মির্জা রুহুল আমিন (চখা মিয়া) – Mirza Ruhul Amin

মির্জা রুহুল আমিন স্থানীয়ভাবে চখা মিয়া নামেই বেশি পরিচিত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মির্জা রুহুল আমিন ছিলেন বৃহত্তর ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় জেলার মানুষের কাছে সমাজ পরিবর্তনের একজন সুমহান নেতা। তিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, ক্রীড়ানুরাগী। রাজনৈতিক জীবনে মির্জা রুহুল আমিন এরশাদ সরকারের অধীনে কৃষি মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন।

মরহুম মির্জা রুহুল আমিন ‘চখা মিয়া’ নামেই এই অঞ্চলে বেশি পরিচিত ছিলেন, তিনি ছোট বেলায় ছিলেন খুব চটপটে ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন। এই বিশেষ স্ব ভাব এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জন্য উনার দাদি তাঁর ডাক নাম রেখে ছিলেন চখা। শুদ্ধ ভাষায় চোখা অর্থাৎ সুতীক্ষ্ণ। চখা মিয়া ছিলেন নামের মতোই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন এবং তার সময়ের একজন জনগণের মানুষ।

মির্জা রুহুল আমিন পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত মির্জা পরিবারে ১৯২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী জন্ম গ্রহণ করেন। মির্জা রুহুল আমিনের পিতা মির্জা কমর উদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর চাচা মৌলভী কাদের বকশ্ অবিভক্ত বাংলার একজন স্বনামধন্য নেতা,সমাজ সংস্কারক এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। চখা মিয়ার অনেকটা সময় কেটেছে সেই চাচা মৌলভী কাদের বকশ্-এর বাসায়। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সহ অবিভক্ত বাংলার অনেক বরেণ্য নেতা মৌলভী কাদের বকশ্ বাসায় আসতেন, চখা মিয়ার রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। জনাব রুহুল আমিন বর্তমান (২০২৪) বি.এন.পি. মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর পিতা।

মির্জা রুহুল আমিন মির্জাপুর এম ই স্কুলে বাল্য শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৩৮ সালে ঠাকুরগাঁও ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি প্রথমে রংপুর কারমাইকেল কলেজে এবং পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী বোমা পড়তে শুরু করায় কলকাতার রিপন কলেজ দিনাজপুরে স্থানান্তরিত হলে ঐ কলেজে পড়াশোনা করেন। মির্জা রুহুল আমিন ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. পাস করেন। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যায়ন শুরু করেন, শেষ কিন্তু বর্ষের ছাত্র থাকা কালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে পঞ্চগড়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

পাক-ভারত স্বাধীনতার ঊষালগ্নে মির্জা রুহুল আমিন সামাজিক ও রাজনৈতিক সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলে মির্জা রুহুল আমিন ঠাকুরগাঁয়ে বসবাস শুরু করেন। তিনি ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন, এবং পরে তিনি ঠাকুরগাঁও হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মির্জা রুহুল আমিন কিছু দিন পরচাকুরী ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। জনাব রুহুল আমিন ঠাকুরগাঁও মহকুমা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হবার পর ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় দীর্ঘ ১৭ বৎসর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। মির্জা রুহুল আমিন ১৯৬২ এবং ১৯৬৬ সালে দুবার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬২ সালে যমুনা সেতু নির্মাণ করার দাবিতে তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদে উত্তরাঞ্চলের মানুষের উন্নতির জন্য অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য পেশ করেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর সহযোগীতা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে মির্জা রুহুল আমিন খুন, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ অভিযোগে স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হন। তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের নির্বাহী আদেশে কারামুক্তি পেয়ে পুনরায় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৯৭৯ সালে দিনাজপুর ৪ ও ১৯৮৮ সালে ঠাকুরগাঁও ২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মির্জা রুহুল আমিন বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মির্জা রুহুল আমিন-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঠাকুরগাঁও সরকারী মহিলা কলেজ, ঠাকুরগাঁও সরকারী কলেজ, সি.এম. আইয়ুব বালিকা বিদ্যালয় ও হাজীপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারী শিক্ষা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গভীর নলকূপ, চিনিকল প্রতিষ্ঠা, বিমান বন্দর, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান সহ অর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তার মূল্যবান প্রত্যক্ষ অবদান।

মির্জা রুহুল আমিন (চখা মিয়া) ১৯৯৭ সালের ১৯ জানুয়ারী ইন্তেকাল করেন।

…আরো পড়ুন পঞ্চগড়ের অন্যান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ


Last updated: 1 May 2024

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn