয়াজোঁ অফিসার এবং একইসঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক ক জোন-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ব্রিটিশ তাড়িয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২, ৬৮, ৬৯, ৭০ নির্বাচন ও ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি অব বাংলাদেশ (এমসিএ) হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত ছিলেন। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা তথা উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূখ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানে অন্যতম বিপ্লবী মুখ অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান ছিলেন তুখোর মেধাবী ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন এক নেতা।

মোঃ আজিজুর রহমান বৃটিশ আমলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সাথে যুক্ত তাঁর বিপ্লবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুল জীবনে ১৯৩৭ সালে শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম আলেকজান নেসা। অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান ছিলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহচর। তাঁরা দুজনেই ইসলামিয়া কলেজে একই সঙ্গে পড়াশোনা করতেন এবং বেকার হোস্টেলে থাকতেন। ১৯৪৪ সালে মোঃ আজিজুর রহমান ডিস্টিংশনস সহ (সকল বিষয়ে ৮৫% নম্বর) উক্ত কলেজ হতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু ও মোঃ আজিজুর রহমান দুজনেই ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষে ভারত পাকিস্তান ভাগ হলে মোঃ আজিজুর রহমান সেখানের ছাত্রত্ব শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিজ ভূমিতে ফিরে এসে দেশগড়ার কাজে হাত দেন। দেশে ফিরেই কিছু দিনের মধ্যেই জনাব মোঃ আজিজুর রহমান ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানী শাসকদের পূর্ব পাকিস্তান শোষণ করবার ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে শুরু করেন এবং কাল বিলম্ব না করে তাঁর শিক্ষা, মেধা, শ্রম এবং অর্থ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন এ অঞ্চলের মানুষের ভেতর বাঙালি বোধটিকে জাগ্রত করতে।

বাম থেকে পেছনে তাজউদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান। সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মানিক মিয়া। ছবিঃ আফতাবুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক অফিস, ৩ মার্চ ১৯৬৯।

বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জ্বল মোঃ আজিজুর রহমান-এর রাজনৈতিক পদযাত্রায় তিনি ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলা মুসলিম ছাত্র সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক-এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান ছাত্রলীগ) সভাপতির জনাব দবিরুল ইসলাম দিনাজপুরে রাজনৈতিক সভা থেকে গ্রেফতার হলে, মোঃ আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ১৯৫০ সালে আইনজীবী হিসেবে মোঃ আজিজুর রহমান দিনাজুপর বার অ্যাসোসিয়েশনে যোগদান করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দান করেন। পবরর্তীতে তিনি দিনাজপুর বার কাউন্সিলের দুবার নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দিনাজপুরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতার ইতিহাসে দেখা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিনাজপুর শহরে ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম দিনাজপুর জেলা কমিটি গঠিত করে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানকে প্রথম সহসভাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন। দিনাজপুরে জেলার প্রথম সভাপতি ছিলেন রহিমুদ্দিন উকিল সাহেব। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রট সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচনে ঘোড়াঘাট থেকে তেতুঁলিয়া প্রায় দু’শ কিঃমিঃ বিস্তৃত এই অঞ্চলে অক্লান্তভাবে সাংগঠনিক পরিশ্রম করেন এবং একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান বৃহত্তর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে তেতুঁলিয়া পর্যন্ত কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বাইসাইকেলে চড়ে, কখনো বাস আর কখনো গরুর গাড়িতে করে হাতে টিনের বানানো চোঙা নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে চলেছেন, চলার পথে ঐক্যবদ্ধ করেছেন সাধারণ বাঙালিকে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বছরগুলোতে তাঁর আইন পেশা বন্ধের উপক্রম হয়ে উঠলে তিনি নিজের জমির ফসল আর কখনো প্রয়োজনে জমি বিক্রির অর্থে দল আর সংসার চালাতে থাকেন। সাদাকাগজে বানানো অতিক্ষুদ্র আকারের চাঁদার বই সহ কিছু তরুণদের নিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে হাতও পেতেছেন দলের জন্যে চার আনা করে চাঁদা চাইতে। তাঁর অকুতোভয় প্রল কর্মকাণ্ডে বৃহত্তর দিনাজপ্রুরে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুও ভোঁতা হয়ে যায়। মোঃ আজিজুর রহমান উপেক্ষা করেন সকল বাধা। অসাধারণ বাগ্মী মোঃ আজিজুর রহমান তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর সিংহহৃদয় দেশপ্রেমের কারণে তিনি বৃহত্তর দিনাজপুর আওয়ামী লীগ রাজনীতির অপরিহার্য এবং শীর্ষ নেতা হয়ে ওঠেন। দিনাজপুরে আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে।

মোঃ আজিজুর রহমান-এর আগুনঝড়া বক্তৃতায় মানুষের চোখ খুলতে শুরু করে। এরই পাশাপাশি জনতার মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগাতে তিনি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক আওয়াজ নামে সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি সম্পাদক এবং মালিক হিসেবে এই পত্রিকার মাধ্যমে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। সেই সময়ে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি যখন ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে বাঙ্গালীর জাতিসত্বা সৃষ্টিতে নবচেতনার উন্মেষ, রাজনীতিতে বিরোধী দলের উদ্ভব, স্বাধিকার ও সাধারণ নির্বাচনের দাবী, পাকিস্তানী স্বৈরশাসনে জর্জরিত জনজীবনে; তদুপরি বঙ্গবন্ধুর উদাত্ব আহ্বানে স্বাধীনতায় উত্তরণের সুষ্পষ্ট পূর্বাভাস – এমনই এক অস্থির অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে সাপ্তাহিক আওয়াজ জেলাবাসীর মনোভুমি সৃষ্টিতে অসাধারণ চেতনা জাগায়। ১৯৫৭ সালের ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলনে দিনাজপুরের পক্ষ থেকে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং সেই সম্মেলনে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি এবং জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে একান্ত আলোচনায় মিলিত হন।

মোঃ আজিজুর রহমান ১৯৬০ সাল থেকে জুন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ৬ দফা ঘোষণার প্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব খানের জেল জুলুমের ভয়ে রাজপথ থেকে যখন বেশীরভাগ নেতাই সরে দাঁড়ালেন, অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান মাথায় গ্রেফতারের হুলিয়া নিয়েও একজন বিপ্লবীর বেশে জনতার অকুতোভয় সৈনিকের মতো গুটিকয় নেতা-কর্মী নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (দৃশ্যত কার্যকর সভাপতি) হিসেবে রুখে দাড়ান আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার জন্যে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের ফলে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্ত হয়ে অক্টোবরের ১০ তারিখে দিনাজপুর সফরে আসেন। সফরের সংবর্ধনা কমিটির সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহম্মদ আজিজুর রহমান এবং সম্পাদক অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ১৯৬৯ সালের গণ-অভুত্থানের সময় তাঁর পরিবারের অবস্থা খুব কঠিন থাকলেও তিনি আগরতলা মামলা পরিচালনার জন্যে প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। ফান্ড সংগ্রহ ছিল তাঁর তত্ত্বাবধানে। সেই সময় আন্দোলন তুঙ্গে হওয়ায় যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন এমন একটি অবস্থা সব সময়ই চলত। আইয়ুবের পতন হবে হবে সময়ে খবর এলো পুলিশ আসার খবর এলে তাঁকে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বের করে দেয়া হয় এবং তখন বাসায় যেসব রাজনৈতিক বা অন্যান্য কাগজপত্র ছিল তা পুড়িয়ে ফেলা হয়।

বাংলাদশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান ১৯৬৭ সাল হতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত সভাপতি হিসেব ভূমিকা পালন করেন। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৭০-১৯৭১ এর কমিটিতে অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছিলেন সাধারণ সম্পাদক (পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী )। অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের (ঠাকুরগাঁও, বালিয়াডাঙ্গি, রানিশংকৈল এবং হরিপুর থানা) আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এম এন এ ) নির্বাচিত হন। বৃহত্তর দিনাজপুরে জেলা বার কাউন্সিল এর সভাপতি এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে দল এবং দলের বাইরে জনপ্রিয়তার প্রবল স্রোতই তাঁকে ১৯৬৮ এবং ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ এর নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

১৯৭১ সালের ১ লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত করে দিলে প্রতিবাদী জনতা নেমে আসে রাজপথে । শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে তিনি দিনাজপুর আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি হিসেবে সকল দলের নেতাদের নিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনতাকে দৃপ্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন। ছুটে বেড়াতে থাকেন দিনাজপুর শহর থেকে ঠাকুরগাঁও মহকুমা শহর এবং তাঁর নেতৃত্বে জেলার সকল এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য) এবং এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) বৃন্দকে নিয়ে প্রতিটা থানার স্থানীয় নেতাদের সংগঠিত করে তোলেন। যুদ্ধের শেষ ধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে শিলিগুড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি জেনারেল জগজিত সিং আবারো সঙ্গে মিলিত হন। তিনি স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান এবং সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ মার্চ ১৯৭১ সালে দিনাজপুর ইনস্টিটিউটের সভায় বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক নির্দেশনায় বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার নেতাকর্মী ও তরুণদের সংগঠিত করেন। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা দিনাজপুর দখল করলে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আঙ্গিক বদলে তাঁকে সভাপতি করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদ গঠিত হয়। একাত্তরে জুলাই মাসে যুদ্ধ সেক্টরগুলো পূর্ণতা পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ পদাধিকারবলেই তিনি দিনাজপুর কেন্দ্রীয় মুক্তি-সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর লেটারহেড প্যাডে অসংখ্য নির্দেশনা জারি করেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৭-এ অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান-এর প্রদত্ত বিবৃতির কিছু অংশ উল্লেখ করা অতি প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেনঃ

“২৭ মার্চ দু ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। এ সুযোগে আমি বেড়িয়ে পড়ি এবং ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্থির হয় দিনাজপুর ইপিআর ৮ম বাহিনীর বাঙালিদের দায়িত্বে থাকবেন ক্যাপেটর নজরুল হক এবং ৯ম বাহিনীর দায়িত্বে থাকবেন সুবেদার মেজর আবদুর রউফ। আর আমি বেসামরিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করব।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, “২৪ শে মার্চে আমি ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরের ইপিআর বাহিনীর কয়েকজন সুবেদার ও হাবিলদারের সঙ্গে গোপনে আলাপ করি এবং তাদের উপদেশ দেই পাক অফিসাররা তাদের অস্ত্র জমা দিতে বললে তারা যেন তা না করেন। তাদের আরও উপদেশ দেই, এ রকম পরিস্থিতি দেখা দিলে তারা যেন অস্ত্রাগার দখল করে নেন। তারা এতে রাজি হন। দিনাজপুর ইপিআর বাহিনীর একজন সুবেদার যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বেই অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং পাক সৈন্যদের হত্যার জন্য আমার এবং জেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি অধ্যাপক ইউসুফ আলীর কাছে অনুমতি চান। কিন্তু আমরা তাঁর এ প্রস্তাবে রাজি হইনি।”

“২৭ মার্চ পাক বাহিনী আমাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে। ২৮ শে মার্চ আমি এখান থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য রওনা হই। ২৯ শে মার্চ ঠাকুরগাঁও পৌঁছাই। এখানে সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন এবং ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে একত্রে কাজ চালিয়ে যাই। সুগার মিলের জিপ নিয়ে দিনাজপুর ৯ নম্বর ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ২৯ তারিখে রওয়ানা হই। ৩০ শে মার্চ দিনাজপুরের কাঞ্চনঘাটে আমাদের মুজিববাহিনীর ঘাঁটিতে পৌঁছাই। ওই দিনই দিনাজপুরের ইপিআর ঘাঁটির সব অস্ত্র আমরা লাভ করি। এখানে রফিক সাহেব, ফয়েজ সাহেব, নাজিম ভূঁইয়া, জজ, আব্দুল হান্নান চৌধুরী এবং ক্যাপ্টেন নজরুল হকের সঙ্গে দেখা হয়। ভারতীয় বন্ধুগণ এখনে আমাদের রসদ সরবরাহ করত।”

“৩১ মার্চ ঠাকুরগাঁও ঘাঁটি আমাদের দখলে আসে। রাত দশটায় আমরা অস্ত্রাগারের অস্ত্র নিজেদের অধিকারে আনি। এ সময়ে স্থানীয় গ্রামবাসী আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা করে। এ সময়ে ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু অস্ত্র ও ওয়ারলেস সংগ্রহ করি। আমি ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের রেল লাইন অচল করে দিই এবং প্রাক্তন উইং কমান্ডার জনাব মির্জার সঙ্গে পরামর্শ করে শিবগঞ্জ বিমানঘাঁটি নষ্ট করে দিই। ক্যাপ্টেন নজরুলের দেওয়া অস্ত্রসহ আমরা এলাকাব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও সংগঠনে তৎপর হই।”

“২রা এপ্রিল সীমান্ত পার হয়ে অস্ত্রের জন্য ভারতে যাই। সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সুবেদার কাজিম উদ্দিনকে পাঠিয়ে আমি ওই তারিখে গভীর রাতে দেশে ফিরে আসি। ৩রা মার্চ আমাদের দিনাজপুরে যুদ্ধঘাঁটি পরিদর্শন করি। ওই দিনই দিনাজপুরের ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আরাফকে ঠাকুরগাঁওয়ে ডেকে পাঠাই এবং মিটিং করে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পরিকল্পনা নেই। ৫ এপ্রিল আমি সেতাবগঞ্জ ও পীরগঞ্জ ঘাঁটি অভিমুখে রওনা হই । ৬ এপ্রিল রাতে ভারতে যাই এবং কংগ্রেস নেতা বাবু আর দত্ত, এমএলএ, এর সঙ্গে আলাপ করি। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মিজানুর রহমান, মনসুর আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও সেখানে সাক্ষাৎ হয়।”

“১৩ এপ্রিল পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জে ফিরি এবং সেখান থেকে এসে দিনাজপুর শহরের উপকণ্ঠে প্রবেশের চেষ্টা করি। কিন্তু সে সময়ে পাক বাহিনী দিনাজপুরে প্রবেশ করে প্রবল গুলিবর্ষণ করে। রাতে ক্যাপ্টেন নজরুল হক, সুবেদার মেজর রউফ, সুবেদার ওসমান গনী সাহেবের সঙ্গে ভারত সীমান্তে সাক্ষাৎ হয়। এ সময়ে রাধিকাপুর স্টেশনে ভারতগামী হাজার হাজার শরণার্থী দেখতে পাই। এখান থেকে বিএসএফ ক্যাম্পে চলে যাই এবং সেখানে অবস্থান করি। ১৯ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীসহ পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করি। যুদ্ধে আমরা জয়ী হই এবং প্রচুর খাদ্যদ্রব্য উদ্ধার করি। শরণার্থী ক্যাম্পের যুবকদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করি। আমার সঙ্গে এ সময় দিনাজপুরের জজ, ডাঃ নইম উদ্দিন, ছাত্রনেতা আজিজুল ইসলামও ছিলেন। মুজিবনগর সরকার এবং ভারতীয় বাহিনী আমাদের এ ব্যাপারে সহায়তা করে।”

প্রবাসী সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে, মুজিব নগর সরকার অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ৭ নং সেক্টর এবং ৬ নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার পদে দায়িত্ব প্রদান করেন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পদ মর্যাদায় মোট দশজন নিযুক্ত ছিলেন এবং সকলেই ছিলেন এম এন এ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ) সদস্য। জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ৩০ আগস্ট জারি করা গোপন পরিপত্র নম্বর: ০০০৯জি/২ অনুযায়ী মোঃ আজিজুর রহমানের সদর দপ্তর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে। মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী কার্যত তিনি ৭ নম্বর এবং ৬ নম্বর সেক্টর (অর্ধেক) সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনায় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিলেন। উক্ত সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধীনস্থ সকলের জন্য বেসামরিক বিষয়ে তাঁর নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেওয়ার এখতিয়ার তাঁর ছিল। সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাঁর সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল।

মোঃ আজিজুর রহমান ৭ নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হককে নিয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু ৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মেজর নাজমুল হক শিলিগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করলে উক্ত সেক্টরের দ্বিতীয় সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামানকে নিয়ে মোঃ আজিজুর রহমান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। উক্ত সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার জনাব মোঃ আজিজুর রহমান-এর। তিনি কয়েকদফা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দেশের ভেতর জুন মাসে অ্যামবুশে আটকা পড়েন। ধরেই নেয়া হলো তিনি নিহত। ফলে সীমান্তে এবং রায়গঞ্জে তাঁর গায়েবানা জানাজা পড়া হয়। এর দিন কয়েক পর ভারতীয় শিখ সৈন্যরা লড়াই করে মোঃ আজিজুর রহমানকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনে। তাঁর অসীম সাহসের কারণেই তিনি একমাত্র নেতা, যিনি মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দলের সাথে যুদ্ধ করে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁয়ে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন। তিনি ১৯৭১ সালে ২০ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরের গোরে শহীদ ময়দানে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর উপস্থিতিতে বিজয় উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন। তিনি ঐ অঞ্চলে শরনার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনেও নেতৃত্ব দেন।

অ্যাডভোকেট মোহম্মদ আজিজুর রহমান-এর নেতৃত্বের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক শাসক দেশদ্রোহী ও তিন হাজার লোককে গণহত্যার অভিযোগ এনে অক্টোবর মাসে সামরিক আদালতে তাঁকে হাজির হতে সমন জারি করে এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) রিপোর্টে বলা হয়, “১৭ আগস্ট ১৯৭১ দুই দফায় ৩০ এমএনএ, কে সামরিক আদালতে তলব এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ আনা হয় ঠাকুরগাঁওয়ের মোঃ আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ সহযোগিতা ও ৩০০০ লোকের হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে আছে এক গর্ভস্থ মহিলাকে হত্যার পর টুকরা টুকরা করা।

পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক ক জোন-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তার হিসাবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তিনি । মুক্তিযোদ্ধাদের অবিকৃত তালিকার লাল বই খ্যাত দলিলে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাঠামোয় “স্বাধীনতার বীর সেনানী, স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা” শিরোনাম অধিভুক্ত ক্রম অনুযায়ী অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান এর কোড ০৭০০০০০০২১ এবং পরে দিনাজপুর ২ আসনের এম এন এ হিসাবে ০৭০০০০০০৩৯। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা উত্তর সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এম এন এ) এর মর্যাদার বদলে এম সি এ (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি অব বাংলাদেশ) হিসেবে মোঃ আজিজুর রহমান সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত হন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সকল ১৬৭ জন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এম এন এ) এবং ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) মিলিয়ে সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে এম সি এ (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি অব বাংলাদেশ) হিসেবে মর্যাদালাভ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের দলিল অনুযায়ী একটি গ্রুপ প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে সহ্য করতে পারতো না। সেখানে দুটি গ্রুপের ষড়যন্ত্র ছিল। এদের মধ্যে প্রথমটি খন্দকার মোশতাক আহমেদের ও দ্বিতীয়টি কামরুজ্জামান ও অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে। সেই সময় গোয়েন্দারা তাজউদ্দীন আহমেদকে এই রিপোর্টটি দেন (দলিল’টি ২০০২ সালের ২৫ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকা প্রকাশ করে)। কামরুজ্জামান ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাজশাহী অঞ্চলের নেতা। তারা তাজউদ্দীন আহমেদকে মেনে না নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই দলিলে লেখা আছে উত্তরাঞ্চলের শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান এমএনএ’র কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারছে না। তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন মোঃ আজিজুর রহমানের ক্ষমতা খর্ব করতে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে বঙ্গবন্ধুর কাছে মোশতাক, কামরুজ্জামান ও ইউসুফ আলী মিলে তাজউদ্দীননের বিরুদ্ধাচারণ করে তাজউদ্দীনন আহমেদকে ক্ষমতা (অর্থমন্ত্রীর পদ) থেকে সরিয়ে দিতে সমর্থ হয়। আর সেই কারণেই মোঃ আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্রে সফল হয়। কেননা ১৯৭১ সালে তারা মোঃ আজিজুর রহমানের কারণে সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তারা মোঃ আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কাছে বিভিন্ন ধরনের কথা বলে ষড়যন্ত্রে সফল হয়। ফলে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু মোঃ আজিজুর রহমান’কে নির্বাচনে নমিনেশন দেননি। স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করার সুযোগ থাকলেও জন্যে তিনি তা করেননি। তিনি বলেছিলেন “আমি আওয়ামী লীগ করি স্বতন্ত্র থেকে কেন নির্বাচন করবো?” তখন আজিজুর রহমান বঙ্গবন্ধুকে বিশাল একটি চিঠি লেখেন। পরে অবশ্য বঙ্গবন্ধু তাঁর ভুল বুঝতে পেরে ফোন দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আজিজুর রহমানকে সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দিতে বললেও তিনি যাননি। আজিজুর রহমান অনেকগুলো ভাষা জানতেন, তাঁর মধ্যে আরবি ভাষা মাতৃভাষার মতই পারদর্শী ছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্যতম কাণ্ডারি এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের সূর্যসন্তান, সর্বস্বত্যাগী অকুতোভয় এই জননেতা মোঃ আজিজুর রহমান ৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ঘাসিপাড়াস্থ ভাড়াবাড়িতে নিভৃতে ইন্তেকাল করেন । দিনাজপুর শহরে সোনাপীর গোরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় মোঃ আজিজুর রহমানের প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো আসল দলিল বর্তমানে (২০২২)পরিবারের কাছে সংরক্ষিত আছে। তাঁর চতুর্থ সন্তান বিশিষ্ট কবি, গল্পকার ও প্রখ্যাত সিনিয়র সাংবাদিক মুজতবা আহমেদ মুরশেদ।

মহান এ জননেতা সম্পর্কে দিনাজপুর তথা বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র ৫ম খণ্ডে (পৃষ্ঠা নম্বর ৫৮২) লিখেছেন,

“দিনাজপুর বারের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, সুলেখক, সম্পাদক, সংসদ সদস্য ও রাজনীতি ক্ষেত্রে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজিত যুগে। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন যুদ্ধের সংগঠক ও সংস্থানের ব্যবস্থাপনায় প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেন তিনি। ওই সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে অনেকগুলি জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন, যা দেশবাসীর মনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অপূর্ব সারা জাগায়। দিনাজপুর বড় মাঠে আয়োজিত ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর বিজয় উৎসবে তাঁর প্রদত্ত ভাষণটিও ছিল উন্মাদনাময়ী, আবেগময়ী ও জ্বালাময়ী। তিনি রাজনীতির চর্চা করে গেছেন রাজনীতির জন্য, অন্য কোনো মতলবে নয়। তিনি ভোগীর চেয়ে ত্যাগী ছিলেন বেশি। তবৎ কাজে নিজস্ব সহায় সম্পত্তি উজাড় করে দিতে অকুণ্ঠচিত্ত।”

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ


তথ্যসূত্রঃ মুজতবা আহমেদ মুরশেদ | বিডিমর্নিং | ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র | ৩০ আগস্ট ১৯৭১ সালে জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিব নগর সরকারের জারিকৃত গোপন পরিপত্র | মুক্তিযোদ্ধা তালিকার লাল বই, স্মরণীয় যারা, বরণীয় যারা | মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র

Last updated: 5 June 2025

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান
(১৯২০ - ১৯৯১)

  • মুক্তিযুদ্ধে ৭ নং সেক্টর ও ৬ নং সেক্টর (আংশিক) লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার
  • মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম অঞ্চল ক জোন-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা
  • এন এন এ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ) সদস্য
  • এম সি এ (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি অব বাংলাদেশ) জাতীয় পরিষদ সদস্য
  • সাংগঠনিক সম্পাদক, মুসলিম ছাত্র সংঘ
  • সহসভাপতি, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ
  • সভাপতি, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ
  • রাজনীতিবিদ
  • আইনজীবী
  • সম্পাদক