মির্জা গোলাম হাফিজ – Mirza Ghulam Hafiz

মির্জা গোলাম হাফিজ ছিলেন একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবী। তিনি সংসদ সদস্য,  মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৪র্থ স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মির্জা গোলাম হাফিজ

মির্জা গোলাম হাফিজ ১৯২০ সালের ২ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মির্জাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মির্জা আজিম উদ্দীন সরকার। জনাব হাফিজ আটোয়ারীর মির্জাপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে কৃতিত্বের সাথে পাস করার পর  ১৯৩১ সালে জলপাইগুড়িতে ফনিন্দ্র দেব ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। মেধাবী কিশোর গোলাম হাফিজ ১৯৩৫ সালে ঐ ইনস্টিটিউশন থেকে তারকা সহ প্রথম শ্রেণীতে এবং জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে মেট্রিক পাস করেন। তিনি রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলেন। জনাব হাফিজ ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ. এবং ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল. ডিগ্রি লাভ করেন।

মির্জা গোলাম হাফিজ ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের জলপাইগুঁড়ি জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বাংলা প্রাদেশিক শাখার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৫-৪৭ সালে ন্যাশনাল গার্ডের উপ-প্রধান বা নায়েবে সালারে সুবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, বোদা, দেবীগঞ্জ এবং পাটগ্রাম এ পাঁচটি থানাকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মির্জা গোলাম হাফিজ। পরে র‌্যাডক্লিফ কমিশন থানাগুলোকে পাকিস্তানভুক্ত করে। নাগরিক অধিকারের প্রবক্তা মির্জা গোলাম হাফিজ ১৯৪৮-৫৮ সালে আন্তর্জাতিক সিভিল লিবার্টিজ লীগের পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৫১-৫৮ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্রী দলের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গোলাম হাফিজ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার জন্য ১৯৫২ সালে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে গোলাম হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য নির্বাচিত হন।

মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ, আটোয়ারী

মির্জা গোলাম হাফিজ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে সরকারের ৯২-ক ধারা জারীর প্রতিবাদে গড়ে উঠা আন্দোলনকালে তিনি কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান-চীন মৈত্রী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে মির্জা গোলাম হাফিজ পূর্ব পকিস্তান বার কাউন্সিল এবং নিখিল পাকিস্তান বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। গোলাম হাফিজ ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীপক্ষে আইনি সহায়তা প্রদান করেন।

জনাব মির্জা গোলাম হাফিজ ১৯৭৮ সালে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পরবর্তীতে তিনি ঐ দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৭৮ সালের ২৯ জুন তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় ভূমি প্রশাসন ও ভূমির সংস্কার মন্ত্রী নিযুক্ত হন ১৯৭৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তিনি ঢাকা থেকে (রমনা, মতিঝিল থানা) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের ২ এপ্রিল তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে সালের ২৬ শে মার্চ পর্যন্ত তিনি ঐ দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনাব হাফিজ আটোয়ারী- তেতুলিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৯১ সালের ২৩ শে মার্চ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

মির্জা হাফিজ সামাজিক, সংস্কৃতিক ও আইন সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে ঘনিষ্ট ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সাল থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন ১৯৯৪ সালের ৪ মে বেজিং-এ অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে চীন সরকার বাংলাদেশ চীনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মির্জা হাফিজকে ফ্রেন্ডশীপ এ্যামব্যাসেডর সম্মানে ভূষিত করেন। বাংলাদেশ দলের নেতা হিসেবে তিনি একাধিকবার শুভেচ্ছা সফরে চীন গমন করেন। জনাব মির্জা হাফিজ ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি টোকিও, ম্যানিলা, ব্যাংকক, নাইরোবী, দিল্লি সিঙ্গাপুর, আলজিয়ার্স, আক্রা, গ্রানোবলব, পিকিং,মক্কো এবং অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত একাধিক আইন সম্মেলনে যোগদান করেন। এছাড়া তিনি চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মিশর, মাদাগাস্কার, উত্তর কোরিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপের ৭২টি দেশ সফর করেন। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে তিনি প্রাগে অনুষ্ঠিত আন্ত-সংসদীয় ইউনিয়ন সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন এবং স্বদেশ ফেরার পথে তিনি রোমানিয়া সফর করেন।

মির্জা গোলাম হাফিজ

মির্জা গোলাম হাফিজের স্ত্রী ডাঃ আবেদা হাফিজ নিজেও একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৬২ সালে ডাঃ আবেদা হাফিজ প্রথম বাঙালি নারী হিসাবে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি  (বিএনপি)’র বর্তমান (২০২৩) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চাচা।

মির্জা গোলাম হাফিজ শিক্ষার অগ্রগতি ও সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মির্জা গোলাম হাফিজ এবং আবেদা হাফিজ একসাথে আটোয়ারী উপজেলায় মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ, পঞ্চগড় শহরে ড. আবেদা হাফিজ গার্লস স্কুল, মির্জাপুর শিশু সদন ও মওলানা আজিমউদ্দিন মাদ্রাসা, তেঁতুলিয়ায় মির্জা গোলাম হাফিজ বয়েস হাই স্কুল ও ডিগ্রি মাদ্রাসা, পঞ্চগড় সদরের  টুনিরহাটে শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ, আটোয়ারী উপজেলায় স্বীয় নামে একটি গার্লস হাই স্কুল ও দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীদ্বারে একটি বয়েজ হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়াও তাঁরা দুজনে একটি গ্রন্থাগার, সারা দেশে বেশ কয়েকটি মসজিদ, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার থানায় নয়েরহাট মির্জানগরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। একাধিক শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সুষ্ঠ পরিচালনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে জনাব হাফিজ দলমত নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। তাঁর নিজ সম্পত্তি শিক্ষা বিস্তার, সমাজসেবা ও সাধারণ মানুষের কল্যাণে দান করে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। জনাব হাফিজ তাঁর ব্যক্তিগত সংগৃহীত ১০ লক্ষ টাকার আইন বই পঞ্চগড় ও দিনাজপুর বার লাইব্রেরীতে দান করেন। মির্জা গোলাম হাফিজ পরিবার বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমল ইস্টার্ন মমতাজ প্লাজাও প্রতিষ্ঠা করেছিল।

মির্জা গোলাম হাফিজ ১৯৯৫ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। প্রথিতযশা এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ ২০০০ সালের ২০ ডিসেম্বর বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

 


Last updated: 28 November 2023

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

মির্জা গোলাম হাফিজ
(২ জানুয়ারি ১৯২০ – ২০ ডিসেম্বর ২০০০)

  • আইনজীবী
  • সংসদ সদস্য
  • ভূমি প্রশাসন মন্ত্রী
  • আইনমন্ত্রী
  • বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার
  • সমাজসেবী