ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদির – Abdul Kadir

মহান ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব পঞ্চগড় জেলার কৃতী সন্তান ভাষা সৈনিক আবদুল কাদির। ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য জাতির কাছে তিনি ভাষা সৈনিক নামে পরিচিত।

১৯৫২ সালে ভাষা সৈনিক আবদুল কাদির রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে পৃথিবীতে যেসব আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙালির ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্ঠতম। এ কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মর্যাদায় দিবস হিসেবে পালিত হয়। তৎকালীন সময়ে ভাষা সৈনিক আবদুল কাদির ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের পঞ্চগড়ের বিক্রপ্রসাদ হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন এবং সেখান থেকেই ভাষা আন্দলনের নেতৃত্বের নায়ক ছিলেন।

সদা পরোপকারী আবদুল কাদির ১৯২৮ সালের ১৫ই এপ্রিল পঞ্চগড় শহরের মসজিদ পাড়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ উমেদ আলী এবং মায়ের নাম হেদলী বেগম। জন্মের একমাস পর আব্দুল কাদিরের মা মারা গেলে বেঙহারী গ্রামে তিনি মামীর কাছে মানুষ হন। পরে তিনি শিক্ষা গ্রহন করতে পঞ্চগড় চলে আসেন এবং বিঞ্চুপ্রসাদ হাইস্কুলে ভর্তি হোন।

শহীদ আব্দুল কাদির দেশের অন্য অন্য ভাষা সৈনিকের মত বাংলা ভাষার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়া জানাতে যখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তখন থেমে থাকেনি অদম্য ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদির। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা দিবসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে। সেই দাবি আদায়ে দলবল ছাত্র সমাজ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন সৈনিক আব্দুল কাদির। সে সময়ে তিনি পঞ্চগড় ছাত্র সমাজ নিয়ে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন এবং মিছিল করেন। তার প্রতিটি কর্মকান্ডে তৎকালীন স্থানীয় প্রশাসন ভয় পেতো। এ কারনে তখন স্থানীয় প্রশাসনের ষড়যন্ত্রে তাঁকে বিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। শুধু তাই নয়, তিনি যেন কোন সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি না পারেন সেই বন্ধবস্তও করে রাখেন। পরে ভাষা আন্দলনের মাত্রা তীব্র হলে আব্দুল কাদিরকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাক সরকার বাঙলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বিকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

এছাড়াও তিনি বৃহত্তর রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্য দিতেন। সে সময়ে তাকে সাহায্য করেন গাজীউল হক, কমরেড ফরহাদ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। আর এভাবেই বাড়ীর দুষ্ট ছেলে থেকে হয়ে উঠেন ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদির।

ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদির বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার মতো এত সুন্দর ভাষা পৃথিবীর কোথাও নেই। বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে। এই বাংলার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, এই বাংলাকে ভালোবাসি। বাঙালি না হলে যুদ্ধ হতো না। আমরা বাঙালি হয়েছি বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে।’

বায়ান্নোর পরবর্তী সময়ে আব্দুল কাদিরের জীবন সংকটময় চলে আসে। সমাজ সেবা করে দিন কাটনোর জন্য পরিবারের মাঝে অভাব দেখা দেয়। এর পর আসে ১৯৫৪’র নির্বাচন। নির্বাচনের সময় ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদির যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি চোঙার মাধ্যমে গান গেয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। সেই থেকে তিনি সবার সাথে চোঙা কাদির নামেও পরিচিতি লাভ করেন। পরে তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলরের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বেকারত্বের ভার নিয়ে তিনি একসময় চলে যান ঢাকায়। সেখানে বাংলাদেশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানীতে চাকুরি নেন। এবং এই কর্মজীবনেই শুরু হয় ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদির এর বৈবাহিক জীবন। বৈবাহিক জীবনে তিনি এক মেয়ে ও দুই ছেলের জনক ছিলেন। চাকুরি জীবনে তিনি সমাজ সেবার পাশাপাশি ছেলে মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলেন। তাঁর মেয়ের নাম মাহবুবা সেলিনা আক্তার জাহান ছন্দা। ছেলের নাম মাহবুবুল আলম বাবু ও মঞ্জুরুল আলম মিল্টন।

ভাষা সৈনিক মোঃ আব্দুল কাদির সড়কের নামফলক

২০১৪ সালের ১০শে জানুয়ারি তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

ভাষা আন্দলনের সময় আব্দুল কাদির ও তার সহপাঠীরা পঞ্চগড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজও তাকে জাতীয় ভাবে স্বিকৃতি দেওয়া হয় নি। ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদিরকে জাতীয়ভাবে স্বিকৃতি দেওয়া সহ ভাষা আন্দোলনে তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করে রাখার দাবি পরিবার ও পঞ্চগড়বাসীর।

তিনি জীবদ্দ্যোশায় কোন সৈনিক স্বিকৃতি পান নি। ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনা করে ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদিরের জন্য পঞ্চগড় জেলা পরিষদ থেকে মসজিদ পাড়া সংলগ্ন রাস্তাটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়। কয়েক বছর থেকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভাষা সৈনিক সুলতান বই মেলায় পঞ্চগড় জেলার মূল তোরণটি ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদির এর নামে করা হয়।

 


Last updated: 5 November 2023

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn