পঞ্চগড়-এর প্রিয়জন, গুণী শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গায়ক, নাট্যকার, সাহিত্যিক, পঞ্চগড়ের সামগ্রিক শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মেধাবী মুখ হাশেম আখতার মোঃ করিমদাদ। পঞ্চগড় বিষ্ণু প্রসাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সবার প্রিয় শিক্ষক ও সাহিত্যানুরাগী হাশেম আক্তার মোঃ করিমদাদ (বাচ্চু স্যার)-এর পঞ্চগড় জেলার শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, নাট্যজগতে অগাধ বিচরনে, আত্মপ্রচেষ্টায়-স্বপ্রণোদিত হয়ে আমৃত্যু সাহিত্যসেবা করেছেন।
একজন সুহৃদ নাট্যজন, সঙ্গীত ও আবৃত্তিশিল্পের বোদ্ধা, সাহিত্যানুরাগী, লেখক হাশেম আখতার মোঃ করিমদাদ পঞ্চগড়ের সাহিত্য উন্নয়নে রেখেগেছেন অগ্রণী ভূমিকা। স্থানীয়ভাবে সৃজনশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠন, শিল্পীগোষ্ঠী, প্রকাশনা-পত্রিকা ও ছোট-বড়ো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
একদিকে বেদ-পুরাণ-পালা-লোকগাঁথা সমৃদ্ধ বাঙ্গালীর হাজার বছরের চিরায়ত সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিস্তর জানাশোনা আরেকদিকে সংগ্রামী-রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের অভিজ্ঞতা – দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুথ্থান, মুক্তিযুদ্ধের পটপরিক্রমায় অর্জিত মুক্তকামী-অসাম্প্রদায়িক জাতীবোধের আকাঙ্খা এই দুইয়ের মেলবন্ধনে যে সচেতন-প্রগতিমনষ্ক সমাজভাবনা অত্যাবশ্যক ছিল, পঞ্চগড়ের প্রেক্ষাপটে হাশিম আখতার মোঃ করিমদাদ ছিলেন তার সর্বোচ্চ বিন্দুটি; একজন দিগদিশারী।
প্রখ্যাত সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিদ হাশিম আখতার মোঃ করিমদাদ ২৬ নভেম্বর ১৯৪৬ সালে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার নগরকাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডাঃ হাসিবুর আখতার মোঃ করিমদাদ, এবং মাতা আনোয়ারা বেগম। পিতা-মাতার চার পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শৈশব থেকেই হাশিম আখতার মোঃ করিমদাদ একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর পিতা ডাঃ হাসিবুর আখতার মোঃ করিমদাদ নিজেও ছিলেন শিল্পী সাহিত্যের একনিষ্ঠ অনুরাগী। জনাব হাসিবুর আখতার মানুষের কল্যাণে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সংগীত, নাট্যচর্চা ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার সর্বদা উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন। হাসিম আখতার মোঃ করিম -এর বড় ভাই হাসান ইমাম মোঃ করিমদাদও ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রতিভাদীপ্ত চিত্রশিল্পী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। যার স্বীকৃতস্বরূপ জনাব হাসান ইমাম পঞ্চগড় সাহিত্য সংসদ কর্তৃক প্রদেয় পঞ্চ পদকে ভূষিত হন।
হাসিম আখতার মোঃ করিমদাদ স্কুল জীবন শুরু করেন বিষ্ণুপ্রসাদ বিদ্যালয়ে। তিনি স্কুলের ক্লাসে গোপনে গোয়েন্দা কাহিনীর বই পড়তে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন শ্রেণী শিক্ষকের হাতে, শাস্তি হিসেবে তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল বিপত্তি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী। তখন থেকেই করিম দাদ সাহিত্যের মূলধারায় বিচরণ শুরু করেন। তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিএ পাস করেন এবং পরবর্তীকালে আইনবিদ্যা পড়ার জন্য ভর্তি হন ঢাকা ল কলেজে। রাজনীতিসচেতন হাসিম আখতার মোঃ করিমদাদ প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে না জড়ালেও ছাত্রাবস্থায় তিনি ঐতিহ্যবাহী বামধারার ছাত্রসংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের’ কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে ল কলেজের পড়া সম্পূর্ণ করতে পারেননি জনাব করিমদাদ।
হাশেম আখতার মোঃ করিমদাদ পঞ্চগড় ফুটকিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর মাগুরা প্রধান পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদেন করলে তাঁর চাকরি জাতীয়করণ হয়। মাগুরা প্রধান পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়কালে মূলত করিমদাদ-এর ব্যাক্তিসত্তার ও বোধের বিস্তৃতি ঘটে। পরবর্তীতে জনাব করিমদাদ শিক্ষকতা করেন যথাক্রমে সারদা পুলিশ হাই স্কুল ও বিষ্ণু প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাচ্চু স্যার তাঁর জীবনকালের প্রায় তিন দশক শিক্ষকতা করেন।
হাশেম আখতার মোঃ করিমদাদ জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলনী পরিষদ পঞ্চগড় জেলার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জনাব করিমদাদ পঞ্চগড় নজরুল পাঠাগার-এর একজন অন্যতম উপদেষ্টা ও আজীবন সদস্য ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী নজরুল পাঠাগারকে কেন্দ্র করে একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার পরিমন্ডল গড়ে তুলতে তাঁর অবদান অনেক। তিনি পঞ্চগড় থেকে প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কথা-এর উপদেষ্টা সহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। হাশেম আখতার মোঃ করিমদাদ সাহিত্য সংস্কৃতি আবেদন স্বরূপ লাভ করেছেন অনেক সম্মাননা।
হাশিম আখতার মোঃ করিমদাদ বার্ধক্যজনিত কারণে ৬৭ বছর বয়সে ২৯ অক্টোবর ২০১২ তে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পঞ্চগড় শহরের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। সংসার জীবনে মোঃ করিমদাদ দুই কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন।
আলোকিত জন হাশিম আখতার মোঃ করিমদাদ শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যেকে স্থানিক-সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে নিয়ে জাতীয় পর্যায় অবধি অবদান রেখেছেন। আরিফুর জামান পরিচালিত কাঠগড়ায় শরৎচন্দ্র সিনেমার কাহিনী ও সংলাপ লিখেছেন হাশিম আখতার মোঃ করিমদাদ।
তথ্যসূত্রঃ বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা চরিত্রকোষ | অজয় কুমার রায় | মির্জা লিও | আসাদুজ্জামান মিলন | আরিফুর জামান
Last updated: 17 December 2023